মত প্রকাশের লড়াইয়ে শান্তির নোবেল পেলেন সাংবাদিক মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ

ফিলিপিন্স আর রাশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে শাসকের রোষের মুখে পড়া দুই সাংবাদিক পাচ্ছেন এবারের শান্তির নোবেল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2021, 09:14 AM
Updated : 8 Oct 2021, 04:26 PM

নরওয়ের নোবেল ইন্সটিটিউট শুক্রবার অসলোতে এক সংবাদ সম্মেলনে ১০২তম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ফিলিপিন্সের মারিয়া রেসা এবং রাশিয়ার দিমিত্রি মুরাতভের নাম ঘোষণা করে।

নোবেল কমিটির প্রধান বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসেন বলেন, গণতন্ত্র আর টেকসই শান্তির অন্যতম পূর্বশর্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে লড়াইয়ে ‘সাহসী’ ভূমিকার জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে তাদের।

“বিশ্বে গণতন্ত্র আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যখন ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে; তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যারা এই আদর্শের জন্য লড়াই করে চলেছেন, সেই সকল সাংবাদিকের প্রতিনিধিত্ব করছেন মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভ।”

১৯৩৫ সালে জার্মান সাংবাদিক কার্ল ফন ওজিয়েতস্কির পর এই প্রথম কোনো সাংবাদিককে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বেছে নিল নরওয়ের নোবেল কমিটি।

বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসেন বলেন, “মুক্ত, স্বাধীন, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হল ক্ষমতার অপব্যবহার, মিথা আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ “

নোবেল পুরস্কারের এক কোটি সুইডিশ ক্রোনা সমান ভাগে ভাগ করে নেবেন রেসা আর মুরাতভ।

 

কী করেছেন তারা?

নোবেল কমিটি বলেছে, এবারের পুরস্কারজয়ী মারিয়া রেসা মত প্রকাশের স্বাধীনতার শক্তিকে ব্যবহার করেছেন তার দেশ ফিলিপিন্সে ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারের মুখোশ উন্মোচনে।

২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত ফিলিপিন্সের ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানি র‌্যাপলারের সহপ্রতিষ্ঠাতা রেসা এখনও এই অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

“একজন সাংবাদিক এবং র‌্যাপলারের সিইও হিসেবে রেসা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষের একজন নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে,” বলেছে নোবেল কমিটি।

প্রেসিডেন্ট রদরিগো দুতার্তের শাসনামলে ফিলিপিন্সের বিতর্কিত মাদকবিরোধী অভিযানের হত্যার ঘটনাগুলো তুলে ধরতে সাহসী ভূমিকা নেয় র‌্যাপলার।

নোবেল কমিটি বলেছে, “নিহতের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে ওই মাদকবিরোধী অভিযান নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের রূপ পেয়েছিল। তাছাড়া ভুয়া খবর ছড়াতে, সরকারবিরোধীদের নাজেহাল করতে, জনমতকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রভাবিত করতে কীভাবে সেখানে সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাও তুলে ধরেছেন রেসা এবং র‌্যাপলার।“

এক সাক্ষাৎকারে ৫৮ বছর বয়সী রেসা বলেছিলেন, সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে নামা হল পাগলামি। আমি সেটা করতে চাইনি। কিন্তু আমার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সেটাই আমাকে করতে হয়েছে।”

গতবছর ফিলিপিন্সে এক মামলায় মারিয়া রেসাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। ওই মামলাকে ফিলিপিন্সের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য একটি পরীক্ষা হিসেবে দেখেন অনেকে।

প্রথম ফিলিপিনো হিসেবে শান্তিতে নোবেল জয়ের পর র‌্যাপলারের সরাসরি সম্প্রচারে এসে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মারিয়া রেসা বলেন, তিনি ‘অভিভূত’।

“এটা দেখালো, প্রকৃত ঘটনা ছাড়া কিছুই সম্ভব না… বাস্তব চিত্র ছাড়া একটি পৃথিবী মানে সত্য আর বিশ্বাসহীন একটি পৃথিবী।”

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভের পর সাংবাদিক দিমিত্রি মুরাতভ হলে প্রথম রুশ নাগরিক, যিনি শান্তিতে নোবেল পেলেন।

৫৯ বছর বয়সী মুরাতভ দেশটির অনুসন্ধানী সংবাদপত্র নোভায়া গেজেটার প্রধান সম্পাদক। গর্ভাচেভ ১৯৯০ সালে তার নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। সেই টাকায় কেনা একটি কম্পিউটার এখনও পত্রিকাটির অফিসে প্রদর্শনী হিসেবে রাখা আছে।

সোভিয়েতের পতনের পর নতুন রাশিয়ায় যে আশাবাদ নিয়ে নোভায়া গেজেটা যাত্রা শুরু করেছিল, তা উবে যেতে সময় লাগেনি। ১৯৯৯ সালে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সমালোচক আর বিরোধী মতকে ক্রমাগত কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতেও মুরাতভ এবং নোভায়া গেজেটা মুক্তমতের পক্ষে লড়াই করে গেছেন। ক্রেমলিনের দুর্নীতি এবং অনিয়মের খবর তারা প্রকাশ করে গেছেন।

কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস এর তথ্য অনুযায়ী, নোভায়া গেজেটার অন্তত ছয়জন সাংবাদিককে প্রাণ দিতে হয়েছে সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে।

নোবেল জয়ের খবরে টেলিগ্রাম চ্যানেল পডিয়মে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুরাতভ বলেন, তিনি এটা প্রত্যাশাই করেননি।

এই নোবেল পুরস্কারকে তিনি বর্ণনা করেন রাশিয়ার নিষ্পেষিত সাংবাদিকতার ‘জবাব’ হিসেবে।

 

কেন তারা?

সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের শেষ ইচ্ছা অনুসারে গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবতার কল্যাণে অবদানের জন্য প্রতি বছর চিকিৎসা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, সাহিত্য, শান্তি ও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

তার উইলে শান্তি পুরস্কার পাওয়া যোগ্যতা হিসেবে তিনটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হল দেশে দেশে ঐক্য প্রতিষ্ঠা, নিরস্ত্রীকরণে সাফল্য এবং শান্তি সম্মিলনে উদ্বুদ্ধ করা।

ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার লড়াইয়ে ভূমিকার জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিকে গতবছর নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। 

বিবিসি লিখেছে, চলতি বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ৩২৯ জন ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠানের মনোনায়ন পেয়েছিল নোবেল কমিটি। অধিকার সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পাশাপাশি পরিবেশ আন্দোলনের তারকা হয়ে ওঠা সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গের নামও সেই তালিকায় ছিল।

নরোয়েজিয়ান নোবেল কমিটি কেন মারিয়া রেসা ও দিমিত্রি মুরাতভকে পুরস্কারের জন্য বেছে নিল, সেই ব্যাখ্যায় বেরিট রেইস- অ্যান্ডারসেন বলেন, নোবেল কমিটি বিশ্বাস করে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহই পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণের সঠিক ধারণা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। 

“গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে এবং যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে সুরক্ষা দিতে হলে আগে এসব অধিকার নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এসব মৌলিক আধিকার রক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার জন্যই এবার মারিয়া রেসা এবং দিমিত্রি মুরাতভকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।”

নোবেল কমিটি বলছে, “আজকের এই সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর মুক্ত সংবাদপত্র ছাড়া দেশে দেশে মৈত্রী, নিরস্ত্রীকরণ কিংবা বিশ্বজুড়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে সফলভাবে এগিয়ে নেওয়া কঠিন। সুতরাং এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারে যে ঘোষণা, তা আলফ্রেড নোবেলে ইচ্ছার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।”

বরাবরের মতই চিকিৎসা বিভাগের পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে গত সোমবার চলতি বছরের নোবেল মৌসুম শুরু হয়। পরের তিন দিনে ঘোষণা করা হয় পদার্থবিদ্যা, রসায়ন আর সাহিত্যের নোবেল।

আগামী ১১ অক্টোবর অর্থনীতিতে এবারের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। আর আগামী ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে বিজয়ীদের দেওয়া হবে পুরস্কার।