প্যান্ডোরা পেপার্স: গোপন সম্পদের সাম্রাজ্য গড়েছেন জর্ডানের বাদশাহ

জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসেইন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ৭ কোটি পাউন্ডের (১০ কোটি ডলার) গোপন সম্পদের এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বলে উঠে এসেছে প্যান্ডোরা পেপার্সে ফাঁস হওয়া তথ্যে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2021, 09:33 AM
Updated : 4 Oct 2021, 09:33 AM

এসব আর্থিক নথিতে বাদশাহর মালিকানাধীন কয়েকটি অফশোর কোম্পানির একটি গোপন নেটওয়ার্ককে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ১৫টি বাড়ি কিনেছেন দ্বিতীয় আবদুল্লাহ।

ফাঁস হওয়া ওই তথ্যের বরাতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ম্যালিবু এবং যুক্তরাজ্যের অ্যাসকট ও লন্ডনে এসব বাড়ি কিনেছেন বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ।

তবে বাদশাহর আইনজীবীরা বলছেন, ব্যক্তিগত সম্পদ ব্যবহার করেই তিনি এসব বাড়ি কিনেছেন এবং এ ক্ষেত্রে অফশোর কোম্পানিকে কাজে লাগানোয় ‘অনুচিত’ কিছু ঘটেনি।  

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ (আইসিআইজে) প্রথমে এসব নথি হাকে পায়। ১১৭টি দেশের সাড়ে ছয়শর বেশি সাংবাদিক সেসব নথি বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে এখন ধারাবাহিকভাবে তথ্য প্রকাশ করছেন। এর নাম দেওয়া হয়েছে প্যানডোরা পেপার্স।

৯৫ হাজার অফশোর ফার্মের ফাঁস হওয়া এই ১ কোটি ২০ লাখ গোপন নথি থেকে বিশ্ব নেতা, রাজনীতিবিদ এবং ধনকুবেরদের গোপন সম্পদ এবং লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে আসছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন দেশ থেকে মোটা অংকের আন্তর্জাতিক সহায়তা পায় জর্ডান। তাদের বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তা দেওয়া দেশগুলোর একটি যুক্তরাজ্য। জর্ডানকে দেওয়া সহায়তা তহবিল দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২০১৯ সালে ৬৫ কোটি পাউন্ড দিয়েছিল যুক্তরাজ্য।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহকে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে নমনীয় সম্পর্ক রাখতে দেখা যায়। তবে নিজ দেশে তার বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিযোগ রয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট ছাঁটাই এবং কর বাড়ানোর প্রতিবাদে দেশটিতে বিক্ষোভও হয়েছে।

প্যান্ডোরা পেপার্সে দেখা যাচ্ছে, সম্পদের প্রতি জর্ডানের বাদশাহর আকাঙ্ক্ষা প্রবল হয়েছে ২০০৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিনি ওয়াশিংটন ডিসির ব্যয়বহুল এলাকা জর্জটাউনে চারটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন।

১ কোটি ৬০ লাখ ডলার ব্যয়ে এসব অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সঙ্গে সে সময়ে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করা ক্রাউন প্রিন্স হুসেইনের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে ধারণা দেওয়া হয়েছে।  

কোথায় আছে জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহর গোপন সম্পদ?

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বাদশাহর আটটি গোপন সম্পত্তির তথ্য এসেছে প্যান্ডোরা পেপার্সের ফাঁস হওয়া নথিতে।

এর মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসির অভিজাত এলাকা কেনসিংটন এবং বেলগ্রেভিয়া স্ট্রিটে ছয়টি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যের সারে কাউন্টির অ্যাসকটে দুটি বাড়ি এবং ওয়াশিংটন ডিসির জর্জটাউনে রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট।

জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল-হুসেইন। ফাইল ছবি

ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যালিবুর পয়েন্ট ডিউম পেনিনসুলায় সাত বেডরুমের কোটি ডলারের একটি বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে পর্বত চূড়ায় প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে মুখ করে।

ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা স্যার অ্যান্থনি হপকিন্স, অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস, টিভি ব্যক্তিত্ব সায়মন কাউয়েল, মডেল ও সংগীত শিল্পী গিনেথ প্যালট্রো, চলচ্চিত্র পরিচালক অভিনেত্রী ও সংগীত শিল্পী বারব্রা স্ট্রাইস্যান্ড।

২০১৪ সালে নাবিস্কো হোল্ডিংস এসএ নামে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসের একটি কোম্পানির মাধ্যমে ওই বাড়িটি রেকর্ড দামে কেনা হয়।

পরে ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে আলাদা দুটি কোম্পানি ওই সম্পত্তির দুটি পৃথক অংশ ৬ কোটি ৮০ লাখ ডলারে কিনে নেয়।

প্যান্ডোরা পেপার্সের নথি অনুযায়ী ওই তিন কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করে পানামার একটি ল ফার্ম। আর এর সবগুলোর মালিকানায় রয়েছেন জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ।

‘আপনি জানেন তিনি কে’

বাদশাহ আবদুল্লাহ তার এসব সম্পদের মালিকানার তথ্য গোপন রাখতে পেরেছিলেন কারণ তিনি এসব কেনার ক্ষেত্রে অফশোর কোম্পানিগুলোকে ব্যবহার করেছিলেন।

এসব কোম্পানিতে যাদের নেওয়া হয়েছিল তারা বাদশাহর পরিচয় গোপন রাখার বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ একটি নথিতে বাদশারকে বোঝাতে লেখা হয়েছে- ‘আপনি জানেন তিনি কে’। 

তবে আর্থিক স্বচ্ছতার জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের ফলে বাদশাহ আবদুল্লাহকে সমস্যায় পড়তে হয়। ২০১৭ সালে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে পাস হওয়া একটি আইনে সেখানকার সব কোম্পানির মালিককে সরকারের অভ্যন্তরীণ রেজিস্ট্রারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়।

একটি নথিতে দেখা যায় ‘বেনেফিশিয়াল ওনারশিপ সিকিউর সার্চ সিস্টেম অ্যাক্ট’ নামে ওই আইনটি কার্যকর হওয়ার আট মাস পরও আবদুল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু অফশোর কোম্পানি তাদের বিস্তারিত তথ্য কর্তৃপক্ষকে দেয়নি।

জনগুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকার পরও রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে নিজের পরিচয় প্রকাশ করেননি জর্ডানের বাদশাহ। দুর্নীতিবিরোধী আইন অনুযায়ী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই শর্ত পূরণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

তবে বাদশাহর আইনজীবীরা বলছেন, তার সম্পদের এসব তথ্য সঠিক এবং হালনাগদ নয়। তাদের দাবি, বিদেশে আবদুল্লাহর সব সম্পত্তি তার ব্যক্তিগত সম্পদের মাধ্যমে অর্জিত। সেখান থেকে জর্ডানের জনগণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে তহবিলও দেওয়া হয়।

তারা বলছেন, অফশোর কোম্পানিগুলো বাদশাহর সম্পদ গোপন করার জন্য ব্যবহার করা হয়নি। সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার জন্য এমন কর্পোরেট কাঠামো একটি ‘প্রচলিত’ ব্যবস্থা।  

বাদশাহার আইনজীবীরা বলছেন, তাদের ব্যপস্থাপনায় “পেশাদার কর্মীদের মাধ্যমে দৈনন্দিন পরিচালনায় সকল আইনি এবং আর্থিক বাধ্যবাধকতা মেনে চলা হয়, যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক আইনি বিষয়গুলোও রয়েছে।  

আরও পড়ুন