চলে গেলেন সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ

কোভিড থেকে মুক্ত হলেও নানা স্বাস্থ্য জটিলতায় অবশেষে হার মানলেন মাধুকরী আর সবিনয় নিবেদনের মত উপন্যাসের লেখক কথা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2021, 03:34 AM
Updated : 30 August 2021, 02:02 PM

আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, এক মাস ধরে যে হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল, দক্ষিণ কলকাতার সেই বেলভিউ হাসপাতালেই রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বুদ্ধদেব গুহ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। 

৮৫ বছর বয়সী এ লেখক গত ৩১ জুলাই থেকে বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রক্তচাপ কমে যাওয়ায় ৩ অগাস্ট তাকে হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়।

এ বছরের এপ্রিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। ভাইরাস থেকে মুক্তি মিললেও কোভিড পরবর্তী নানান জটিলতা ভোগাচ্ছিল তাকে।

হাসপাতালে ভর্তির পর শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার পাশাপাশি বুদ্ধদেবের মূত্রনালীতেও সংক্রমণ ধরা পড়ে। তার লিভার ও কিডনিতেও সমস্যা থাকার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা।

দ্বিতীয় দফা হাসপাতালে ভর্তির পর বুদ্ধদেবের কোভিড পরীক্ষা করে তার দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি মেলেনি। দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভোগা বুদ্ধদেব গুহর বয়সজনিত আরও নানা জটিলতা ছিল।

তবে চিকিৎসকরা মূত্রনালীর সংক্রমণকেই ‘মূল সমস্যা’ ধরে চিকিৎসা চালাচ্ছিলেন। রক্তস্বল্পতাও তাকে ভোগাচ্ছিল। তাকে মিনিটে দুই লিটার করে অক্সিজেনও দিতে হচ্ছিল সে সময়।

এপ্রিলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর কলকাতার একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। পরে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩৩ দিনের লড়াইয়ের পর ভাইরাসমুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বাংলাদেশেও জনপ্রিয় এ কথা সাহিত্যিক।

বুদ্ধদেব গুহর স্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ঋতু গুহ ২০১১ সালে মারা যান। দুই মেয়ে রেখে গেছেন এই দম্পতি।

তাদের বড় মেয়ে মালেনি বি গুহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাবার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে এক বার্তায় লিখেছেন, “বুদ্ধদেব গুহ আর নেই। ২০২১ সালের জন্মষ্টমীর রাতে ভগবান তাকে ফিরিয়ে নিয়েছেন।”

১৯৩৬ সালের ২৯শে জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করা বুদ্ধদেব গুহর শৈশব কেটেছে বাংলাদেশের বরিশাল ও রংপুরে। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা পরে তার নানা লেখায় এসেছে।

অসাধারণ লেখনী আর নিজস্ব দৃশ্যকল্প দিয়ে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে নিজের জায়গা গড়ে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। তার লেখার একটি বড় এলাকাজুড়ে আছে অরণ্য, প্রকৃতি আর প্রেম।

আনন্দবাজার লিখেছে, “গত কয়েক দশকে বিশ্ব সাহিত্যে ‘ইয়ং অ্যাডাল্ট’ নামে এক বিশেষ ধারা পরিলক্ষিত। এই ধরনের সাহিত্য ‘ইয়ং’-দের ‘অ্যাডাল্ট’ হয়ে ওঠার সহায়ক। আবার পরিণত পাঠকও কৈশোরে ফিরে যেতে চাইলে এমন সাহিত্যে ডুব দিতে পারেন। বাংলায় এমন ধারার অস্তিত্ব সে অর্থে বিরল। যে ক’জন হাতে গোনা সাহিত্যিক সেই রাস্তায় হেঁটেছেন, বুদ্ধদেব তাদের মধ্যে অন্যতম।”

ইউরোপ, আমেরিকা, পূর্ব এশিয়া আর পূর্ব আফ্রিকার বহু দেশ দেখা বুদ্ধদেব গুহ পূর্ব ভারতের বন আর বনের জীবন দেখেছেন খুব কাছ থেকে। সেই বন জীবনের ছায়া দৃশ্যমান তার লেখার ছত্রে ছত্রে।

বুদ্ধদেব গুহর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘জঙ্গল মহল’। এরপর ‘মাধুকরী’, ‘কোজাগর’, ‘অববাহিকা’, ‘বাবলি’, ‘বাসনাকুসুম’, ‘পরিযায়ী’, হলুদ বসন্ত, খেলা ঘর, নগ্ন নির্জন, জলছবির মত বহু উপন্যাস তিনি উপহার দিয়েছেন পাঠকদের।

পাশাপাশি কিশোর সাহিত্যেও ছিল অবাধ বিচরণ। বহু কিশোর-কিশোরীর কাছে এখনও প্রিয় তার সৃষ্ট ‘ঋজুদা’ বা ‘ঋভু’ চরিত্র।

আনন্দ পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বুদ্ধদেব গুহ। তার লেখা 'বাবা হওয়া' এবং 'স্বামী হওয়া'কে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে পুরস্কারজয়ী বাংলা সিনেমা 'ডিকশনারি'।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে লেখাপড়া করা বুদ্ধদেব গুহ পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। ধ্রুপদী সংগীত আর ছবি আঁকাতেও তার দক্ষতা ছিল।

আনন্দবাজার লিখেছে, “এই মুহূর্তে হয়তো বৃষ্টি পড়ছে পলাশতলি অথবা মাসাইমারায়। ঋজুদা আর ঋভুর সঙ্গে এক নৌকায় সওয়ার তাদের স্রষ্টা বুদ্ধদেব। প্রেক্ষিতে তারই গলায় বাজছে নিধুবাবুর গান ‘ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে’। চারপাশ ঝাপসা হয়ে আছে তার আঁকা রহস্যমাখা নিসর্গচিত্রের মতোই।

“অরণ্য পেরিয়ে হতে চাওয়া জীবনকে সঙ্গে নিয়ে, না হতে পারার বেদনাকে সঙ্গে নিয়ে পাঠকও যাত্রী সেই অভিযানে। আর অভিযান যে কখনও ফুরোয় না, তা বুদ্ধদেবের মতো লেখক জানতেন।”