কাদির খান: পশ্চিমাদের চোখে ছিলেন ‘বিন লাদেনের মতোই বিপজ্জনক’

২০০৩ সালের তেসরা ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের একদল গোয়েন্দা লিবিয়া থেকে একটি বিমানে উঠছিলেন, তাদের হাতে হাফ ডজন বাদামি খাম ধরিয়ে দেওয়া হয়। গোপন এক মিশনের শেষ সীমায় ছিলেন তারা। এই মিশন ছিল লিবিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতার।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Oct 2021, 04:40 PM
Updated : 10 Oct 2021, 04:41 PM

বিমানে ওঠার পর তারা যখন খাম খুললেন; তখন দেখলেন প্রয়োজনীয় জিনিসটি তারা পেয়েছেন। এর ভেতরে ছিল পারমাণবিক অস্ত্রের কিছু নকশা, এই নকশাটি লিবিয়ায় এসেছিল আবদুল কাদির খানের কাছ থেকে।

কাদির খান পাকিস্তানের বিজ্ঞানী, পাকিস্তানের ‘পরমাণু বোমার জনক’ বলা হয় তাকে। ৮৫ বছর বয়সে রোববার তিনি মারা গেলেন।

ঘটনাবহুল এক জীবনে কাদির খান কেন এত আলোচিত, তা বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি।

গত অর্ধ শতক ধরে বিশ্বের নিরাপত্তা প্রশ্নে কাদির খান ছিলেন আলোচিত এক ব্যক্তি। বিপজ্জনক এক লড়াইয়ের কেন্দ্রে ছিল তার নামটি, এই লড়াই তাদের মধ্য যাদের পরমাণু বোমা আছে, আর যাদের না থাকলেও তা পাওয়ার উচ্চাশাটি আছে।

সিআইএর সাবেক পরিচালক জর্জ টেনেন্টের চোখে, কাদির খান আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের চেয়ে ‘কম বিপজ্জনক ছিলেন না’।

পশ্চিমা গোয়েন্দাদের কাছে বিপজ্জনক হলেও স্বদেশে ছিলেন বীরের মতো। আর এই বৈপরীত্য শুধু ব্যক্তি কাদির খানকেই তুলে ধরছে না, পরমাণু অস্ত্র নিয়ে বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গীগত পার্থক্যও মেলে ধরেছে।

কাদির খানের জন্ম ১৯৩৬ সালে ভারতের ভোপালে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পরিবারের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যান।

কাদির খান গোয়েন্দা হয়ে ইউরোপে যাননি, তবে হয়ে উঠেছিলেন। গত শতকের ৭০ এর দশকে তিনি ছিলেন নেদারল্যান্ডসে, ওই সময় একাত্তরের যুদ্ধে হেরে আর ভারতের পরমাণবিক পরীক্ষায় শঙ্কিত পাকিস্তানও নিজেদের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করেছিল। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের গোপন উদ্যোগে যোগ দেন তিনি।

কাদির খান ইউরোপীয় একটি কোম্পানিতে কাজ করতেন, যারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য সেন্ট্রিফিউজ তৈরি করত। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পরই তা পারমাণবিক শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এমনকি বোমা তৈরিতেও।

সেই কোম্পানির সেন্ট্রিফিউজ তৈরির আধুনিক কৌশলপত্রের নকশা নকল করে তা নিয়ে পাকিস্তানে পাড়ি কমান কাদির খান। শুধু তাই নয়, গোপনীয় একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন তিনি, ইউরোপের ব্যবসায়ীদের নিয়ে, যারা তাকে পরমাণু বোমা তৈরির নানা উপাদানের জোগান দিত।

পাকিস্তানের পরমাণু বোমার জনক হিসেবে খ্যাত হলেও কাদির খান আসলে ছিলেন এই কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনের একজন। কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের হুমকি থেকে পাকিস্তানকে বের করে আনার তার যে পদ্ধতি, সেটাই তাকে জাতীয় বীরে পরিণত করে। দেশের প্রতি অবদানের জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব নিশান-ই-ইমতিয়াজেও ভূষিত হন তিনি।

কিন্তু এর বাইরে কাদির খান যা করেছেন, সেটাই তাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। নিজের সেই নেটওয়ার্ককে পরমাণু প্রযুক্তি আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্র করে তোলেন তিনি, আর এই ব্যবসা শুরু করেন কিছু দেশের সঙ্গেও, যেগুলো পশ্চিমাদের চোখে ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত।

ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্রের সেন্ট্রিফিউজ তৈরির কাজটি মূলত কাদির খানের দেওয়া নকশা থেকেই বানানো শুরু হয়েছিল। তিনি এক ডজনের বেশিবার উত্তর কোরিয়া সফর করেন, সেখানেও দেশটির সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির সঙ্গে পরমাণু প্রযুক্তির বিনিময় হয় বলে ধারণা করা হয়।

কাদির খানের এমন তৎপরতার মধ্যে একটা প্রশ্ন রহস্য হয়েই থেকেছে, তিনি কি নিজে থেকেই এসব করতেন? নাকি পাকিস্তানের শাসকদের জন্য এগুলো করতেন?

উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তারা শুধু জানতেনই না, এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িতও ছিলেন।

অনেকে মনে করেন যে কাদির খান শুধু অর্থের জন্যই এসব করতেন। তবে বিষয়টা অত সহজ নয়। কারণ পাকিস্তান সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গেই কাজ করতেন তিনি। তিনি চাইতেন, পরমাণু শক্তিধর পশ্চিমা দেশগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে দিতে।

পাকিস্তানের পরমাণু বিজ্ঞানী আবদুল কাদের খান। ফাইল ছবি: রয়টার্স

কেন শুধু নির্দিষ্ট কারও কাছে পরমাণু বোমা থাকতে পারবে, অন্যদের কাছে থাকতে পারবে না- এই প্রশ্নই তুলেছিলেন কাদির খান।

আর এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমাদের ভণ্ডামি দেখতে পাওয়ার কথা বলতেন তিনি।

“আমি কোনো পাগলও নই, হেলাফেলার ব্যক্তিও নই। তারা আমাকে অপছন্দ করে, আর ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নানা কিছুর জন্য আমাকে দায়ী করে। কারণ আমি তাদের গোপন কৌশল ফাঁস করে দিয়েছি।”

যুক্তরাজ্যের এমআইসিক্স কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, সব সময়ই কাদির খানকে চোখে চোখে রাখত। তিনি কোথায় যান, কার সঙ্গে কথা বলেন, সেগুলোতে তো নজর রাখতই, তার ফোনেও আড়ি পাতত।

তার নেটওয়ার্কে ঢুকতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থও খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ‍ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা।

“আমরা তার বাড়িতে ঢুকেছি, তার কর্মস্থলে ঢুকেছি, এমনকি তার কক্ষেও,” একজন সিআইএ কর্মকর্তা এমনই বলবেন।

২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর সন্ত্রাসীদের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র চলে যাওয়ার শঙ্কাটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। তখন কাদির খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া হয়েছিল।

২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি যখন নিজ দেশের পরমাণু কর্মসূচি বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখনই এমআইসিক্স ও সিআইএ এজেন্টরা সেই দেশে ওই অভিযানে গিয়েছিল। ওই মিশন কাদির খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পাকিস্তানকে চাপ বাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে কাজ করে।

এরপর পারভেজ মুশাররফ সরকার কাদির খানকে গৃহবন্দি করেন এবং দোষ স্বীকার করে ক্যামেরার সামনে এসে বিবৃতি দিতেও বাধ্য করেন। 

এরপর কাদির খানের জীবন কেটেছে অদ্ভুতভাবে, পুরোপুরি মুক্তও ছিলেন না তিনি, আবার পুরোপুরি বন্দিও ছিলেন না। অন্য কোনো দেশে যাওয়া কিংবা কারও সঙ্গে কথা বলাও ছিল নিষিদ্ধ। ফলে কাদির খানের পুরো গল্পটি হয়ত কখনই জানা যাবে না।