প্রশান্ত কিশোর: ভোটে জেতার কলাবিদ কোন দিকে তাকিয়ে

সাধারণ কোনো রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর নন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2021, 02:27 AM
Updated : 28 July 2021, 02:27 AM

তার ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি টিভিতে খবর দেখেন কালেভদ্রে; সংবাদপত্রও পড়েন না। কাউকে তিনি ইমেইল লেখেন না, কোনো বিষয়ে নোট রাখাও তার অভ্যাস নয়।

এবং গত এক দশকে তিনি ল্যাপটপও ব্যবহার করেননি। একমাত্র যে যন্ত্রটি তিনি এখন ব্যবহার করেন, সেটি তার ফোন।

টুইটারে তাকে অনুসরণ করেন ৫ লাখ মানুষ। অথচ গত তিন বছরে তিনি সব মিলিয়ে মোট ৮৬টি পোস্ট দিয়েছেন।

প্রশান্ত কিশোরের ভাষায়, “কাজ আর ব্যক্তি জীবনে ভারসাম্য রাখার যে কথা বলা হয়, ওতে আমি বিশ্বাসী নই। নিজের কাজের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে আমার আগ্রহও নেই।”

গত এক দশক ধরে ভোট আর রাজনীতির মাঠের আলোচিত নাম প্রশান্ত কিশোর, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তাকে ছোট্ট করে লেখে পি কে।

তিনি নিজে কোনো দল করেন না, টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক দলকে ভোটে জেতার মন্ত্রণা দেন।

আগামী নির্বাচনে তিনি কোন দলকে মন্ত্রণা দেবেন, সেই সম্ভবানা নিয়ে নানা গুঞ্জনে আবারও আলোচনায় প্রশান্ত কিশোর। অবশ্য বিবিসিকে তিনি বলেছেন অন্য কথা।

রাজনৈতিক পরামর্শক হিসেবে তার কাজের ধরন, সাফল্যের রহস্য আর ভোটের রাজনীতি নিয়ে তার মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

প্রশান্ত কিশোরকে বলা হয় ভারতের সবচেয়ে পরিচিত ও সফল রাজনৈতিক পরামর্শক ও কৌশল নির্ধারক, যদিও নিজের সম্পর্কে এই বিবরণ তার পছন্দ নয়।

বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শদাতা হিসেবে বিচক্ষণতার সঙ্গে কৌশল নির্ধারণ ‌এবং ভোটের মাঠে জনসাধারণকে প্রভাবিত করে নির্বাচনে জয় এনে দিতে তার রয়েছে কুশলী দক্ষতা।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী জনতা দলের নেতা নিতিশ কুমারের সঙ্গে প্রশান্ত কিশোর

২০১১ সাল থেকে কিশোর এবং তার পরামর্শক সংস্থা নয়টি নির্বাচনের মধ্যে ৮টিতেই সফলতা পেয়েছে। এসব নির্বাচনে কিশোরের দল রণসজ্জা সাজিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে।

কিশোরের কারিশমা আর সাফল্যের কাহিনী এমনই চমকপ্রদ, যে তার জীবনী নিয়ে ডিজনি, নেটফ্লিক্স এমনকি বলিউডের শাহরুখ খানও বায়োপিক তৈরি করতে চেয়েছেন, কিন্তু তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন সেসব প্রস্তাব।

এপর্যন্ত তার সফল পরামর্শ পেয়েছেন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারা। ২০১৪ সালে ক্ষমতার দৌড়ে বিজয়ী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে তার ঘোর বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের গত মে মাসের উত্তেজনাপূর্ণ বিজয়ও এসেছে কিশোরের পরামর্শেই।  

সমর্থকরা কিশোরকে বলেন ‘পরশ পাথর’, যেন তার ছোঁয়া পাওয়া মানেই ভোটে জয় নিশ্চিত। তবে সমালোচকরা বলেন, খুব সতর্কতার সঙ্গে জয় পাওয়ার সম্ভাবনা যাচাই করে ‘মক্কেল’ ঠিক করতে ওস্তাদ প্রশান্ত কিশোর। 

৪৪ বছর বয়সী এই প্রশান্ত কিশোরই গত মে মাসে ঘোষণা দিলেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর না। বললেন, “এই জায়গা আমি ছেড়ে দিচ্ছি, এখন অন্য কিছু করতে চাই।”

কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে আবারও তিনি খবরের শিরোনামে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ বিরোধী দলের প্রধান নেতাদের সঙ্গে তার বৈঠকের খবরে রব উঠেছে, কৌশলী কিশোর এবার নরেন্দ্র মোদীর বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক জোট গঠনে পরামর্শ সেবা দিচ্ছেন। এমনকি ঝিমিয়ে পড়া কংগ্রেসের ভবিষ্যতকে চাঙ্গা করতে তিনি রাহুল গান্ধীর দলে ভিড়ছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

এসব জল্পনা হিসেবে উড়িয়ে দিয়ে কিশোর বিবিসিকে বলেছেন, “আগে যা করেছি এখন আবার সেই কাজ আমি করব না। আমার সামনে কয়েকটা পথ খোলা, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত আমি এখনও নিইনি। হতে পারে আমি এমন কিছু করতে শুরু করব যার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্কই নেই। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলে দ্রুতই আমি সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেব।”

ভারতে সাধারণ নির্বাচনের তিন বছর বাকি থাকতে মোদীর বিরুদ্ধে শক্ত চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিজেদের দাঁড় করানোর চেষ্টায় একরকম হিমশিম খাচ্ছে বিরোধী দলগুলো। কিশোর মনে করেন, বিজেপি এককভাবে ততটা শক্তিশালী দল নয়, যতটা মনে হয়।

“তাছাড়া যেসব রাজনৈতিক দল আছে, অথবা নতুন কোনো দল যদি হয়, এককভাবে অথবা জোট বেঁধে চ্যালঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার সুযোগ সব সময়ই থাকে।”

১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ভোট আর আসন সংখ্যার বিবেচনায় কংগ্রেসের পতন দেখা যাচ্ছে কেবলই। ২০১৯ সালে জনগণের সরাসরি ভোটের ২০ শতাংশ এবং মাত্র ৫২টি আসন পেয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত নির্বাচনে পরাজিত হয় দলটি।

কিন্তু পার্লামেন্টে এখনও এই দলটির রয়েছে ১০০ জন এমপি এবং রাজ্য আইনসভাগুলোতে রয়েছে ৮৮০ জনপ্রতিনিধি। এখনও পর্যন্ত বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসই সবচেয়ে বড় বিরোধী দল।

কিশোর বলেন, “কংগ্রেসের সমস্যা কোথায় সে বিষয়ে বলার আমি কেউ না। আমি কেবল বলতে পারি গত এক দশকে নির্বাচনী ফলাফলে যা দেখা গেছে, এ দলের সমস্যা তার চেয়েও গভীর।”

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের জন্যও কাজ করেছেন প্রশান্ত কিশোর

কিশোরের মতে, নতুন একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের কথা মুখে বলা যত সহজ, বাস্তবে ততটা না। জোড়াতালি দিয়ে তৃতীয় একটি বিরোধী জোট গড়ে তোলা ভারতে আর সম্ভব না, আর গড়ে তোলা গেলেও তা টেকসই হবে না, কারণ সেরকম জোট এমন কিছু দিতে পারবে না যা এরইমধ্যে ভোটারদের মাধ্যমে পরীক্ষিত হয়নি বা প্রত্যাখ্যাত হয়নি।

অবশ্য ২০২৪ সালে টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের ক্ষমতায় থাকতে চাওয়া বিজেপি কোনো ‘অজেয়’ দল নয় বলেই মনে করেন কিশোর। তিনি বলেন, “অনেক সুযোগ এবং উদাহরণ আছে, সঠিক কৌশল এবং চেষ্টা থাকলে তাদেরও পরাজিত করা সম্ভব।”

কিশোরের হিসাবটা এরকম- ভারতে যে দলই নির্বাচনে জয়ী হোক, যত জনপ্রিয়ই তারা হোক না কেন, সাধারণত ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি ভোট তারা পায় না। ২০১৯ সালে বিজেপি ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে, আসন পেয়েছে তিনশর বেশি।

অথচ দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যে বিজেপি ২০০ আসনের এক পঞ্চমাংশও জিততে পারেনি। অর্থাৎ আঞ্চলিক দলগুলো কার্যকরভাবেই বিজেপির গতি রোধ করতে পেরেছে।

উত্তর ও পশ্চিম ভারতে যেখানে বিজেপির প্রভাব বেশি, সেসব রাজ্যে আছে বাকি ৩৪০টি আসন। এসব এলাকায় কোনো দল যদি ১৫০টি আসন পেয়ে যায়, বিজেপির দখল কমে যাবে।

রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থাগুলো ভারতের মত একটি দেশে কীভাবে কাজ করে প্রশান্ত কিশোরের কাজের ধরন থেকে তার কিছুটা বোঝা যায়।

সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দল কিশোরের কোম্পানি ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটিকে (আইপ্যাক) ভাড়া করলে নির্বাচনী প্রচারের সময় ৪ হাজারের বেশি কর্মী ওই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রচার কাজ চালায়।

কিশোর বলেন, “নির্বাচনে দলটির ভালো করতে হলে যা প্রয়োজন, সেটা করতে আমরা তাদের শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে সহায়তা করি। তাতে আমরা কিছুটা পার্থক্য গড়ে দিতে পারি, তবে সেটা কতটা হবে- তা বলা কঠিন।”

গত এক দশকে ভারতের ভোটের রাজনীতি দেখার অভিজ্ঞতা থেকে প্রশান্ত কিশোর বলছেন, নির্বাচনী প্রচার কিংবা জনসভায় লোক সমাগম দেখে ভোটের ফল আঁচ করা যায় না। ভারতে নির্বাচন এখন অনেক ব্যয়বহুল, ফলে রাজনীতিতে প্রবেশ করার পথও কঠিন হয়ে গেছে। তাছাড়া রাজনৈতিক আর সামাজিক মেরুকরণও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।

ভোটের সময় ৮০ কোটির বেশি ভারতীয় কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করেন?

কিশোর বলছেন “সামাজিক সুরক্ষা পাওয়ার সম্ভাবনা, আত্মপরিচয়, ক্ষমতায়ন, বিভিন্ন সুবিধা প্রাপ্তি, আরও অনেক কিছু তারা বিবেচনা করতে পারেন, তবে আমি কখনও সেসব অনুমানের ঝামেলায় যাই না।

“আমি কখনো ভোটারদের মনের ভাব অনুমান করি না। আমি কেবল চেষ্টা করি এমন একটি কাঠামো দাঁড় করাতে, যাতে লোকজন কী বলছে সেটা জানা যায়। সেসব শুনতে গিয়ে আমরা সব সময়ই নতুন তথ্য পাই, তাতে বিস্মিত হই, অবাক হই।”

২০১৫ সালে আইপ্যাকের কর্মীরা ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য কিশোরের জন্মভূমি বিহারের ৪০ হাজার গ্রামে গিয়ে তাদের সমস্যাগুলোর কথা তুলে আনেন।

তাদের প্রধানতম সমস্যা ছিল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। কিশোরের কর্মীরা দেখতে পান, থানায় যেসব অভিযোগ যাচ্ছে, তার এক পঞ্চমাংশই হল নালা নিয়ে মারামারির ঘটনা।

গত বছর পশ্চিমবঙ্গের ভোটের আগে মানুষের সমস্যার কথা জানতে একটি হেল্পলাইন খুলেছিলেন কিশোর। ৭০ লাখ লোক সেখানে কল করেন। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল কাস্ট সার্টিফিকেট নিয়ে দুর্নীতি বা বিলম্বের অভিযোগ।

ওই তথ্যের ভিত্তিতে সরকার ৬ সপ্তাহের মধ্যে ২৬ লাখ মানুষকে ওই সনদ দিয়েছিল বলে জানালেন কিশোর।

এসব সফলতার পরও প্রশান্ত কিশোর মনে করেন, রাজনীতি আসলে তার জন্য না।

“আমি আসলেই রাজনীতি খুব ভালো বুঝি না। আমি কাজ করি কমন সেন্স থেকে। মানুষের কথা মনযোগ দিয়ে শুনি। আর আমি চাপের মধ্যে কাজ করতে ভালোবাসি।”