আঙ্গেলা মের্কেলের উত্তরসূরি বেছে নিতে রোববার নির্বাচন হল জার্মানিতে। এ নির্বাচনে ভোটারদের তালিকায় এমন অনেক তরুণ আছেন, যারা মের্কেল ছাড়া অন্য কোনো চ্যান্সেলরের কথা মনেও করতে পারেন না।
গুণমুগ্ধরা বলছেন, মধ্য ডানপন্থি একটি দলের নেতা হলেও মের্কেলের আমলেই জার্মানি রক্ষণশীলতার বৃত্ত ভেঙে খানিকটা উদারনৈতিক পথে হাঁটতে পেরেছে, শরণার্থী সমস্যাসহ একাধিক সংকটময় মুহূর্তে ইউরোপকে দিতে পেরেছে নেতৃত্ব।
তবে সমালোচকরা বলছেন, সুযোগ থাকার পরও মের্কেল অনেক কিছুই করেননি; সমাজ সংস্কারের বদলে ক্ষমতা যেন হাতছাড়া না হয়- সেদিকেই তার নজর ছিল বেশি।
হেলমুট কোলের পর সবচেয়ে বেশি সময় জার্মানির সরকারপ্রধান পদে থাকা মের্কেলের অর্জন বা ব্যর্থতা কী কী, ইতিহাস তাকে কীভাবে মনে রাখবে- বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে ডয়েচে ভেলে, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও বিবিসির কয়েকটি প্রতিবেদনে।
মের্কেল বেড়ে উঠেছেন পূর্ব জার্মানিতে, মা ছিলেন শিক্ষক, বাবা প্রোটেস্টান যাজক। ছাত্রজীবনে পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, পরে কোয়ান্টাম রসায়নে পিএইচডি করেন, তার ‘রোল মডেল’ ছিলেন বিজ্ঞানী মেরি কুরি।
দুই জার্মানির একত্রীকরণের পর বেশ কয়েকটি দল ঘুরে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নে (সিডিইউ) থিতু হন মের্কেল, এরপর তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার উপরে উঠতে থাকেন তরতরিয়ে।
নিজেকে তিনি বেশি জাহির করতেন না, কথার চেয়েও বেশি মনোযোগী ছিলেন কাজে, তার কাছে বেশি প্রাধান্য পেত বাস্তব পরিস্থিতি ও তথ্য। এসব কারণে খুব একটা চোখে পড়তেন না আলাদা করে। ফলে অন্যদের তুলনায় মের্কেলের মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি বলেই মনে করেন বয়সেন।
তার মতে, এই যে ‘খাটো করে দেখা’ এটাই শাপেবর হয়ে উঠেছে মের্কেলের জন্য। কেবল জার্মান রাজনীতিতেই নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও মের্কেল এ বিষয়টিকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পেরেছেন, অনেকটা তাকে যার ছায়া বলা হয়, সেই কোলের মতই।
কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক ম্যাট কিউভোরট্রাপ বলেন, “জার্মান রাজনীতিকে তিনি নীতি নিয়ে আলোচনায় বসাতে পেরেছেন। তিনি তার নিজের মত করে জার্মান রাজনীতি ও বিশ্ব রাজনীতিতে খানিকটা বিপ্লবও নিয়ে এসেছেন। যখন রাজনীতি বিভিন্ন মেরুতে আরও বেশি বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে, তিনি তা প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন।”
টানা ১০ বছর ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীর আসনে থাকা মের্কেল নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতীকীভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। দলে, সরকারে, এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে নারীদের বসানোর ক্ষেত্রে রেখেছিলেন দৃঢ় ভূমিকা।
ক্যামেরার সামনেই ইতালির একসময়ের প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বেরলুসকোনি তাকে অপেক্ষায় রেখেছিলেন; জার্মান চ্যান্সেলরের চেয়েও বেরলুসকোনি তখন বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন একটি ফোন কলকে।
মের্কেল কুকুর ভয় পান জেনেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এক বৈঠকে তার বিশালদেহী কুকুর নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ একবার সম্মতি না নিয়েই মের্কেলের কাঁধ মাসাজ করে দিয়েছিলেন।
‘সেক্সিজম’ এবং ‘পুরুষের উদ্ভট আচরণ’ সামলানোয় দক্ষতার কারণে মের্কেল পরে বিশ্বজুড়ে নারীদের বিপুল সম্মান পেয়েছেন। ২০১৭ সালে জি২০ সম্মেলনে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলার সময় তার চোখের অভিব্যক্তি বিশ্ব গণমাধ্যমের নজর কেড়ে নিয়েছিল।
পুরুষরা প্রাধান্য বিস্তার করছে- বিশ্বনেতাদের এমন মঞ্চেও মের্কেল শেষ পর্যন্ত ঠিকই নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। তবে সবসময়ই যে তিনি নারী-পুরুষ সমান অধিকার নীতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তেমনও নয়।
“কারণ তিনি পুরুষদের ভোটেও নির্বাচিত হতে চাইতেন,” বলেছেন বয়সেন।
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, মের্কেলের দলটি হল মধ্য ডানপন্থি রক্ষণশীদের দল, যাদের আলোচ্যসূচির সঙ্গে নারীবাদের দূরত্ব অনেক। আর ক্ষমতায় থাকতে হলে দলের সমর্থনও তার জন্য জরুরি।
রক্ষণশীল সিডিইউর মের্কেলের আমলেই জার্মানিতে সমলিঙ্গে বিয়ের স্বীকৃতি মিলেছে।
অবশ্য এতকিছুর পরও জার্মানিতে নারীদের অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন না।
গ্রিন পার্টির সাংসদ ফ্রাঞ্জিসকা বার্টনার বলেন, “তিনি ছিলেন প্রথম নারী চ্যান্সেলর। তার যে ক্ষমতা, প্রভাব, তাতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে কার্যকর লড়াই, নারীদের আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য অর্থায়ন, জার্মানিতে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী বোর্ডে নারীদের শক্তিশালী উপস্থিতির জন্য আরও অনেক কিছুই তিনি করতে পারতেন।”
মের্কেলের আমলে জার্মান সরকারে প্রভাবশালী পদে তুলনামূলক বেশি নারী দেখা গেছে। বিদেশে বিভিন্ন সফরেও তাকে নারী অধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে দেখা গেছে। নাইজারে তিনি নারীদের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় নারী শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছেন।
“জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এমনকি জার্মানিতেও আমি তাকে নারী-পুরুষ সমতার বিষয়গুলোতে বড় ধরনের চাপ প্রয়োগ করতে দেখিনি,” বলেছেন গ্রিন পার্টির এ সাংসদ।
ইউরোপের বিভিন্ন সংকটকালে মের্কেলের দৃঢ়তা তাকে বিশ্বনেতাদের শ্রদ্ধা এনে দিয়েছে। ইউরো সংকটের সময় গ্রিসকে ঋণ পরিশোধে সময় বাড়িয়ে দেওয়া, ২০০৮-এ দক্ষ হাতে মন্দা সামলানো, ২০১৫ সালে সিরীয় শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খোলা রাখা- সবই তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকাই প্রথম’ নীতির কঠোর সমালোচনা, রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাসচুক্তি বহাল রাখতে তার দৃঢ়তা জার্মান মধ্যবিত্তের কাছে তাকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। শেষবেলায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় তার নানা পদক্ষেপও পেয়েছে প্রশংসা।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, নারী হয়েও যে একটি দেশকে নেতৃত্ব দেওয়া যায়, সংকট দক্ষতার সঙ্গে সামলানো যায়- তা দেখানোই সম্ভবত মের্কেলের সবচেয়ে বড় ‘লিগেসি’।
“যখন একটি মেয়ে বলে যে সে মন্ত্রী, এমনকি চ্যান্সেলর হতে চায়, তা শুনে এখন আর কেউ হাসে না,” ২০১৮ সালে মের্কেল নিজেও এমনটাই বলেছিলেন।
আজ যখন তার বিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত, তখন তিনি বিশ্বজুড়ে অনেক নারীর কাছেই ‘রোল মডেল’।
বহুদিন বাদে, ক্ষমতার শেষবেলায় নিজেকে ‘নারীবাদী’ হিসেবেও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “আমাদের সবারই নারীবাদী হওয়া উচিত।”