তালেবান যোদ্ধাদের দাবি, তাদের ১৫ জনের জন্য খাবার রান্না করে দিতে হবে।
নাজিয়া বলেছিলেন, “আমি গরিব মানুষ। এতজনের খাবার কীভাবে দেব?”
জবাব এল একে-৪৭ রাইফেলে।
“তারা রাইফেলের কুঁদো দিয়ে আমার মাকে মারতে লাগল, তিনি পড়ে গেলেন,” বললেন মানিজা। মাকে ঠেকাতে গেলে তাকেও ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়।
“তারপর তারা একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারল আমাদের ঘরের আরেকটি কক্ষের দিকে, আগুন জ্বলে উঠল, ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। আমার মা সেই যে পড়লেন, আর উঠলেন না, সেখানেই তার মৃত্যু হল।”
এই ঘটনা গত ১২ জুলাই আফগানিস্তানের উত্তর সীমান্তবর্তী প্রদেশ ফারিয়াবের একটি গ্রামের।
দুই দশক পর তালেবানের পুনরুত্থানের সূচনা পর্বের এই ঘটনা এখন তুলে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএন।
এক মাসের মধ্যে রাজধানী কাবুল দখল করে আফগানদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার আসনে আবার বসেছে তালেবান।
রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নিয়ে মঙ্গলবার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আসা তালেবান নেতারা বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
দলটির মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, “কেউ কারও বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়বে না, জানতে চাইবে না যে, আগে কার হয়ে সে কাজ করেছে। তারা সবাই নিরাপদ থাকবে। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ বা ধরার চেষ্টা এখানে হবে না।”
দুই দশক আগে গোঁড়া ইসলামী দলটি যখন আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা নারীদের বাইরে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল, মেয়ে শিশুদের স্কুলে যাওয়াও করেছিল বন্ধ।
আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয়ও দিয়েছিল তালেবান; যার পরিণতিতে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানে তাদের উৎখাত হতে হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ফেরত যাওয়ার লগ্নে একেক করে আবার দেশের চারদিকের শহরগুলোর দখল নিতে শুরু করে তালেবান। শেষে রোববার কাবুলও তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
কারও উপর কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না কিংবা কাউকে মারা হবে না- এমন প্রতিশ্রুতি দিলেও কাবুল বিমানবন্দরে জীবনবাজি রেখে উড়োজাহাজে উঠে পালানোর চেষ্টা কিংবা পাকিস্তান সীমান্তে ঢল আফগানদের ভয়টিই প্রকট করে দেখাচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র বলেছেন, তারা আর যুদ্ধ চান না। আফগানিস্তানের মাটি থেকে অন্য কোনো অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বিনষ্টের কাজও হতে দেবেন না।
জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেছেন, নারীদের অধিকার রক্ষায়ও তারা কাজ করবেন। তবে তা শরিয়া আইন অনুযায়ী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের যেতে কিংবা বাইরে কাজ করতেও বাধা থাকবে না।
আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবাইকে নিয়েই করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তালেবান মুখপাত্র।
২০ বছর পর নিজেদের আগের অবস্থানের অনেক কিছু বদলে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি তালেবানের এই সংবাদ সম্মেলনে এলেও এর প্রতিফলন বাস্তবে ঘটবে কি না, তাদের গত কয়েকদিনের তৎপরতায় তা নিয়ে সংশয়ের সুরই ফুটে উঠেছে সিএনএনের প্রতিবেদনে।
আফগানিস্তানে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ২০০৯ সালে যে আইন হয়েছিল, তা ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
আফগান পার্লামেন্টের সাবেক নারী সদস্য ফারজানা কোচাই বলেন, “আমি আসলেই জানি না, সামনের দিনগুলোতে কী হবে। আমাদের একটি পার্লামেন্ট থাকবে কি না, সেটাও বুঝতে পারছি না।”
নারী হিসেবে নিজেকে নিয়েও ভয়ে আছেন তিনি। তিনি বলেন, “আমাদের নারীদের চাকরি থাকবে কি না, আমরা স্বাধীনভাবে বাইরে বের হতে পারব কি না- তা নিয়েই সবাই কথা বলাবলি করছে এখন।”
কাবুল দখলের পর এক রকম বললেও সম্প্রতি অন্যান্য প্রদেশ দখলের পর তালেবান যা করেছে, তার মিল নেই আফগানিস্তানের হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্যে।
সংস্থাটি বলছে, বিভিন্ন শহরে মেয়েদের পুরুষ ছাড়া বাইরে বের হতে মানা করেছে তালেবান। স্কুলে মেয়েদের বোরকা পরিয়েছে, শিক্ষকদের বলেছে দাড়ি রাখতে।
তালেবানরা কাবুল ঘিরে ফেলার পর নান রুটির দোকানি গুল মোহাম্মদ হাকিম বলছিলেন, “এখন আমার প্রথম কাজ হচ্ছে দাড়ি রাখা, কীভাবে এগুলোকে দ্রুত বাড়ানো যায়, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আছি। আর স্ত্রী ও মেয়েদের জন্য যথেষ্ট বোরকা আছে কি না, তাও দেখে রাখেছি।”
তালেবান আসার খবরে বোরকার দর হু হু করে বাড়তে থাকে কাবুলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, তিনি বোরকা কিনতে পারেননি। ঘরে দুটি বোরকা আছে, সেগুলোই পরিবারের সবাইকে ভাগ করে পরতে হবে।
লার্ন নামে একটি সংস্থার কর্ণধার পাস্তানা দুররানি, তার সংস্থাটি শিক্ষা ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে।
তিনি বলেন, “আফগানিস্তানেরই পতন হয়েছে। তাই আমি কেঁদেছি। আমি এতটাই কেঁদেছি যে চোখের জল শুকিয়ে গেছে। আমি কোনো আশা দেখছি না।”
দুররানি বলেন, তালেবান নারী শিক্ষার কথা এখন বললেও কোন শিক্ষা তা কিন্তু স্পষ্ট করেনি। ধরে নেওয়া যায় ধর্মীয় শিক্ষার কথাই তারা বলছে, তাহলে নারী-পুরুষ সমতার শিক্ষার কী হবে? নারীদের কারিগরি শিক্ষার কী হবে?
“আপনি যদি এটা চিন্তা করেন, তাহলে আর কোনো আশা দেখবেন না। আপনাকে হতাশার সাগরেই ডুবতে হবে,” বলেন এই নারী।
গত ২০ বছরে স্কুলগামী আফগান মেয়ের সংখ্যা প্রায় কোটির কাছাকাছি পৌঁছেছে। অনেক নারী কর্মক্ষেত্রে সফল। এই সময় বড় ধাক্কা হয়ে তালেবান শাসন এলেও আফগান নারীদের পরিত্যাগ না করতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
আফগান নারীদের সবাই এখন সেই ভয়ে আছে, কখন ঘরে টোকা পড়ে, নাজিয়ার মতো।
নাজিয়ার মেয়ে মানিজা জানান, মায়ের মৃত্যুর পর আর নিজের বাড়ি ফেরেননি তিনি। এখন যেখানে থাকছেন, সেখানেও ঘর থেকে বের হন না।
“পুরুষ আত্মীয় ছাড়া কোনো মেয়েকে বের হতে দেয় না তালেবান। পুরুষরাই শুধু একাকী বাইরে যেতে পারে।”
“ঘরবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের একবার যুদ্ধ করতে হয়েছে, আবারও কি করতে হবে?” বলেন এক নারী।