সেই সব কোভিড রোগীর করুণ গল্প, টিকা নিতে যাদের আপত্তি ছিল

লাস ভেগাসের বাসিন্দা মাইকেল ফ্রেডির আরও বহুদিন পাঁচ সন্তানের জন্য আলোর দিশারী হয়েই থাকার কথা ছিল। কিন্তু তার হৃদয় নিংড়ানো শেষ কথাটি আজীবন তাড়া করে ফিরবে তার সন্তানদের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2021, 05:47 AM
Updated : 5 August 2021, 06:47 AM

ফ্রেডির জীবনের শেষ উপলব্ধি ছিল: “আমার আসলে টিকা নেওয়াই উচিত ছিল।”

মাইকেল ফ্রেডির মত অনেকেরই এখন এভাবে জীবনের ইতি টানার কথা ছিল না। কিন্তু টিকা না নেওয়ার কারণে মর্মস্পর্শী সেই মৃত্যুকেই ডেকে আনছেন অনেকে।

করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনের প্রকোপে যুক্তরাষ্ট্রকে যখন নতুন করে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে, এরকম বহু মৃত্যু তখন কেবল শোক বাড়িয়ে চলেছে। সেই সব শোকগ্রস্ত পরিবারের কথা এক প্রতিবেদনে তুলে এনেছে সিএনএন।

আরকানসর স্বাস্থ্য সচেতন ৬৩ বছরের দাদিমা কিম ম্যাগিনও পারতেন নিজের সুখের সংসারকে আরও কটা বছর দেখে যেতে। তার মৃত্যুর পর মেয়ে র‌্যাচেল রোজারের মনে এখন শুধু আক্ষেপ। একজন নার্স হয়েও কেন যে তিনি মাকে টিকা নিতে রাজি করাতে পারলেন না!

র‌্যাচেল বলেন, “আমার রাগ লাগছে, মা কেন টিকা নিলেন না। আমার এখন অপরাধ বোধ হচ্ছে খুব, কেন আমি তাকে জোর করলাম না।”

কেন টিকা নেননি ম্যাগিন? তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার থাকলে তিনি আগেই হতে পারতেন!

কেবল মৃতদের স্বজনরাই যে গ্লানি আর শোকে পুড়ছেন তা নয়, সংক্রমিত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেওয়ার দীর্ঘ লড়াই শেষে সুস্থ হতে পারলেও নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যারা ভুগছেন, আক্ষেপ তাদেরও আছে।  

কোভিডের ভোগান্তি আর দুঃস্বপ্ন থেকে আত্মীয় পরিজন এবং নিজেকে রক্ষার জন্য টিকা নেওয়ার মত খুব সাধারণ কাজটি সময়মত না করায় এখন অনুশোচনা করছেন তাদের অনেকে।

ফ্লোরিডার বাসিন্দা আট সন্তানের মা গ্যানিনে স্টার্লিং জানালেন, হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ভয়াবাহ অভিজ্ঞতা মনে হলে এখনও তিনি শিউড়ে ওঠেন। তিনি স্বীকার করেন, লোকের কথায় তিনিও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন।

স্টার্লিং শুনেছিলেন, সরকার নাকি জোর করে মানুষের শরীরে পরীক্ষা ছাড়াই কি এক জিনিস ঢুকিয়ে দিচ্ছে!

“আমিও ওইসব মানুষের মতই মনে করতাম। যে ওষুধের বিষয়ে আমরা খুব বেশি কিছু জানি না, লোকজন সেটা কীভাবে শরীরে নেবে, সেটা আমার বিশ্বাস হত না।

“আর এখন আমার মনে হয়, এটা শুধুই একটা টিকা। আর এই টিকা নেওয়াই উচিত।… এই যে এত কিছু হল, টিকা নিলে এসব আমার কিছুই হয়ত হত না। ওই টিকা নিইনি বলে এখন আমার নিজেকে বোকা লাগে।”

অক্সিজেন মাস্ক পড়া অবস্থায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন স্বামীর বিছানার পাশে বসে ছিলেন মিসিসিপির বাসিন্দা অ্যালিসিয়া বল।

টিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে তাদের দেরি হয়ে গিয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার সবচেয়ে বড় শত্রুরও যেন এমনটা না হয়।” 

স্বজন হারানোর শোক

করোনাভাইরাসের মহামারীতে কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই মারা যান কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগে, সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময়।

এদের মধ্যে অনেকে আগে থেকে বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছিলেন, ফলে কোভিডের শিকারে পরিণত হয়েছেন সহজে।

আবার অনেকে আছেন, যারা এই করুণ পরিণতি ডেকে এনেছেন  করোনাভাইরাসকে আর সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য সরকার ও বিজ্ঞানীদের পরামর্শকে গুরুত্ব না দিয়ে।

সিএনএন লিখেছে, অনেকে বলেন, এ ধরনের অনেক মৃত্যুই হয়ত এখন এড়ানো সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে তা কঠিন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক লাখো মানুষ এখনও টিকার আওতার বাইরে।

টিকা নিয়ে যাদের অপত্তি, বা যারা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা নিয়ে সন্দিহান, যাদের একটি যুক্তি হল, কোভিডে আক্রান্তদের বেশিরভাগেরই তো মৃত্যু হয়নি, কিংবা গুরুতর অসুস্থও সবাই হননি। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রেও হয়ত সেই ‘সবচেয়ে খারাপ’ ঘটনাটি ঘটবে না।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (সিডিসি) এর তথ্য এবং করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের অশুভ বিস্তার বলছে, এত সহজে ওই উপসংহারে না পৌঁছে বরং দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই টিকা নিয়ে ফেলাটা মঙ্গলজনক।

কিন্তু এত সংক্রমণের মধ্যেও যারা কোভিড- ১৯ টিকা নিয়েছেন তাদের খুবই কম সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছেন। এদের অল্প কজন অসুস্থ হয়েছেন এবং হাসপাতালে যেতে হয়েছে। তার চেয়েও কম সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

এ পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশই কেবল সংক্রমিত হয়েছেন। এবং তাদের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার মত অসুস্থ হয়েছেন আরও কম। আর টিকা নেওয়ার পরও কোভিডে মৃত্যু হয়েছে এমন সংখ্যা একেবারেই ক্ষুদ্র। 

অর্থাৎ, টিকা হয়ত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শতভাগ সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে মানুষের জীবনের ঝুঁকি যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে দিতে পারছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যানজেলেসে যারা কোভিড-১৯ টিকা নিয়েছেন তাদের এই স্টিকার দেওয়া হচ্ছে। ছবি- রয়টার্স।

সিডিসি গত শনিবার জানিয়েছে, যারা টিকার পুরো ডোজ সম্পন্ন করেছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ০ দশমিক ০০৪ শতাংশ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ০ দশমিক ০০১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে টিকা পাওয়া নাগরিকদের মধ্যে ৬ হাজার ৫৮৭ জনের কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার খবর এসেছে, মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ২৬৩ জনের। দেশটিতে গত ১৬ জুলাই পর্যন্ত ১৬ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। 

সিডিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৭০ শতাংশ কোভিড টিকার অন্তত একটি ডোজ পেয়েছেন। এক মাসেরও কিছু কম সময় আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আশা প্রকাশ করেছিলেন।

টিকায় অনীহা কেন

সিএনএন লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা বা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করার অনেকগুলো কারণের একটি হল কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা তা বোঝার জন্য অপেক্ষা করা।

জনগণের মধ্যে সরকারে কথা নিয়ে সন্দেহ আছে, টিকাদান কর্মসূচি আরও দ্রুত এগিয়ে নিতে এটাও একটি বাধা।

দেশটির বেশ কিছু এলাকায় ভাইরাসের প্রকোপ এখনও সেভাবে দেখা যায়নি। ফলে সেসব এলাকার মানুষের কাছে কোভিড- ১৯ এখনও বড় হুমকি হয়ে দেখা দেয়নি। আবার অনেকে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে যাওয়ায় এখন আর এ রোগ নিয়ে ভয় পাচ্ছেন না। 

অনেক ক্ষেত্রে পেশাগত ব্যস্ততার কারণেও অনেকে টিকা নিতে পারেননি। তাছাড়া রাজনীতিরও একটি ভূমিকা আছে এর পেছনে। সাবেক প্রসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প কোভিডকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করায় তার প্রভাবও পড়েছে বলে জানাচ্ছে সিএনএন।

ট্রাম্প প্রশাসন সে সময় টিকা তৈরির তহবিল দিলেও মাস্ক পরা নিয়ে উপহাস করেছে। গত নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেসব রাজ্যে ট্রাম্প বেশি ভোট পেয়েছেন, সেসব এলাকাই টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে বেশি।

রিপাবলিকান পার্টির সমর্থকদের অনেকেই এখনও টিকা দেওয়া এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন।

মনমাউথ ইউনিভার্সিটির এক জরিপে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৭ শতাংশ মানুষ এখনও টিকা দেওয়ার ঘোর বিরোধী। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই রিপালিকান সমর্থক। আর ৬ শতাংশের ঝোঁক আছে ডেমোক্র্যাট দলের প্রতি।