বিবিসি’র এবছরের ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকার অর্ধেকই আফগান

২০২১ সালে বিশ্বের ১০০ জন অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিবিসি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Dec 2021, 05:06 PM
Updated : 7 Dec 2021, 05:06 PM

সমাজ, সংস্কৃতি ও বিশ্বে নতুন উদ্ভাবন বা পরিবর্তন সূচিত করতে যে নারীরা ভূমিকা রেখেছেন, তারাই স্থান পেয়েছেন তালিকায়।

এ বছরের এই তালিকার অর্ধেকই হচ্ছেন আফগান নারী। এই নারীদের মধ্যে স্কুলশিক্ষক, কবি, লেখিকা থেকে শুরু করে রয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং পুলিশও।

অন্যান্যদের মধ্যে আছেন- সর্বকনিষ্ঠ নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী মালালা ইউসুফজাই, সামোয়ার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ফিয়ামে নাওমি মাতা’আফা, যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যাকসিন কনফিডেন্স প্রজেক্টের পরিচালক হেইদি জে লারসন, প্রশংসিত লেখিকা চিমামান্দা আদিচি।

এছাড়াও, তালিকায় আছেন- পাকিস্তানের তিনজন, ইরানের চারজন, ভারতের একজন নারী এবং ফ্রান্স, চিলি, ইন্দোনেশিয়াসহ আরও অনেক দেশের নারীরা।

আফগানিস্তানে এ বছর তালেবান শাসনক্ষমতায় ফেরার পর লাখো আফগানের বদলে যাওয়া জীবনে নারীরা এখনও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত, রাখা হয়নি নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়, অনেক ক্ষেত্রে নারীদের কাজেও ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না।

এমন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে নারীদের সাহসিকতা এবং অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ এবছর অর্ধেক আফগান নারীকে স্থান দিয়ে ‘বিবিসি’র ১০০ নারীর তালিকা’কে তাদের জন্য উৎসর্গ করার নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এই আফগান নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কারও কারও ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং ছবি দেওয়া হয়নি।

যেভাবে তৈরি করা হয়েছে ১০০ নারীর এ তালিকা:

১০০ প্রভাবশালী নারীকে বাছাই করতে বিবিসি’র একটি দল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালী নারীদের নাম সংগ্রহ করেছে এবং বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নেটওয়ার্কের ভাষা নিয়ে কাজ করা দলের পরামর্শের ভিত্তিতে সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা তৈরি করেছে।

যেসব নারী ১২ মাসের মধ্যে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন, উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করেছেন, অনুপ্রেরণাদায়ক কিছু করেছেন কিংবা সমাজের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন; তাদেরই মূলত খোঁজা হয়েছে।

এরপর সেই নারীদেরকে এ বছরের থিমের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে এ বছর অনেক মানুষই জীবনযাপন পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে বাধ্য হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বে নতুন পরিবর্তনে নারীর ভূমিকা মূল্যায়ন করে তাদেরকে তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।

লিমা আফশিদ (কবি ও লেখিকা)

তালিকায় প্রথমেই আছেন পুরষ্কারজয়ী আফগান কবি এবং লেখিকা লিমা আফশিদ। তার বেশিরভাগ লেখাতেই আফগান সংস্কৃতির পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

তিনি ৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন স্বাধীন প্রতিবেদক এবং সামাজিক ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন।

পাশাপাশি কাবুলের শের-ই-দানেশগাহ কবিতা সমিতিরও একজন সদস্য তিনি। মহামারী চলাকালে এই সমিতি এর সদস্যদেরকে সহায়তা করতে ভার্চুয়াল কবিতা সেশনের আয়োজন করে।

মোমেনা ইব্রাহিমী (পুলিশ)

আফগান নারী পুলিশ সদস্য মোমেনা ইব্রাহিমী পরিচিতি পেয়েছেন মোমেনা কারবালায়ী নামে। পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার তিন বছর পর ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার হাতে যৌন নিপীড়নের শিকার হন তিনি।

সেসময় তিনি এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি আফগান পুলিশ বাহিনীতে অপব্যবহারের অন্যান্য অভিযোগ নিয়েও কথা বলেন।

অনিয়ম ও অপব্যবহার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বরাবরই তিনি হুমকির শিকার হয়েছেন। তারপরও তিনি নিজের নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা এবং ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার অন্যদের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করে গেছেন।

বিবিসি’কে মোমেনা বলেন, "আমি বিশ্বাস করতাম যে, নির্যাতন নিয়ে কাউকে না কাউকে সরব হতে হবে। ভাবলাম জীবনের ঝুঁকি থাকলেও সেই মানুষ তো আমি হতে পারি।"

গত অগাস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর যুক্তরাজ্যে চলে যাওয়া হাজারো আফগানের মধ্যে তিনিও একজন।

ড. আলেমা (দার্শনিক এবং প্রচারক)

আফগানিস্তানের শান্তি মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার ও নাগরিক সমাজের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দর্শন ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিশিষ্ট পন্ডিত ড. আলেমা।

স্বাধীন নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কমিটির প্রতিষ্ঠাতা এবং নারী-অধিকার বিষয়ক একজন আইনজীবীও তিনি। জার্মানি থেকে দর্শনে পিএইচডিসহ সংঘাত বিশ্লেষণে ২০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা রয়েছে তার।

তিনি জার্মান-আফগানিস্তান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আফগানিস্তানে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বই লিখেছেন। এছাড়া শরণার্থী, অভিবাসী এবং বাস্তুচ্যুতদের নিয়ে মানবিক আইনের একজন পেশাদার প্রশিক্ষক এবং মডারেটরও তিনি।

মোহাদেস মির্জাই (পাইলট)

আফগানিস্তানের প্রথম নারী বাণিজ্যিক এয়ারলাইন পাইলট হিসাবে ২০২০ সালে যোগ দেন মোহাদিস মির্জাই। এ বছরের শুরুর দিকে নারী সর্বস্ব ক্রুদের নিয়ে প্রথম ঐতিহাসিক বোয়িং ৭৩৭ বিমান চালনা করেন তিনি।

তালেবান যখন কাবুলে ঢুকে পড়েছিল, সে সময় বিমানবন্দরে থাকা মির্জাই একটি ফ্লাইটের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সেই ফ্লাইট আর ওড়ানো হয়নি তার।

বরং পরে নিজেকেই যাত্রী হিসেবে অন্য একটি বিমানে চড়ে বসে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়। মির্জাই বলেছেন, “তিনি এমন এক সমাজের পক্ষে যেখানে নারী ও পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।”

ফাতিমা সুলতানী (পর্বতারোহী)

২০১৯ সালে শখের বশে পর্বতারোহণ শুরু করেন ফাতিমা সুলতানী। এরপরই পর্বতারোহণে আফগান মেয়েদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলে তাদেরকে উৎসাহিত করাটা তার মিশন হয়ে ওঠে।

মাত্র ১৮ বছর বয়সে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নোশাখ (৭, ৪৯২ মিটার) চূড়ায় আরোহণ করে সর্বকনিষ্ঠ নারী হিসেবে নাম লেখান তিনি।

পর্বতারোহী হওয়ার পাশাপাশি সুলতানী গত ৭ বছর ধরে বক্সিং, তায়কোয়ান্দো এবং জিউ-জিৎসু জাতীয় দলের সদস্য।

মাহবুবা সিরাজ (নারী-অধিকার কর্মী)

যুক্তরাষ্ট্রে ২৬ বছর নির্বাসিত থাকার পর মাহবুবা সিরাজ ২০০৩ সালে আফগানিস্তানে ফেরেন। এরপর থেকে তিনি নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেশ কয়েকটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হয়েছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন।

তিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন মূলত গৃহে সহিংসতার শিকারদের ক্ষমতায়ন, শিশু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। চলতি বছর টাইম ম্যাগাজিনের '১০০ জন প্রভাবশালী নারী'র তালিকায়ও স্থান পেয়েছেন তিনি।

আমেনা করিমিয়ান (জ্যোতির্বিজ্ঞানী)

হেরাত টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রশিক্ষক এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আমেনা করিমিয়ান আফগানিস্তানে জ্যোতির্বিদ্যার উন্নয়নে মনোনিবেশ করা প্রথম নারীদের একজন।

২০১৮ সালে চালু হওয়া কায়হানা অ্যাস্ট্রোনমিকাল নারী গ্রুপের প্রধান নির্বাহী এবং প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বয়সে তরুণদেরকে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জানতে উৎসাহ জোগায় তার প্রতিষ্ঠান।

চলতি বছরের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা প্রতিযোগিতায় ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাস্ট্রোনোমিক্যাল ইউনিয়ন’ থেকে পুরস্কার জিতেছে করিমিয়ান ও তার দল।

রোশনক ওয়ার্দাক (স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ)

একজন সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য এবং যোগ্যতাসম্পন্ন গাইনোকোলজিস্ট, ড. রোশনক ওয়ার্দাক ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে নারীদের চিকিৎসা করে আসছেন।

এমনকী তালেবান প্রথমবার আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকার সময়ও নিজ প্রদেশের একমাত্র নারী ডাক্তার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

২০০১ সালে তালেবান শাসন পতনের পর তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হয়েছিলেন। সম্প্রতি ওয়ার্দাক স্কুল পুনরায় চালুর চেষ্টা করছেন। তালেবান  প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করায় নারী-শিক্ষা নিয়ে একজন স্পষ্টবাদী উকিল হয়ে উঠেছেন তিনি।