তালেবানের কাবুলে জীবন যেমন

কাবুলের রাস্তায় যেখানে সাদা কাপড়ে কালো আরবি হরফ অঙ্কিত তালেবান পতাকা দেখা যাবে, সেখানে থামতে হবে। এটা এখন নিয়ম।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Sept 2021, 03:27 AM
Updated : 6 Sept 2021, 08:02 AM

সেই চেকপোস্টে একটি হলুদ ট্যাক্সি থামল, পেছনের আসনে দেখা গেল এক আফগান তরুণীকে, একা!

চেকপোস্টে দায়িত্বরত তালেবান গার্ড তাকে প্রশ্ন করলেন- “মাহরাম ছাড়া কেন আপনি একা একা বাইরে বেরিয়েছেন?”

মাহরাম হল পুরুষ অভিভাবক। তালেবানি নিয়মে, কোনো পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কোনো নারী একা বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না।  

কাঁধে রাইফেল ঝোলানো সেই তালেবান গার্ড তখন সেই নারীকে বললেন, তিনি যেন তার স্বামীকে ফোন করেন।

কিন্তু সেই নারী জানালেন, তার কোনো ফোন নেই।

সেই গার্ড তখন আরেকটি খালি ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে তাতে তুলে দিলেন সেই নারীকে। চালককে বলা হল, ওই নারীর বাড়ি যেতে হবে এবং তার স্বামীকে সেখান থেকে নিয়ে আবার আসতে হবে। তালেবানের নিয়ম মেনে তবেই কাবুলে চলাফেরা করা যাবে।

তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তিন সপ্তাহ হয়ে গেল। আফগানিস্তান ছেড়ে চলে গেছে বিদেশি বাহিনী, সেই সঙ্গে রাজনীতিবিদ আর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনেকেও দেশ ছেড়েছেন।

যাদের যাওয়ার সুযোগ নেই, সেই আফগানরা তালেবান শাসনে কেমন আছেন এখন? এক প্রতিবেদনে সেই চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কাবুলে বিবিসির প্রধান আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক লাইজ ডুসে।

ছবি: বিবিসি

কাবুলের রাস্তায় এখনও আগের মতই ভিড় আর যানজট লেগে থাকে। ঠেলাগাড়িতে করে ফেরি করতে দেখা যায় আঙুর, কুল আর বিভিন্ন খাবার। প্রায় ছেঁড়া জোব্বা পড়ে বাচ্চা ছেলেরা ভিড়ের মধ্যে ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করে।

লাইজ ডুসে লিখেছেন, বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে, এ শহর বুঝি আগের মতই আছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়।

আফগানিস্তানের রাজধানী এখন চলছে তালেবানের ফতোয়া দিয়ে। আর তা বাস্তবায়নে রাস্তায় রাস্তায় আছে অস্ত্রধারী যোদ্ধারা।

অগাস্টের শেষে মার্কিন বাহিনী কাবুল ত্যাগ করার পর কট্টর ইসলামিক গোষ্ঠী তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ যখন সংবাদ সম্মেলনে এসেছিলেন, যুদ্ধসাজে থাকা সশস্ত্র যোদ্ধারা তাকে ঘিরে ছিল। 

তালেবান সদস্যদের উদ্দেশে মুজাহিদ বলেছিলেন, “মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহারে তোমরা সতর্ক থাকবে। মনে রাখবে, এ জাতি অনেক ভুগেছে। সব সময় থাকবে ভদ্র।”

তবে কিছু কথা বলে দিতে হয় না। বিস্ময়কর দ্রুততায় আফগানিস্তান দখল করে নিয়ে তালেবান বাহিনী গত মাসে যখন কাবুলে ঢুকল, আফগানরা তখনই বুঝে নিয়েছিল, দ্বিতীয় দফা তালেবানি শাসনে তাদের কোন কোন নিয়ম মেনে চলতে হবে।

পুরুষেরা দাড়ি কামানো বন্ধ করে দিলেন। নারীদের রঙিন স্কার্ফের জায়গা নিল সর্বাঙ্গ ঢাকা কালো বোরখা।

তবে সামনের দিনগুলোতে আসলে কী হবে, তার কিছুই তাদের জানা নেই।

মরিয়ম রাজাঈর সব স্বপ্ন যেন শেষ হয়ে গেছে। ছবি: বিবিসি

স্বপ্নভঙ্গ

বিবিসির সাংবাদিক লাইজ ডুসে লিখেছেন, কাবুলে আফগান সরকারের প্রতিরোধ যখন ভেঙে পড়ল, তার ফোনে এবং মেসেজিং অ্যাপগুলোতে পরিচিত আফগানদের কাছ থেকে একের পর এক বার্তা পেতে থাকলেন তিনি। প্রায় সবারই এক প্রশ্ন। এখন কী করা উচিত? কীভাবে দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব? সবাই পরামর্শ চাইছিলেন মরিয়া হয়ে। 

মরিয়ম রাজাঈ জানতেন, তাকে কী করতে হবে।

১৫ অগাস্ট তালেবান যোদ্ধারা যখন কাবুলে ঢুকছে, আফগান অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে নারী আইন কর্মকর্তাদের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা চালাচ্ছিলেন তিনি।   

প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া তরুণ আইনজীবীরা শুরুতে কর্মশালা চালিয়ে যাওয়ার কথা বললেও দ্রুত সেই ক্লাস খালি হয়ে যায়। এর পর এখন এক সেইফ হাউজ থেকে আরেক সেইফ হাউজে ঘুরছেন রাজাঈ। দুই শিশু সন্তান আর পরিবারের সদস্যরাও তার সঙ্গে। 

তার তিন বছরের মেয়ে এখনই বলতে শুরু করেছে যে বড় হয়ে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। যে মাটির ঘরে আপাতত তারা আশ্রয় নিয়ে আছে, তার এক কোনো শোভা পাচ্ছে রঙিন প্লাস্টিকের ব্লক দিয়ে শিশুটির বানানো বাড়ি।   

এবার আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর নিজেদের অনেকটা নমনীয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে তালেবান। কিন্তু তারা যখন বলে, ‘ইসলামের নিয়মের মধ্যে থেকে নারীদের সব অধিকারই’ তারা দেবে, তার অর্থ কারো কাছেই স্পষ্ট হয় না।   

রাজাঈ এবং তার মত আরও অনেক নারীকে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে, ‘অফিসে আর এসো না’। তাদের অনেকেরই শঙ্কা, যে জীবন তারা যাপন করে আসছিলেন, সেই জীবনে আর তাদের ফেরা হবে না। যে কাবুল ছিল তাদের শহর, সে শহরকে এখন আর নিজের মনে হয় না।

নিজের ইউনিভার্সিটির বইয়ের স্তূপের পাশে বসে রাজাঈ ধরে আসা গলায় বিবিসিকে বলেন, “লেখাপড়া করব, ভালো চাকরি করব, সমাজের উঁচু তলায় পৌঁছাব- এসব তো আমার অধিকার। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।” 

ব্রিটিশ দূতাবাস খালি করে সবাই চলে গেছে, আটকে আছেন আউটসোর্সিংয়ে কাজ করা আফগান কর্মীরা। ছবি: বিবিসি

‘বিশ্বাসঘাতকতা’

আফগানিস্তানে দুই দশক ধরে বিদেশিদের সম্পৃক্ততার ফলে অনেকের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তাদের জন্য জুটেছিল কাজ আর পরিচয়। সেই পরিচয় এখন তাদের গলার কাঁটা।

হামিদ ১৩ বছর ধরে কাবুলে ব্রিটিশ দূতাবাসে কাজ করেছেন প্রধান শেফ হিসেবে। সেই সময়ের অনেক মধুর স্মৃতি এখন তার মনে ভিড় করছে।

“আমার মনে পড়ে বড়দিনের পার্টিগুলোর কথা। দারুণ সব খাবার তখন আমরা রান্না করতাম। দারুণ আনন্দ হত সেইসব দিনে।”

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অনেক সনদ সে সময় পেয়েছেন হামিদ। সেইসব সনদ, মলিন হয়ে আসা ছবি আর পাঁচ শিশু সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে হামিদ বসে ছিলেন কার্পেটের ওপর।  

হামিদ এবং তার মত আরও ৬০ জন কর্মী ব্রিটিশ দূতাবাসে নিয়োগ পেয়েছিলেন এক কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে। যারা সরাসরি দূতাবাসের কর্মী ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই উড়াল দিয়েছিলেন তালেবান কাবুলে ঢোকার আগেই। কিন্তু পেছনে আটকা পড়ে থাকলেন সেই সব কন্ট্রাক্টর আর তাদের নিয়োগ দেওয়া কর্মীরা। 

হামিদ বলেন, “আমাদের খুব পরিশ্রম করতে হত। এমনকি কোভিডের লকডাউনের মধ্যেও আমরা কাজ করে গেছি। এখন যদি তারা আমাদের নিয়ে না যায়, সেটা হবে বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।”

বিবিসি লিখেছে, আর সব পশ্চিমা দেশের মত যুক্তরাজ্যও প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে যে তাদের সঙ্গে কাজ করা আফগানদের সহায়তা করার ‘উপায় খুঁজছে’ তারা। কিন্তু অনেকের জন্য পালানোর পথ খুঁজতে যাওয়াও এখন বিপজ্জনক।

তালেদান যোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপে বিবিসির সাংবাদিক লাইজ ডুসে। ছবি: বিবিসি

কথা আর কাজ

অনেকে যখন কাবুল ছাড়তে মরিয়া, অনেকে আবার শহরে ঢুকছে উৎফুল্ল মেজাজে।

তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে এসেছে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে। উরুজগান থেকে আসা একদল তালেবানের সঙ্গে বিবিসির লাইজ ডুসের কথা হয় যখন তিনি বিমানবন্দরে যাচ্ছিলেন।

ওই দলের সদস্য ২৫ বছর বয়সী রাফিউল্লাহ নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “বহু বছর আমি কাবুলে আসতে পারিনি।”

তার বয়সী অনেক শিক্ষিত আফগান তরুণ যে এখন স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে দেশ ছাড়ার চিন্তায়, সে কথা বলতেই রাফিউল্লাহ দিলেন শান্তির বার্তা।

“আমরা তো সবাই আফগান। আর আমাদের দেশ এখন শান্তি আর সমৃদ্ধির একটি শুভ পথেই যাবে।”

কাবুলের কিছু কিছু এলাকায় তালেবান যোদ্ধারা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। দড়জার কড়া নেড়ে তারা বলছে, সরকারি ফোন, গাড়ি বা মূল্যবান কিছু যদি থাকে, তা যেন হস্তান্তর করা হয়।

কখনও কখনও ব্যক্তিগত গাড়িও তালেবান জব্দ করছে এই যুক্তিতে যে, দুর্নীতি ছাড়া ওই গাড়ি কিনতে পারার কথা নয়।

কাবুলের পশ্চিমাংশের দাস্ত-ইবারসি এলাকায় সংখ্যালঘু হাজারা সম্প্রদায়ের বসবাস। সেখানে তালেবানের তল্লাশি চালানোর আর পুরুষদের ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর আসছে।

লাইজ ডুসে লিখেছেন, এমন পরিস্থিতির মধ্যেও কোনো কোনো নারী কাবুলের কেন্দ্রভাগে চাকরিতে যাচ্ছেন মরিয়া হয়ে। তালেবান যোদ্ধাদের তারা বলছেন, তারা কাজ না করলে পরিবারের উপার্জনের আর কোনো পথ নেই। 

কাবুলে ব্যাংকের বাইরে দীর্ঘ লাইন। ছবি: রয়টার্স

‘এসব কি সত্যি?’

কাবুলের বেশিরভাগ ব্যাংক শাখাই বন্ধ, অনেক শাখায় টাকাও নেই।  যেগুলো খোলা আছে, সেখানে টাকা তুলতে আসা মানুষের কিউ দীর্ঘ হতে হতে রাস্তায় গিয়ে ঠেকছে।

ওই ভিড়ের মধ্যে একজন বললেন, গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন তিনি আসছেন, যদি কিছু টাকা তোলা যায়, এই আশায়।  

“কিন্তু পরিস্থিতি যা দেখছি, এটা হল উল্টোপথে যাত্রার নতুন সূচনা।”

কিন্তু কাবুল থেকে বহু দূরের প্রত্যন্ত গ্রামে অনেক আফগান স্বস্তি প্রকাশ করছেন এই ভেবে যে আমেরিকান জঙ্গি বিমানগুলো শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানের আকাশ ছেড়ে গেছে।

ক্ষুধা আর নিদারুণ দারিদ্র্যের সঙ্গে যাদের বসবাস, সেই লাখ লাখ আফগানের জীবনে তালেবান আসার আগের আর পরের দিনগুলোর তেমন কোনো তফাত নেই।  

এটা হল তেমন এক সময়, যখন পুরনো নিয়মের জায়গা নেয় নতুন নিয়ম। সেরকম নতুন নিয়ম প্রতিদিনই তালেবানের তরফ থেকে উপহার দেওয়া হচ্ছে।

ফ্রিল্যান্স আফগান সাংবাদিক আহমেদ মংলি বিবিসির সাংবাদিক লাইজ ডুসেকে বলেন, “এই যে ইতিহাস, এটা কি আসলে সত্যি? আমি এখন যা দেখছি, তা তো বিশ্বাস হতে চায় না।”

২০ বছর আগে মার্কিন বাহিনীর অভিযানে তালেবান উৎখাত হওয়ার পর কাবুলে কাজ শুরু করেছিলেন মংলি।

২০ বছর পরের তালেবানকে দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তাদের মুখপাত্র মিডিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইছেন। আর তাদের সদস্য সবার হাতে দেখুন একটা করে অস্ত্র আছে। সবাই নিজেকে রাজা ভাবছে।

“আমি জানি না, কতদিন আমি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যেতে পারব। কিন্তু আমি এই ইতিহাসের অংশ হতে চাই।”

কাবুলের দেয়াল থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে সব ধরনের ছবি

লাইজ ডুসে লিখেছেন, আফগানিস্তানের ইতিহাসে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে, সূচনা হয়েছে নতুন আরেকটি অধ্যায়ের। দীর্ঘ সাদা গাউন আর টকটকে লাল লিপস্টিকে বধূসাজে যে নারীদের ছবি এতদিন বিলবোর্ডে শোভা পেত, সেগুলোর ওপর এখন কালো আলকাতরা লেপে দেওয়া হয়েছে।  

একদল শিল্পী শহরের দেয়ালে দেয়ালে প্রচুর ম্যুরাল এঁকেছিলেন এক সময়। সাহসী সাংবাদিক, পেশার জন্য জীবন উৎসর্গ করা চিকিৎসক আর দীর্ঘ যুদ্ধের পর শান্তির প্রতীক্ষার ছবি তারা এঁকেছিলেন। সেসব দেয়াল এখন চুনকাম করে ফেলা হয়েছে।   

এইত গতবছর দোহায় তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তি চুক্তি হল। সেই ঘটনার স্মরক হিসেবে একটি ম্যুরাল আঁকা হয়েছিল সাদা আর কালো রঙে। মুছে ফেলা হয়েছে সেই ছবিটাও।

কবিরাও যেন এখন আর ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।

বিবিসির সাংবাদিক লাইজ ডুসে লিখেছেন, মাসুদ খালিলি নামে তার এক পুরনো আফগান বন্ধু আছেন, যিনি বহু বছর বহু যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এক ছত্র শের তিনি পাঠিয়েছেন সম্প্রতি।

“ভাগ্য বিধাতা গতরাতে এলেন, বললেন কানে কানে, আমাদের ভাগ্যলিপি শুধু কান্না-হাসির খেলা।”