অর্থনীতি নিয়ে ‘টালমাটাল’ তালেবান

অর্থ সঙ্কটে আফগানিস্তানে মানবিক সঙ্কট দেখা দেওয়ার হুঁশিয়ারির মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আর দেশ পরিচালনার চেষ্টায় হিমশিম খাচ্ছে তালেবান।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Sept 2021, 07:19 AM
Updated : 2 Sept 2021, 07:19 AM

ঝড়ো গতিতে তালেবানের কাবুল দখলের মধ্য দিয়ে ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্রের সব সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পড়েছে এই উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী।

রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে প্রশাসনিক শূন্যতার মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে এবং নগদ অর্থ তুলে নেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোতে ভিড় করছেন আফগানবাসী।

ভারী অস্ত্রে সজ্জিত তালেবান যোদ্ধারা রাজধানী দখলে রাখলেও বিদেশি নাগরিক এবং পশ্চিমা বাহিনীকে সহায়তা করা আফগান নাগরিকরা দেশ ছাড়ার পর হাসপাতাল এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তর চালু রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে। 

দেশটির ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় জড়িতরা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো কার্যকর একটি অর্থ ব্যবস্থাপনা চাইছে। তালেবানের নিয়োগ দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন প্রধান এ বিষয়ে আশ্বস্ত করলেও তহবিল সরবরাহের বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি।

কাতার ভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশনের খবরে বলা হয়, সম্প্রতি অচল হয়ে পড়া কাবুল বিমানবন্দর ফের চালু করার জন্য তালেবানের অনুরোধে কাতারের কারিগরী বিশেষজ্ঞরা সেখানে পৌঁছেছেন।

তালেবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি বলেছেন, আফগানিস্তানে কিছু দিনের মধ্যে তিনি নতুন একটি ‘ঐকমত্যের সরকার’ আশা করছেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড জানিয়েছেন, তালেবানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আফগানিস্তানে যে সরকারই গঠিত হোক, তারা যাতে লাভবান না হয় সে ব্যবস্থা করে কীভাবে দেশটিতে সহায়তা দেওয়া যায় তার উপায় খুঁজে দেখবে যুক্তরাষ্ট্র।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি

আফগানিস্তানে এখন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। দেশটির জরুরিভাবে অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু দেশের বাইরে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জব্দ হওয়া ১০০ কোটি ডলারে সহসাই হাত দিতে পারছে না তালেবান।

ব্যাংকগুলো আবারও খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও নগদ অর্থ তোলার ক্ষেত্রে কঠোরভাবে সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

‘আফগানিস্তান ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশন’ এবং অন্যান্য অর্থদাতাদের সঙ্গে এ সপ্তাহেই বৈঠকে বসেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিস।

বৈঠকে যোগ দেওয়া দুজন ব্যাংক কর্মকর্তা গভর্নর হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিসকে উদ্ধৃত করে বলেন, “অর্থসঙ্কট এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে একটি সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছে তালেবান।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “তারা খুবই চমৎকার আচরণ করেছেন এবং ব্যাংকগুলোর কাছে তাদের আশঙ্কার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন।”

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে, অর্থের মূল্য কমে যাচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে এবং অনেক দপ্তর এবং দোকান বন্ধ রয়েছে।

কাবুলের বাসিন্দা জেলগাই বলেন, “এখন সব কিছুর জন্যই চড়া দাম দিতে হচ্ছে, প্রতিদিনই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।”

সেবা সংগঠনগুলো সতর্ক করেছে রাজধানীর বাইরে চাষিরা তীব্র খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ শহরে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এ বিষয়ে কার সঙ্গে আলোচনা করবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছে বিদেশি দাতারা।  

বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আহ্বান জানিয়ে তালেবান কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন সরকার গঠন হলে এসব সমস্যা কেটে যাবে।

নগদ অর্থ তুলে নিতে ব্যাংকের বাইরে আফগান নাগরিকদের ভিড়। ছবি রয়টার্স

আফগানিস্তানের বাইরে থাকা ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞরা দেশ ছেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হবে।

একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, “আমি জানি না তারা এটা কীভাবে চালাবে। কারণ ব্যবস্থাপনায় থাকা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সকল কারিগরী কর্মী দেশে ছেড়ে গেছেন।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, তালেবানের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে কোনো তাড়াহুড়ো করা উচিত না।

দেশটিতে ২০ বছরের যুদ্ধকালীন সময়ে বিদেশি সেনাদের সঙ্গে কাজ করা সকল আফগান নাগরিককে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে তালেবান। তবে বাস্তবে তা কতটা হবে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের।

রয়টার্স লিখেছে, তালেবানের শাসনে ভয়ে থাকা আফগানবাসী সীমান্ত এলাকাগুলোতে ছুটছেন।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার পর আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ায় আফগানিস্তানে বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানে ক্ষমতা হারিয়েছিল তালেবান।

এর পর থেকে প্রত্যন্ত ও পাহাড়ি এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে আফগান বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বের বিদেশি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে তালেবান যোদ্ধারা।

পশ্চিমা সেনা প্রত্যাহারের সুযোগে দুই দশক পর তারা দেশের বেশিরভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিলেও পানশির প্রদেশ এখনও দখল করতে পারেনি। সোভিয়েত-বিরোধী মুজাহিদিন কমান্ডার আহমাদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমাদ মাসুদের নেতৃত্বে স্থানীয় সশস্ত্র যোদ্ধা এবং সাবেক সেনা দলের কিছু ইউনিট পানশির প্রদেশে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।

বুধবার তালেবানের ঊর্ধ্বতন নেতা আমির খান মোত্তাকি তাদের অস্ত্র ছেড়ে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন।

পানশিরের আফগানদের উদ্দেশে রেকর্ড করা এক ভাষণে তিনি বলেন, “ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান সব আফগানের আবাসস্থল।”

তালেবানের পক্ষ থেকে আফগান নাগরিককে বাড়ি ফিরে দেশ পুনর্গঠনে সহায়তার আহ্বান জানানো হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষাসহ তালেবানের আগের সরকারের চেয়ে ‘নরম’ অবস্থানের কথাও বলা হয়েছে। তবে তারা এটাও বলেছে, তালেবান শাসনে সবকিছু শরিয়া আইনেই হবে।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর কট্টর ‘শরিয়া আইনে’ পরিচালিত তালেবান সরকারের আমলে নারীদের শিক্ষা এবং চাকরিতে নিষিদ্ধ ছিল।