দিল্লির শ্বাস কেড়ে নিচ্ছে ‘ধোঁয়াশা’

খাবারের জন্য হাত পেতে নোংরা মাদুর বিছিয়ে দিল্লির সাউথ ক্যাম্পাস মেট্রো স্টেশনে বসে ছিলেন গুলপ্রিত সিং। 

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2021, 06:46 PM
Updated : 27 Nov 2021, 06:46 PM

ভারী ধোঁয়াশায় শ্বাস নিতে কষ্ট হলেও ভারতের ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ লাখো মানুষের মত ৮৪ বছর বয়সী এই বৃদ্ধেরও ঘর থেকে না বেরিয়ে উপায় ছিল না।

রাস্তার গাড়ির ছেড়ে যাওয়া ধোঁয়া আর অটোরিকশার তীব্র হর্নের শব্দের মধ্যে গুরপ্রিত সিং বলেন, “আমি এখানে এসেই বসি। মাঝেমধ্যে লোকজন আমাকে খাবার দেয়।”    

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ভারতের রাজধানীর নাম প্রথম দিকেই থাকে। ভারতের ন্যাশনাল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরের শুরুতে দিল্লির বায়ু দূষণ ‘বিপজ্জনক’ মাত্রায় পৌঁছে যায়।

এক প্রতিবেদনে সিএনএন লিখেছে, দিল্লির অনেক বাসিন্দা ‘বিষাক্ত বাতাসে’ এতোটাই অভ্যস্ত হয় গেছেন যে, এটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। চারপাশে দূষণের বিস্তার তারা এখন খুব কমই খেয়াল করেন।

তবে অনেকেই বলছেন, বিষে ভরা এই বাতাস তাদের অসুস্থ করে ফেলছে।

ধোয়াশাঁয় রুদ্ধশ্বাস  

দিল্লির ব্যস্ত একটি মোড়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তার ভাষায়, এই শীতে দূষণের মাত্রা ‘অসহনীয়’ হয়ে উঠেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ৪৮ বছর বয়সী এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “গাড়ি থামানোর জন্য হুইসেল বাজাতে হয় বলে আমাকে মাস্ক খুলতে হয়, কিন্তু এটাও বিপজ্জনক।

চারপাশ ঘিরে সারি সারি গাড়ির ধোঁয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, এই অবস্থার মধ্যে তার শ্বাস নিতেও বেগ পেতে হয়।

“আমার চোখ জ্বলাপোড়া করে। শ্বাস টানতেও কষ্ট হয়। এভাবে চালিয়ে যাওয়া তো কঠিন।”

৩৯ বছর বয়সী সমাজকর্মী নিলাম যোশী প্রতিদিন কাজে যান ট্রেনে চেপে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রতিদিনই এমন দূষণের মুখোমুখি হওয়ার কথা জানালেন তিনি।

যোশী বলেন, “সকালে বাড়ি থেকে বের হলে প্রথমেই আপনি একটা ধাক্কা খাবেন।”

দিনের শেষে তার শরীর এসবের সঙ্গে মানিয়ে যায় বলে মনে হলেও পরদিন আবারও একই ঘটনা ঘটে।

“দিল্লিতে আছি গত ছয় বছর ধরে। দূষণ কখনও কমতে দেখিনি। বরং প্রতিবছর বাড়ছে। প্রত্যেক বছরই আমরা ভিন্ন এক মাত্রা দেখতে পাচ্ছি। আর উৎসবের মওসুমে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি হয়।”

দিল্লির রোহিনী এলাকার বাসিন্দা আমানপ্রীত কৌর পেশায় একজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে বায়ুমানের পার্থক্য দেখে তিনি হতভম্ব হয়ে যান।

তিনি বলেন, “ফ্লাইট শেষে যখন ফিরলাম, সে বড় ভয়ানক অভিজ্ঞতা, আমি ক্রমাগত কাশছিলাম।”

২৮ বছর বয়সী কৌর জানান,  এই ধোঁয়াশা এতোটাই বাজে যে, রাতে সড়ক বাতি এবং গাড়ির হেডলাইটের আলো ঘিরেও নোংরা কুয়াশার মতো জমে থাকে।

“সূর্যাস্তের সময় আপনি কেবল ধোঁয়াশা দেখতে পাবেন, চারদিকে কেবল ধোঁয়াশা। দিল্লিতে বাস করাটাই এখন বিপজ্জনক।”

‘নিঃশ্বাসের অধিকার’

দিল্লির দূষণ ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গত দুই বছর ধরে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন ১৮ বছর বয়সী পরিবেশ কর্মী আদিত্য দুবে।

প্রতি বছরই ময়লা ধোঁয়াশার মেঘে আচ্ছন্ন হয় এই নগরী। তবে শীতকালে তাপমাত্রা যখন কমে আসে এবং বাতাসের গতি কমে যায়, তখন বাতাসে দীর্ঘ সময় ধরে নানা ধরনের ক্ষুদ্রকণা আটকে থেকে বাজে অবস্থা তৈরি হয়।  

“শীত একটা অত্যাচার হয়ে উঠেছে এবং দিনের পর দিন এটা একটা শাস্তি বলে মনে হয়। আমার চোখ জ্বালাপোড়া করে, এবং জল গড়ায়। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে।”

সিএনএন লিখেছে, গত মাসে দিওয়ালির সময় আতশবাজি নিষিদ্ধ করে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেনে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কিন্তু আলোর এই উৎসব প্রায় স্বাভাবিক গতিতেই উদযাপিত হয়েছে।

দিওয়ালির বাজি পোড়ানো ধোঁয়ার সঙ্গে তীব্রতা বাড়িয়েছে আশপাশের কৃষি জমিতে ফসলের নাড়া পোড়ানো ধোঁয়া।

৫ নভেম্বরের মধ্যে দিল্লির বেশিরভাগ স্থানে বাতাসের মান (একিউআই) স্কেলের সর্বোচ্চ খারাপ মাত্রা ৫০০ তে উঠে যায়।

এমন অবস্থা আর  মানতে পারেননি পরিবেশ কর্মী আদিত্য দুবে। নিজের ‘শ্বাস নেওয়ার অধিকার’ রক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্টে তিনি একটি আবেদন করেন।

১৫ নভেম্বর আদালত তার পক্ষে রায় দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আদেশ দেয়।

এর পরপরই স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, অপ্রয়োজনীয় যান চলাচল বন্ধ করা হয়, নির্মাণ প্রকল্পগুলোর কাজ থামিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া নভেম্বরের শেষ অবধি ১১টি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে ছয়টি বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।  

বাতাসের মান সামান্য উন্নত হওয়ার পর গত সোমবার নির্মাণ প্রকল্পগুলোর কাজ ফের শুরু করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে অনেকের ক্ষতি হয়ে গেছে।

নীরব ঘাতক

ভারতের শহরগুলোর মধ্যে কেবল দিল্লিই ধোঁয়াশায় হাঁসফাঁস করছে এমন নয়।

বাতাসের মান পর্যবেক্ষণে কাজ করা সুইজার‍ল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ১০টির নগরীর মধ্যে নয়টিই ছিল ভারতের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বায়ুদূষণের ফলে হৃদরোগ, ক্যান্সার এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বে সাত কোটি মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটছে। 

ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিআইসি)এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, বায়ু দুষণের ফলে ভারতের কোটি মানুষের আয়ু নয় বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

১৩০ কোটি ভারতীয়র প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত বার্ষিক গড় মাত্রার চেয়েও বেশি দূষণের শিকার হন।

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের মধ্যে বাতাসে ক্ষুদ্র কণার দূষণ ৩০ শতাংশ কমিয়ে আনতে ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করে। প্রতিটি শহরের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়।

দিল্লির সড়কে যানবাহন কমানো, বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ এবং রাস্তার ধুলা কমিয়ে আনা এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানির ব্যবহার উৎসাহিত করার কথা রয়েছে এই পরিকল্পনায়।

কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতে দূষণ সঙ্কট আরও তীব্র হয়েছে। বিশেষ করে কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ওপর দেশটির নির্ভরতা এজন্য আংশিক দায়ী।

সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে প্রস্তাবিত চুক্তি সংশোধন করে কয়লার ব্যবহার ‘বাতিল করার’ পরিবর্তে ‘কমিয়ের আনার’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ভারতসহ কয়েকটি দেশের চাপে।

আইকিউ এয়ারের তথ্য পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্রিনপিস জানিয়েছে, দিল্লিতে বিষাক্ত বাতাসের কারণে প্রতি বছর হাজারো মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

কিন্তু দিল্লির অনেকে মাস্ক ছাড়াই রাস্তায় ঘুরে বেড়ান এবং দূষণের সঙ্গে বসবাসের অভ্যস্ততাও তাদের তৈরি হয়ে গেছে।

বাগান পরিচর্যায় নিয়োজিত ৫০ বছর বয়সী ওম প্রকাশ মালি বললেন, বাতাসের এই দূষণ তার নিজের কিংবা কাজের ওপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলে বলে তার মনে হয় না।

“আমরা মালিরা ধুলা আর কাদা নিয়েই কাজ করি, তাই বাড়তি কিছু আমি টের পাই না। আমি মনে করি সরকারের এখনও উচিত কোভিড কে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া। দূষণতো প্রতি বছরই হয়।”   

১৮ বছর বয়সী দিন মজুর শিষ বাবু জানালেন, দিল্লির ঘন ধোঁয়াশাকে তিনি আসলে ‘পাত্তা দেন না’। তাকে রোজগারের চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকতে হয়।

পরিবেশ কর্মী আদিত্য বলেন, বায়ু দূষণকে ভারতের অনেকে ‘অভিজাত মানুষের’ ভাবনার বিষয় বলে মনে করেন।

“বায়ু দূষণ একটি নীরব ঘাতক। এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। লোকজন এর গুরুত্ব বুঝতে পারে না।”

আরও পড়ুন