‘আমার টিকার সনদে কেন মোদীর ছবি?’

ভার‌তে কোভিড-১৯ টিকার সনদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি থাকায় নাখোশ এক নাগরিক শরণাপন্ন হয়েছেন আদালতের। জানতে চেয়েছেন, কেন তার টিকা কার্ডে থাকবে প্রধানমন্ত্রীর ছবি?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Oct 2021, 03:21 PM
Updated : 19 Oct 2021, 03:51 PM

ঘটনাটি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার। পিটার এম নামের এই নাগরিকের আবেদন নিয়ে আগামী সপ্তাহেই কেরালার আদালত শুনানি অনুষ্ঠান করবে। 

পিটার নতুন একটি টিকা সনদ চান, যেখানে নরেন্দ্র মোদীর ছবি থাকবে না। ভারতের তথ্য অধিকার কর্মী ও প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের সদস্য ৬২ বছর বয়সী পিটার এম এর অভিযোগ, তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

নিজ বাড়ি কোয়াট্টাম জেলা থেকে টেলিফোনে বিবিসি-কে তিনি বলেন, “আমার সনদে তার (মোদী) ছবি থাকা মানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনুপ্রবেশ করছেন। এটি অসাংবিধানিক। আমি সম্মানিত প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি, তিনি যেন অবিলম্বে এই ভুল, লজ্জাজনক কাজ বন্ধ করেন।”

“গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এটি ঠিক নয়। এটা দেশের কোনও কাজে আসবে না, কোনও ব্যক্তিরও কাজে লাগবে না,” বলেন তিনি।

ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু করা কোভিড টিকা নেওয়ার সনদে নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবির সঙ্গে ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষায় দুটি বার্তা দেওয়া হয়েছে।

গত অগাস্টে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ভারতী প্রবীন পাওয়ার পার্লামেন্টে বলেছিলেন, “বড় ধরনের জনস্বার্থে ওই ছবি এবং উদ্ধৃতি টিকা সনদে যোগ করা হয়েছে, যাতে টিকা নেওয়ার পরও মানুষ কোভিড বিধিমালা মেনে চলে।”

কিন্তু পিটার এম যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, “যারা এরই মধ্যে টিকা নিয়েছেন তারা এর উপকারিতা সম্পর্কে জানেন। তাই তাদের কাছে আর এমন বার্তা দেওয়ার মানে হয় না।”

তাছাড়া তিনি আরও বলেন, ''জনাব মোদী আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নন। আর এটি ভারতের প্রথম টিকা কর্মসূচিও না। কিন্তু কোভিড-১৯ মোকাবেলার প্রচার এবং এর টিকা কর্মসূচিকে এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, যেন সব কৃতিত্ব কেবল একজনের, এটি প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রচারেরই একটি হাতিয়ার।”

পিটার এম আরও বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন এই কারণে যে, একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে টিকা নিতে তাকে অর্থ খরচ করতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে লম্বা লাইন থাকার কারণে তিনি সেখান থেকে বিনামূল্যে টিকা নিতে পারেননি।

''প্রতি ডোজ টিকার জন্য আমি ৭৫০ রুপি করে দিয়েছি। তাহলে কেন আমার সনদে মোদীর ছবি থাকবে?'' প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। তার অভিযোগের ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারকে জবাব দেওয়ার জন্য দু'সপ্তাহ সময় দিয়েছে কেরালা হাইকোর্ট।

আদালতে পিটার এম এর পিটিশনের ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদীর দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দুই মুখপাত্রের কেউ বিবিসি সংবাদদাতার কাছে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কোভিড টিকার সনদে প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকা নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোও। এমনকী বিরোধীদল শাসিত কয়েকটি রাজ্য টিকার সনদে নরেন্দ্র মোদীর ছবি সরিয়ে নিজেদের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দিয়েছে।

কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী অভিযোগ করে বলেছেন, মোদী ব্যক্তিগত প্রচারণার জন্য টিকা কর্মসূচিকে ব্যবহার করছেন। ওদিকে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, “তার (নরেন্দ্র মোদী) উচিত মৃত্যু সনদেও ছবি দেওয়া।”

এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন তুলে মমতা বলেন, ''ধরুন, আমি আপনার সমর্থক নই ...আমি আপনাকে পছন্দ করছি না, কিন্তু আমাকে এটা (ছবি) বহন করতে হচ্ছে। কেন? মানুষের স্বাধীনতা কোথায়? কোভিড সনদে আপনার ছবি বাধ্যতামূলক করেছেন। তাহলে এখন মৃত্যু সনদেও তা লাগিয়ে দিন।”

 বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া ভারতীয়দের জন্যও এ ছবি সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ভাইস নিউজ সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যেসব দেশের অভিবাসন কর্মকর্তারা নরেন্দ্র মোদীকে চেনেন না, তারা কোনও কোনও ভ্রমণকারীর এই সনদ জাল বলে সন্দেহ করেছেন।

পিটার এম এর উদ্বেগ, কোনও প্রশ্ন না তুলে বিষয়টি মেনে নেওয়া হলে হয়ত দেখা যাবে ভবিষ্যতে স্কুল, কলেজের সার্টিফিকেটেও নরেন্দ্র মোদীর ছবি জুড়ে দেওয়া শুরু হবে।

তার এই উদ্বেগের কারণ হল, মোদীর ছবি অনেক সময় এমন জায়গায় দেখা যায় যেটি আদতে সেখানে থাকার কথা নয়। যেমন: সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপত্তির পর অফিসিয়াল কোর্ট ইমেইল থেকে নরেন্দ্র মোদীর ছবি সম্বলিত সরকারি বিজ্ঞাপন ফেলে দেওয়া হয়।

ছবি এবং সেলফি তোলায় প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর আগ্রহের কথা সবারই জানা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার অনেক অনুসারী আছে এবং দেশজুড়ে তার সমাবেশগুলোতে লাখ লাখ মানুষও হয়। তার সমর্থকরা বলছেন, টিকার সনদে প্রধানমন্ত্রীর ছবি থাকা ভুল কিছু নয়, কারণ তিনিইদেশের সবচেয়ে পরিচিত মুখ।

মোদীর শশ্রুমণ্ডিত চেহারা ভারতের রাস্তায় রাস্তায় আর বহু বিল বোর্ডেও আছে। পত্রিকার পূর্ণ পাতা সরকারি বিজ্ঞাপনে তার হাসিমুখ দেখা যায়। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটগুলোতেও তার ছবি থাকে।

সমালোচকরা বলছেন, ভারতে কখনওই আত্ম-প্রচার চালানো নেতাদের কমতি দেখা যায়নি। অতীতে গান্ধী-নেহরু পরিবারের নামে শত শত এয়ারপোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়, পুরস্কার আর কল্যাণ কর্মসূচির নামকরণ করায় কংগ্রেস পার্টির সমালোচনা করেছে বিজেপি।

উত্তর প্রদেশের দলিত সম্প্রদায়ের আইকন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী নিজের মূর্তি বানিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে ব্যক্তি পূজা উস্কে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছিল। সস্তা খাবারের ক্যান্টিন, ওষুধের দোকান আর লবণের প্যাকেটে নিজের ছবি জুড়ে দিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জয়ারাম জয়ললিতাও।

''কিন্তু মোদী তার আত্ম-প্রেমকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছেন,'' বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক ও মোদীর জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ''মোদী আরএসএস (হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ) সদস্য, যারা বলে- ব্যক্তির চেয়ে সংগঠন বড়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে তিনিই সংগঠনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন।”