‘প্রপ গান’ কী? কেন সেটা বিপজ্জনক?

সিনেমার সেটেই ঘটল বাস্তবের এক বিয়োগান্তক ঘটনা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2021, 06:50 PM
Updated : 22 Oct 2021, 06:55 PM

নিউ মেক্সিকোয় একটি সিনেমার সেটে মার্কিন অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনের ‘প্রপ গানের’ গুলিতে মারা গেছেন সিনেমাটোগ্রাফার হালিনা হাচিনস এবং আহত হয়েছেন পরিচালক জোয়েল সুজা। ‘রাস্ট’ নামে একটি চলচ্চিত্রের শুটিং করছিলেন তারা।

৪২ বছর বয়সী হাচিনসের জন্য শোক জানাচ্ছেন অনেকেই। আর বল্ডউইন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। সান্তা ফে কাউন্টির শেরিফের দপ্তরের বাইরে তাকে কাঁদতে দেখা গেছে বলে স্থানীয় একটি সংবাদপত্র জানিয়েছে।

বিবিসি লিখেছে, এ ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে, কোথায় গড়বড় হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। অভিনেতা বল্ডউইনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সিনেমার সেটে প্রপ গান থেকে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ বেরিয়ে গিয়ে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সিনেমার সেটে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে খুবই কঠোর সুরক্ষা নিয়ম মেনে চলতে হয়। বিরল এই দুর্ঘটনায় পুরো চলচ্চিত্র বিশ্বই হতবাক।

অস্ট্রেলীয় অভিনেতা রিস মুলডুন বলেছেন, “আমি সম্প্রতি যে সিনেমাটি করেছি, সেখানে আমার প্লাস্টিকের বন্দুকটির জন্যও প্রতিদিন সাইন ইন ও সাইন আউট করতে হত। ফলে কীভাবে এটা ঘটতে পারল, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”

বিবিসির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপদ মনে হলেও ‘প্রপ গান’ এবং ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ দুটোই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

‘প্রপ গান’ কী?

সিনেমায় গোলাগুলির দৃশ্য বাস্তবের মত করে দেখাতে ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ ব্যবহার করা হয়।

আসল  গুলিকে সামান্য বদলে দিয়ে এই ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ বানানো হয় বলে একেবারে আসলের মতই দেখায়। 

সাধারণভাবে ‘বুলেট’ শব্দটি যখন ব্যবহার করা হয়, তখন আগ্নেয়াস্ত্রে যে কার্তুজটি ভরা হয় সেটাকেই বোঝানো হয়।

সেখানে একটি চোঙের ভেতর বিস্ফোরকের গুঁড়ো ঠেসে দিয়ে মুখ আটকানো থাকে। যখন গুলি চালানো হয় তখন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটি বুলেট কিংবা কোনো একটি বস্তুকে নিক্ষেপ করে।

‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ এ ওই বিস্ফোরক থাকলেও মাথার দিকে বুলেট বা ছুড়ে দেওয়ার মত কিছু থাকে না। আসল গুলির সঙ্গে এটুকুই এর পার্থক্য।

‘প্রপ গান’ দিয়ে অনেক কিছুই বোঝানো যেতে পারে। এটা হতে পারে অস্ত্রের রেপ্লিকা, অকেজো অস্ত্র কিংবা ‘ক্যাপ গান’। আবার সিনেমার শুটিংয়ে যদি আসল অস্ত্র কিংবা ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ ব্যবহারের জন্য বদলে নেওয়া অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেটাকেও ওই ‘প্রপ গানই’ বলে।

প্রপ গান আর ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ ব্যবহার করেই সিনেমার দৃশ্যকে বাস্তব গোলাগুলির মত দেখানো হয়। প্রপ গান দিয়ে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ ছোড়া হলে গুলি করার মতই জোড়ালো শব্দ হবে। সত্যি সত্যি গুলি করলে অস্ত্র যেমন পেছনে ধাক্কা দেয়, এখানেও তাই হবে। সেই সঙ্গে অস্ত্রের নলের মুখে দেখানো যাবে আগুনের হলকা। আসল অস্ত্র দিয়ে গুলি করার সময় বিস্ফোরকের গুঁড়ো জ্বলে উঠলে আলোর ওই ঝলকানি দেখা দেয়।

এমন ঘটনা আগে ঘটেছে?

অনেকের হয়ত মার্শাল আর্টের কিংবদন্তি ব্রুস লির ছেলে অভিনেতা ব্র্যান্ডন লির কথা মনে থাকবে।

১৯৯৩ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। ‘দ্য ক্রো’ সিনেমার শুটিংয়ে ভুল করে ডামি গুলি ভরা একটি ‘প্রপ গান’ থেকে তার দিকে গুলি ছোড়া হয়।

ডামি গুলিতে কোনো বিস্ফোরক থাকে না। ব্র্যান্ডন লির ক্ষেত্রে খুব কাছ থেকে সেটা ব্যবহার করা হয়েছিল। অস্ত্রে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ ভরার সময় ভুল করে ডামি গুলিও থেকে গিয়েছিল।

ব্র্যান্ডন লিকে গুলি করার পরও ক্যামেরায় চিত্র ধারণ চলতে থাকে। ওই দৃশ্য ধারণ শেষ হওয়ার পরও তিনি যখন উঠলেন না, সেটের বাকিরা তখন বুঝতে পারলেন কিছু একটা গড়বড় হয়েছে।

১৯৮৪ সালে একটি টেলিভিশন শোর শুটিং শুরু করতে দেরি হওয়ায় মার্কিন অভিনেতা জন-এরিক হেক্সাম হতাশা জানিয়ে সেটে দাঁড়িয়ে কৌতুক করার সময় এরকম আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটে।

তিনি একটি রিভলভারে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ ভরে নলটি ঘুরিয়ে নিজের মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপে দেন।

ব্র্যান্ডন লির মত অস্ত্র থেকে নিক্ষিপ্ত ডামি গুলিতে তিনি মারা যাননি। বিস্ফোরণের কারণে তার মাথার খুলি ফেঁটে গিয়েছিল। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একদিন পর তিনি মারা যান।      

‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ ও ‘প্রপ গান’ নিরাপদে কীভাবে ব্যবহার করা যায়?

হেক্সামের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ নিয়ে সমস্যাটি সামনে আসে। কার্তুজের অগ্রভাগে কোনো ‘বুলেট’ কিংবা নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো কিছু না থাকলেও বিস্ফোরণে প্রচণ্ড শক্তি নির্গত হয়।

দৃশ্যকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য কিছু সিনেমার সেটে অতিরিক্ত বিস্ফোরকের গুঁড়ো ব্যবহার করায় ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।

সিনেমার সেটে সাধারণত ‘প্রপ গান’ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম মানতে হয়। বিশেষজ্ঞরা সেটে ব্যবহারের উপযোগী আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করে থাকেন এবং সেসব ব্যবহারের নিয়মও বাৎলে দেন।

অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইনের সঙ্গে এর আগে কাজ করা অস্ত্র বিশেষজ্ঞ মাইক ত্রিস্তানো বলেন, প্রত্যেকে সেটেই মৌলিক কিছু সুরক্ষা নিয়ম থাকে।   

“কখনোই কারো দিকে বন্দুক তাক করা ঠিক না, সেটা গুলি ছোড়ার বন্দুক না হলেও না। আমি এটা ভেবে পাই না, এটা কেমন করে ঘটল এবং কী করে এতোটা ক্ষতি হয়ে গেল।”

সিনেমার একটি প্রচলিত দৃশ্য আছে, যেখানে অভিনেতাকে ক্যামেরার দিকে গুলি ছুড়তে হয়। ফিউরি অ্যান্ড দ্য লিমিটেশন গেইম এর মত সিনেমায় কাজ করা স্টিভেন হল জানান, পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েই এটা করতে হয়।

“আপনি যদি গোলাগুলির মাঝখানে থাকেন… আপনাকে একটি মুখোশ পড়তে হবে, চোখে চশমা পড়তে হবে, পারস্পেক্স স্ক্রিনের পেছনে দাঁড়াতে হবে এবং আপনাকে ক্যামেরার আশেপাশে লোকজন কমাতে হবে।”

তিনি বলেন, “এ ঘটনায় আমি যে বিষয়টি বুঝতে পারছি না তা হল, দুজন লোক কীভাবে জখম হল, একজনতো মারাই গেলেন।”

চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত বাকিরা অবশ্য বলছেন, বন্দুকের ক্ষেত্রে যখন খুব সুলভে কম্পিউটার ‘ইফেক্ট’ ব্যবহার করা যায়, সেখানে এখনও কেন ‘ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ’ ব্যবহার করা হচ্ছে।

‘ওয়েস্ট ওয়ার্ল্ড’ এবং ‘মেয়ার অব ইস্টটাউন’ সিনেমার পরিচালক ও অভিনেতা ক্রেইগ জোবেল এক টুইটে লিখেছেন, “বন্দুকে ব্ল্যাংক কার্ট্রিজ কিংবা অন্য কিছু ভরে সেটে ব্যবহার করার আর কোনো কারণই নেই। এটা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।”

টিভি চিত্রনাট্যের লেখক ডেভিড স্ল্যাক টুইটে লিখেছেন, প্রপ গানও বন্দুক।

“ব্ল্যাংক কার্ট্রিজে আসল বিস্ফোরক গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। সেটাও জখম কিংবা মৃত্যু ঘটাতে পারে… মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে কোনো শো কিংবা কোনো দৃশ্য অর্থবহ হতে পারে না।”