প্যান্ডোরা পেপার্স: যেভাবে ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর এড়িয়েছেন ব্লেয়াররা

লন্ডনে অফিস খোলার জন্য ৬৪ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডের একটি ভবনের মালিক হয়েছিলেন ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং তার আইনজীবী স্ত্রী শেরি; কিন্তু সেজন্য স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড তাদের দিতে হয়নি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Oct 2021, 05:48 AM
Updated : 4 Oct 2021, 05:58 AM

গত চার বছর ধরে গোপন থাকা এই খবর বেরিয়ে এসেছে বিশ্ব নেতাদের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য ফাঁস করে দেওয়া প্যান্ডোরা পেপার্সে।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্লেয়ার দম্পতি ২০১৭ সালে লন্ডনের ওই ভবন কিনেছিলেন শেরির ব্যবসার অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।

আসলে তারা সরাসরি ওই ভবন কেনেননি। ওই ভবনের মালিকানা ছিল একটি অফশোর কোম্পানির হাতে, আর সেই কোম্পানিকে কিনে নিয়েছিল ব্লেয়ারদের খোলা আরেকটি ব্রিটিশ কোম্পানি।

তাতে ওই অফশোর কোম্পানি বিলুপ্ত হয় এবং সেই কোম্পানির সব সম্পত্তি চলে আসে ব্লেয়ারদের ব্রিটিশ কোম্পানির হাতে।  

ব্রিটেনে জমি কিংবা বাড়ি কিনতে গেলে কর দিতে হয়, কিন্তু কোম্পানি কিনলে স্ট্যাম্প ডিউটির কোনো বালাই নেই। ফলে ওই ভবন কেনার জন্য প্রযোজ্য ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ডের কর তাদের দিতে হয়নি।

ব্যারিস্টার শেরি ব্লেয়ার বলেছেন, ওই ভবন যদি তারা বিক্রি করতে চান, কেবল তখনই তাদের লাভের ওপর ওই কর দিতে হবে। 

ওই ভবনের মালিকানা যে অফশোর কোম্পানির হাতে ছিল, তার পেছনে ছিল বাহরাইনের একটি রাজনৈতিক পরিবার। অবশ্য দুপক্ষই দাবি করেছে, কেনাবেচার কাজটা কাদের সাথে হচ্ছে সেটা শুরুতে তারা জানতেন না।

শেরি ব্লেয়ার বলেছেন, ভবনটি কেনার ক্ষেত্রে মর্টগেজ দেখানো হয়েছে তাদের যৌথ আয় ও মূলধন। এই লেনদেনে তার স্বামীর সম্পৃক্ততা কেবল এটুকুই।

বিবিসি লিখেছে, ২০০৭ সালে ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়ার পর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছে ব্লেয়ার দম্পতি। লন্ডনের ওই অফিস কেনার আগেই ৩৮টি ফ্ল্যাট বা জমি কেনার পেছনে ৩ কোটি পাউন্ড তারা বিনিয়োগ করেছেন বলে তথ্য রয়েছে।

প্যানডোরা পেপার্স কী

ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপার্স, পানামা পেপার্স এবং লাক্সলিকসের ধারাবাহিকতায় এবার ৯৫ হাজার অফশোর ফার্মের ১ কোটি ২০ লাখ গোপন নথি ফাঁস হয়েছে, যাতে বেরিয়ে আসছে বিশ্ব নেতা, রাজনীতিবিদ এবং ধনকুবেরদের গোপন সম্পদ এবং লেনদেনের তথ্য । বলা হচ্ছে গোপন আর্থিক নথি ফাঁসের সবচেয়ে বড় ঘটনা এটি।

অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ (আইসিআইজে) এসব নথি হাতে পায়। ১১৭টি দেশের সাড়ে ছয়শর বেশি সাংবাদিক সেসব নথি বিশ্লেষণ ও তদন্ত করে ধারাবাহিকভাবে এখন তথ্য প্রকাশ করছেন।

এসব নথিতে মোট ৩৫ জন রাষ্ট্র নেতার তথ্য মিলেছে। আছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরা। তাদের মধ্যে কেউ এখনও পদে বহাল, কেউবা সাবেক। ৯০টির বেশি দেশের মন্ত্রী, বিচারক, মেয়র, মিলিটারি জেনারেলসহ তিনশর বেশি কর্মকর্তার হাঁড়ির খবরও রয়েছে এর মধ্যে।

এছাড়া রয়েছে শতাধিক বিলিয়নেয়ারের গোপন সম্পদের তথ্য; তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী এবং ক্রীড়া ও বিনোদন জগতের তারকারাও।

গোপন নথি ফাঁসের সবচেয়ে বড় এই ঘটনা আবারও মেলে ধরেছে চোখের সামনে থাকা অর্থনীতির আড়ালের চিত্র, যেখানে অফশোর অর্থনীতিতে বিশ্বের ধনকুবেররা তাদের সম্পদ লুকিয়ে রাখেন, কর না দিয়ে কিংবা নামমাত্র কর দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েন।

প্যান্ডোরা পেপার্স: বিশ্ব নেতাদের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য ফাঁস

পানামা পেপার্স: বেনামি সম্পদে কর ফাঁকির সহজ পাঠ

পানামা পেপার্স কেবল ‘গল্পের অর্ধেক’

  যাদের গোমর ফাঁস করল প্যারাডাইস পেপারস  

২০১৭ সালে ব্লেয়ার দম্পতির হাতে আসা মার্লেবোনের হারকোর্ট স্ট্রিটের চার তলা ওই ভবন এখন শেরির আইনি পরামর্শক ফার্ম ওমনিয়া স্ট্র্যাটেজি এবং তার ফাউন্ডেশনের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

ফাঁস হওয়া প্যানডোরা পেপার্সে দেখা যাচ্ছে, ওই ভবনের মালিকানা ছিল রোমানস্টোন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি অফশোর কোম্পানির হাতে, যারা ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত।

রোমানস্টোন ইন্টারন্যাশনালের মালিকানা আবার ছিল ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিবন্ধিত আরেক কোম্পানির হাতে, যার শেয়ার হোল্ডাররা আল জায়ানি পরিবারের সদস্য। বাহরাইন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য ও পর্যটন মন্ত্রী জায়েদ রশিদ আল জায়ানি তাদের একজন। 

ফাঁস হওয়া নথি বলছে, রোমানস্টোন ইন্টারন্যাশনালকে কিনে নেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি কোম্পানি গঠন করেন ব্লেয়ার দম্পতি। সেই কোম্পানিতে তাদের দুজনের মালিকানা সমান- ৫০ শতাংশ করে। বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর রোমানস্টোন ইন্টারন্যাশনাল নামের সেই অফশোর কোম্পানি বিলুপ্ত হয়। 

আর এই প্রক্রিয়ায় সম্পত্তির মালিকানা হাতবদল হওয়ায় ওই জমি ও ভবনের জন্য প্রযোজ্য স্ট্যাম্প ডিউটি ব্লেয়ার দম্পতিকে দিতে হয়নি। অর্থাৎ, আইন না ভেঙেই ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ডের কর তারা বাঁচিয়ে ফেলেছেন।

প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় কর আইনের এসব ফাঁক নিয়ে বেশ উচ্চকণ্ঠ ছিলেন টনি ব্লেয়ার। একবার তিনি বলেছিলেন, বিদ্যমান কর ব্যবস্থাই অনিয়মের সুযোগ করে দিচ্ছে। 

১৯৯৪ সালে লেবার পার্টির নেতা হওয়ার পর প্রথম ভাষণে তিনি বলেছিলেন, কোটিপতিরা হিসাবপত্র ঠিক দেখিয়ে কিছুই দিচ্ছেন না, অথচ পেনশনারদের জ্বালানি তেল কিনতে ভ্যাট দিতে হচ্ছে।

“অফশোর কোম্পানিগুলো কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে, অথচ বাড়ির মালিকদের বীমার প্রিমিয়ামে ভ্যাট দিতে হচ্ছে। আমরা এমন একটি কর ব্যবস্থা গড়তে চাই যা হবে ন্যায্য, যেখানে সামর্থ্য অনুযায়ী কর দিতে হবে।”