ঝটিকা অভিযানে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর প্রথমবার সংবাদ সম্মেলনে এসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ‘শান্তির’ বার্তা দিল কট্টর ইসলামী গোষ্ঠী তালেবান, সেই সঙ্গে জানালো, তাদের শাসনে নারীরা স্বাধীনতা পাবে ‘শরিয়া আইন অনুযায়ী’, তাদের ‘নিয়ম মেনে’ সংবাদমাধ্যমও মুক্তভাবে কাজ করতে পারবে।
Published : 17 Aug 2021, 09:36 PM
বিশ্বকে চমকে দিয়ে অতি দ্রুত কাবুল দখল করে ফেলার দুদিন পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীতে এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন তালেবান নেতারা।
তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “আমরা এটা স্পষ্ট করতে চাই, আফগানিস্তান আর কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়। যারাই এতদিন আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সবাইকে আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি। শত্রুতর দিন শেষ হয়েছে। দেশের ভেতরে বা বাইরে- কোথাও কোনো শত্রু আমরা চাই না।”
গত ২০ বছর ধরে নেপথ্যে থেকে তালেবানের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে আসা জাবিউল্লাহ মুজাহিদ এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেই প্রথমবার ক্যামেরার সামনে এলেন।
দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মী আর ক্যামেরার সামনে তিনি বলেন, “২০ বছর সংগ্রামের পর দেশকে আমরা মুক্ত করতে পেরেছি, বিদেশিদের বহিষ্কার করেছি। পুরো জাতির জন্য আজ একটি গৌরবের মুহূর্ত।”
সন্দেহ আর সংশয় নিয়ে আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে থাকা বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে তালেবান মুখপাত্র বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তারা আশ্বস্ত করতে চান যে, কারও কোনো ‘ক্ষতি করা হবে না’।
“আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় যেতে চাই না।”
পাশাপাশি তিনি এও বলেন, “আমাদের ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলার অধিকার আমাদের আছে। অন্য দেশের দৃষ্টিভঙ্গি, নিয়ম আর আইন অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু নিজেদের মূল্যবোধের ভিত্তিতে নিজেদের নিয়মকানুন তৈরি করে নেওয়ার অধিকার আফগানিস্তানের আছে।”
রয়টার্স লিখেছে, সংবাদ সম্মেলনে যে বার্তা তালেবান দিল, তাতে ভবিষ্যতের রূপরেখা নিয়ে বিস্তারিত খুব বেশি না থাকলেও দুই দশক আগের তালেবান শাসনের সঙ্গে তুলনা করলে এবার তাদের সুর অনেকটা নরম।
আর এমন এক সময়ে তালেবান এই সংবাদ সম্মেলন করল, যখন পশ্চিমা দেশগুলো তাদের কূটনীতিকদের কাবুল থেকে সরিয়ে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে, পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে তারা কীভাবে সাড়া দেবে।
বিশেষ করে উদ্বেগ রয়েছে আফগান সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে, কেননা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তালেবান শাসনামলে মেয়েদের শিক্ষা বা চাকরির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। পুরুষের লিখিত অনুমতি নিয়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা বোরখা পরে, তবেই নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারত।
শরিয়া আইনের নামে দোররা বা চাবুক মারা, হাত-পা কেটে নেওয়া এবং প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলানো বা পাথর ছুড়ে হত্যার মত শাস্তি ছিল সেসব দিনের নিয়মিত ঘটনা।
সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র বলেন, “শরিয়া আইন অনুযায়ী নারীদের অধিকার রক্ষায় আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ। তারাও আমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, কোনো বৈষম্য এখানে হবে না।”
নারীদের শিক্ষা আর কাজের স্বাধীনতা নিয়ে পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “আমাদের কাঠামোর মধ্যে থেকেই নারীদের শিক্ষা আর কাজ করার সুযোগ আমরা দেব। আমাদের সমাজে নারীরা হবে খুবই সক্রিয়, সেটা আমাদের নিয়মের মধ্যে থেকেই হবে।”
Zabibullah Mujahid, the taliban’s behind-the-scenes voice for nearly 20 years, appearing for first time in front of a house packed of Afghanistan’s vibrant media (one of biggest achievements of past 20 years) pic.twitter.com/0mZrN5CkRF
— Mujib Mashal (@MujMash) August 17, 2021
তালেবানের এই সংবাদ সম্মেলনের পর জাতিসংঘের মুখপাত্র স্তেফান দুজারিক নিউ ইয়র্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, “বাস্তবে কী ঘটে, সেটা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমার মনে হয়, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তারা কী করছে সেটা আমাদের আগে দেখতে হবে।”
আগের তালেবান আমলে গান শোনা বা কোনো প্রাণীর ছবি আঁকা বা তোলা কিংবা ভিডিও করা ছিল নিষিদ্ধ। ছবির খোঁজে কাবুলের বইয়ের দোকানগুলোতে সে সময় নিয়মিত অভিযান চালানো হত। ফলে সাংবাদিকদের কাজ করাও হয়ে উঠেছিল প্রায় অসম্ভব।
মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমের কাজ নিয়েও ‘আশ্বস্ত’ করার চেষ্টা করেছেন জাবিউল্লাহ মুজাহিদ।
তিনি বলেন, বেসরকারি গণমাধ্যম আফগানিস্তানে ‘মুক্ত ও স্বাধীনভাবে’ তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। তবে সবাইকেই তালেবানের ‘সাংস্কৃতিক কাঠামো’ মেনে চলতে হবে।
“গণমাধ্যমের কাজের কথা যখন আসবে, কোনো কিছুই ইসলামী মূল্যাবোধের বিরুদ্ধে যাওয়া চলবে না।
“আপনারা যারা সংবাদমাধ্যমে আছে, আমাদের সীমাবদ্ধতা আপনারা ধরিয়ে দেবেন, যাতে আমরা জাতির সেবা করতে পারি। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করা গণমাধ্যমের উচিত হবে না। দেশের ঐক্যের জন্যই তাদের কাজ করা উচিত।”
তালেবান মুখপাত্র তার বিভিন্ন কথায় এটা বেশ স্পষ্ট করেছেন, তারা যাই করবেন, সেটা ‘ইসলামী আইনেই’ হবে। তবে তার ভাষায়, দুই দশক আগের তালেবান আর এখনকার তালেবান ‘এক নয়’।
“আমাদের দেশ একটি মুসলিম দেশ। সেটা ২০ বছর আগেও ছিল, এখনও তাই আছে। কিন্তু যদি অভিজ্ঞতা, পরিপক্কতা আর আগামীর দর্শনের কথা বলেন, তাহলে অবশ্যই ২০ বছর আগের আমাদের সঙ্গে এখনকার আমাদের অনেক পার্থক্য আছে। আমরা যা করতে যাচ্ছি, সেখানেও এই পার্থক্যটা থাকবে।”
নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে নাইন ইলেভেনের হামলার পর আল কায়েদা জঙ্গিদের নির্মূল করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহুজাতিক বাহিনী ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যে অভিযান চালিয়েছিল, তাতেই তালেবান শাসনের পতন ঘটেছিল।
জবাবে তালেবান মুখপাত্র বলেন, “আফগানিস্তানের মাটি অন্যের ওপর হামলার জন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমরা এ বিষয়ে আশ্বস্ত করতে পারি।”
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দেন, দীর্ঘ দুই দশকের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে তার দেশের সৈন্যরা ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান ছেড়ে যাবে।
এরপর আর দেরি করেনি তালেবান, মে মাসেই সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং অতি দ্রুত দেশের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নিয়ে গত ১৫ অগাস্ট তারা রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করে। বিদেশি কূটনীতিকদের মত আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানিও পালিয়ে যান।
হাজার হাজার আতঙ্কিত আফগান উদ্বাস্তূ হয়ে দেশ ছাড়তে শুরু করে। তালেবান কাবুলে পৌঁছানোর পর দেশ ছাড়তে মরিয়া আফগানদের ভিড়ে নজিরবিহীন দৃশ্যের অবতারণা হয় বিমানবন্দরে।
দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে মঙ্গলবারই তালেবান সব সরকারি কর্মচারীর জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেছিল।
আফগানিস্তানে এর আগে যারা বিদেশিদের হয়ে ঠিকাদার ও দোভাষীর কাজ করেছে, তাদের ক্ষেত্রে তালেবানের ভূমিকা কী হবে, সেই প্রশ্ন সংবাদ সম্মেলনে করেছিলেন সাংবাদিকরা।
উত্তরে তালেবান মুখপাত্র বলেন, “কারো প্রতিই আমরা প্রতিশোধ নেব না। যে তরুণরা এখানে বেড়ে উঠেছে, আমরা চাই না তারা চলে যাক। তারা আমাদের সম্পদ।
“কেউ কারও বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়বে না, জানতে চাইবে না যে, আগে কার হয়ে সে কাজ করেছে। তারা সবাই নিরাপদ থাকবে। কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ বা ধরার চেষ্টা এখানে হবে না।”
জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, আফগানিস্তানের ‘স্থিতিশীলতা আর শান্তির জন্য’ সবাইকে তারা ‘ক্ষমা’ করে দিয়েছেন।
“আমাদের যোদ্ধা, আমাদের সমর্থক, সবাই আমরা এটা নিশ্চিত করব, যাতে সমাজের সব পক্ষই আমাদের সাথে থাকে।”
তালেবান মুখপাত্র বলেন, তাদের শত্রুপক্ষের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে, সেটা ঘটেছে তাদের ‘নিজেদের দোষে’।
“মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে পুরো দেশ আমরা জয় করে নিয়েছি। সরকার গঠন হয়ে গেলে সবকিছুই আরও অনেক স্পষ্ট হয়ে যাবে।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সরকার যখন গঠন করা হয়ে যাবে, তখন আমরা ঠিক করব, কোন কোন আইন আমরা জাতিকে উপহার দেব।
“আমি শুধু বলে রাখতে চাই, সরকার গঠনের জন্য আমরা জোরেসোরে কাজ করছি। সেটা হয়ে গেলেই আপনারা ঘোষণা পাবেন। সব সীমান্ত এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে।”
যারা এখনও দেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের ভয় না পেয়ে বাড়ি ফেরার পরামর্শ দিয়ে জাবিউল্লাহ মুজাহিদ বলেন, “তাদের খারাপ কিছু ঘটবে না।”
তিনি দাবি করেন, কাবুলে কোনো বিশৃঙ্খলা হোক, তালেবান তা ‘চায়নি’। প্রাথমিকভাবে তাদের পরিকল্পনা ছিল, তাদের যোদ্ধারা শহরের প্রবেশ পথগুলোতেই অপেক্ষা করবে, যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া ‘মসৃণভাবে’ হতে পারে।
“কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আগের সরকার এতটাই অযোগ্য ছিল যে,… তাদের নিরাপত্তা বাহিনী শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছুই করতে পারেনি। ফলে আমাদেরই তা করতে হয়েছে। বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই আমাদের শহরে প্রবেশ করতে হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে তালেবানের সুর যত নরমই হোক, বিরোধীদের মন তা বদলাতে পারেনি।
নিজেকে আফগানিস্তানের ‘বৈধ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান’ ঘোষণা করা ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরুল্লাহ সালেহ বলেছেন, তালেবানের কাছে তিনি মাথা নত করবেন না।
রয়টার্স লিখেছে, সালেহ বেশ জোর গলায় কথা বললেও তার পেছনে কতটা সমর্থন আছে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়।
নেটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, তালেবানের উচিত, যারা দেশ ছাড়তে চায়, তাদের সেই সুযোগ দেওয়া। তার ভাষায়, আফগানিস্তানে একটি টেকসই রাষ্ট্র গড়ে উঠুক, সেটাই নেটো চায়।
আফগানিস্তান যাতে আবারও সন্ত্রাসবাদের সূতিকাগার হয়ে না ওঠে, সে বিষয়েও তিনি সতর্ক করেছেন।
স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করা হয়ে গেলেও দূরবর্তী যে কোনো জায়গা থেকে সন্ত্রাসীদের ওপর আঘাত আনার ক্ষমতা এই জোটের আছে।