ঘানার কোজো মারফো: কসাই থেকে চিত্রকর

জীবনের এক পর্যায়ে মাংস কাটার দোকানে কাজ করেছেন, অর্থাৎ ছিলেন কসাই। এখন তিনি ছবি আঁকেন, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র গরু।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2021, 07:16 AM
Updated : 23 July 2021, 07:16 AM

ঘানার চিত্রশিল্পী কোজো মারফো এখন এতটাই সফল যে তার প্রদর্শনীর সব চিত্রকর্ম বিক্রি হয়ে যায়। অথচ এক সময় ছবি আঁকা ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রায়।

ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

কোজো মারফোর জীবনের গল্প নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি। সেখানে তিনি বলেছেন, ছবির মধ্য দিয়ে বিশ্বকে তিনি বোঝাতে চান গরুর গুরুত্ব। তার ভাষায়, মানুষের আজকের এই যে সভ্যতা, গরুর কারণেই তা গড়ে উঠতে পেরেছে।

“ঘানায় আমরা গরু ব্যবহার করি জমিতে লাঙল টানার জন্য। আপনি যদি দুই থেকে তিনটি গরুর মালিক হতে পারেন, চমৎকার একজন নারী আপনাকে বিয়ে করতে রাজি থাকবেন। আর ভারতের অনেক জায়গায় তো গরু ‘মা’ হিসেবে গণ্য হয়।”

ঘানার পল্লীতে নানী আর মায়ের কাছে বড় হওয়ার সময়ই শিল্পবোধের উন্মেষ হয় কোজো মারফোর ভেতরে। নিউ ইয়র্কে পাড়ি জামানোর পর সেটা আরও বেড়েছে। নিউ ইয়র্কেই তাকে অল্প কিছুদিন করতে হয়েছে কসাইয়ের কাজ।

সেই দিনগুলো নিয়ে ৪১ বছর বয়সী এই শিল্পীর ভাষ্য, “আসলে আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। মাংস সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল একেবারেই কম। কাজটা চালিয়ে গেলে প্রতারণাই করা হত।”

একটি পাখি, বেড়াল, কুকুর ও গরুর সঙ্গে একজন নারী ও শিশু। ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

যে কসাইখানায় কোজো মারফো কাজ করতেন, তার দেয়ালে গরুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিস্তারিত আঁকা ছিল, কীভাবে কাটতে হবে ছবিতে সেই নির্দেশনাও ছিল। তার কাজ ছিল ওই ছবি দেখে মাংস কাটা।

“তারপরও আমি আমার বসের কাছে ধরা পড়ে যেতাম, মাংস কাটার চাইতে ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপেই আমার আগ্রহ ছিল বেশি।”

এক সময় হয়তো তিনি এই প্রাণীর মাংস বিক্রি করেছেন, কিন্তু সেই গরুতে অনুপ্রাণিত হয়ে তুলির আঁচড়ে উদ্ভাসিত তার ক্যানভাসগুলো এখন প্রত্যাশিত দামের তিনগুণ বেশি দরে বিক্রি হয়। মারফোর শিল্পকর্ম এখন লন্ডনের দামী চামড়া পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাসপাইনালের স্কার্ফে শোভা পায়।

ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

গরু ছাড়াও কোজো মারফোর শিল্প ভাবনায় অনুপ্রেরণা হয়ে আছে নারীত্বের শক্তি, সন্তানকে মা একাই কীভাবে বড় করেন এবং ধবল রোগের ‘সৌন্দর্য্য’।

প্রথম দর্শনে তার চিত্রকর্মে ব্যাপকভাবে আফ্রিকার ছাপই চোখে পড়ে - যেখানে তিনি বেড়ে উঠেছেন, পাহাড়ি শহর কোয়াহু, রাজধানী আক্রা থেকে চার ঘণ্টা দূরে - কিন্তু প্রতিটি শিল্পকর্মই ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশের যত্নশীল ছোঁয়া নিয়ে গড়ে উঠেছে।

ব্রিটেনের রেনেসাঁর সময়ের রুফ কলার, ভারতের পূজনীয় গরু এবং ঘানার ঊর্বরা পুতুল- সবই জায়গা পেয়েছে তার ছবিতে।

তিনটি চরিত্র গলায় রুফ কলার পরা। ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

কোজো মারফোর ভাষায়, নানা জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, স্টাইল আর তত্ত্বের সহবাস এই বিশ্বে। হয়ত অনেক জায়গায় ফাটল আছে, কিন্তু তিনি সবাইকে এক জায়গায় আনতে চান, যেখানে সবাই সবার সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি পাবেন।  

শৈশবে বেড়ে ওঠার সময়টাতে স্থানীয় গ্রন্থাগারে পিকাসোর চিত্রকর্মগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার কথা মনে পড়ে মারফোর। মনে পড়ে আক্রায় হস্তশিল্পীরা কেমন করে পর্যটকদের কাছে তাদের শিল্পকর্ম বিক্রি করতেন, সেসব কথা। তবে তখনও তার ভেতরে শিল্পচর্চা নিয়ে বড় কোনো স্বপ্ন তৈরি হয়নি, নদীর তীরেই নিজের শিল্পসত্তাকে বেধে রেখেছিলেন।

“আমি ভাবতাম আমার বোধহয় একজন চিকিৎসক বা হিসাব নিরীক্ষক হওয়া উচিত, কিন্তু নদীর ধারে গেলেই আমি শক্ত কাদা তুলতাম, জাম কুড়িয়ে সেগুলো চটকে রঙ বানাতাম।

“চিত্রকর্মের বইগুলো থেকে ছাপ তোলার জন্য কাগজে ভ্যাসলিন মাখিয়ে ট্রেসিং পেপার তৈরি করেছি। কিন্তু ঘানা ছাড়ার আগে নিজের ছবি আঁকা নিয়ে আমি সিরিয়াস ছিলাম না।”

নিউ ইয়র্ক হয়ে যুক্তরাজ্যে এসে শেষ পর্যন্ত নিজের পথ খুঁজে পেয়েছেন কোজো মারফো। লন্ডনে তিনি এখন তার খালার মুদি দোকানে কাজ করেন।

ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

মারফো জানান, ২০০০ সালের দিকে তিনি ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আবার যখন অনুপ্রেরণা ফিরে এল, তিনি আঁকতে শুরু করলেন।

“আমি দেখাতে চেয়েছিলাম, একাকী মায়ের জীবনযাপনও কীভাবে ইতিবাচকভাবে দেখা সম্ভব। আমাদের ওদিকে পাহাড়ি জীবনে, নারীরাই সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। আর নারীরাই আমাকে লালন পালন করে বড় করে তুলেছে।

“একজন কট্টর নারীবাদী একবার আমাকে বলেছিলেন, সমাজে পুরুষরাই সবসময় কর্তৃত্ব চালিয়ে এসেছে, আর নারীর সব সময় ভিকটিম হয়ে থেকেছে। কিন্তু আমি যেখান থেকে এসেছি, সেখানেই নারীরাই ছিল কর্ত্রী।”

তার শিল্পকর্মে সৌন্দর্য্যের ভাবনাটিও ভিন্নভাবে ধরা দেয় - প্রতিটি চরিত্রের মুখমণ্ডলে শ্বেতী রোগ ফুটিয়ে তোলেন মারফো।

ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে মারফো বলেন, “চেহারাগুলো, দেখতে অনেকটা কোলাজ-কাটের মতো হয়, এই ধারণাটি আমার ভেতরে এসেছে একজন পরিচিত ব্যক্তিকে দেখে, যিনি শ্বেতী রোগে ভুগছিলেন।

“যখন আমি নিজের ছবিতে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম, আমি সফল হলাম। আমি সবসময় নিজেকে বলেছি যে আমি সুন্দর ছবি আঁকতে চাই না... আমি আঁকতে চাই এমন কিছু, যা আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপের জন্য ব্যবহার করতে পারব।”

কোজো মারফোর মা ছিলেন ‘জিহোভাস উইটনেস’ নামের একটি খ্রিস্টীয় ধারার অনুসারী, যারা সনাতন খ্রিস্টীয় মতবাদের অনেক কিছুই মানেন না। মায়ের কাছে বড় হওয়া ছেলেটি ধর্মীয় প্রতীকগুলো নিয়ে জেনেছেন ছেলেবেলাতেই।

“আফ্রিকায় শিল্পের বোধ ইউরোপের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা। ইউরোপীয়রা শিল্প নিয়ে খেলতে পারে এবং নিজেদের প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু আফ্রিকায় এ বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়।

“আপনি যদি সুন্দর কোনো প্রতিকৃতি আঁকেন, কোনো নারী, পুরুষ বা প্রকৃতির ছবি আঁকেন - সেটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যখনই আপনি আধ্যাত্মিকতা কিংবা ভুডুর দিকে ঝুঁকবেন, সবাই বলতে শুরু করবে- ‘এই লোকটা বিপজ্জনক!’ এমনকী শুভাকাঙ্ক্ষীরাও বলবে, ‘এসবে হাত দেওয়া তোমার ঠিক হচ্ছে না, এগুলো খেলার বিষয় না’।”

ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

কোজো মারফো প্রথমে অনলাইনে তার চিত্রকর্ম বিক্রি করতে শুরু করেন। পরে উঠতি চিত্রকরদের জন্য আয়োজিত ‘আইসোলেশন মাস্টার্ড’ নামের উন্মুক্ত এক প্রদর্শনীতে ছবি পাঠান।

তার চিত্রকর্মগুলোর বৈচিত্র্য ও ধার বিচারকদের নজর কাড়ে - যাদের মধ্যে সোদেবির আর্ট হিস্টোরিয়ান ডেভিড বেলিংহ্যাম এবং চিত্র সংগ্রাহক ও ব্রিটিশ রক ব্যান্ড বুশের গ্যাভিন রসডেইলও ছিলেন। মারফোর আঁকা একটি ছবি রসডেইল কিনেছেন নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার জন্য।

এরপর হঠাৎ করেই মারফোর সব ছবি বিক্রি হতে শুরু করে।

ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি

 

মারফো বলেন, “আমি জানি না এর পেছনে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের কোনো ভূমিকা আছে কিনা। ক্রেতাদের কাছ থেকে আমি দুটো বিষয় জেনেছি; আমার কাজের মধ্যে তারা ভিন্ন কিছু দেখতে পেয়েছেন, তারা বলেছেন, ‘তুমি যেটা করছ, সেটা আর কেউ করছে না।’ এবং আমি ব্যক্তিগত যে গল্পগুলো ছবিতে গেঁথে,ছি তারা সেগুলো পছন্দ করেছেন।”

ব্যক্তিগত গল্পের এসব ছবির মধ্যে একটির নাম করোনেশন বা উপনয়ন। সেখানে দেখা যায়, এক যুগল স্থির তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কিন্তু এরপরই দর্শকের নজর পড়বে নারী চরিত্রের হাতে পরা বক্সিং গ্লাভসের দিকে। মারফো জানালেন, এই ছবি তার এক পরিচিত নারীর গল্প বলছে, যিনি এই লকডাউনের মধ্যে হঠাৎই আবিষ্কার করেছেন তার সঙ্গীর পরকীয়া সম্পর্কের কথা।

লন্ডনের জেডি মালাট গ্যালারিতে মারফোর প্রথম প্রদর্শনীতে প্রথম মাসেই তার সব চিত্রকর্ম বিক্রি হয়ে যায়। আর তার দ্বিতীয় প্রদর্শনী ‘ড্রিমিং অব আইডেন্টিটি’র শুরুর দিনই বিক্রি হয়ে গেছে সব ছবি।

লন্ডনের জেডি মালাট গ্যালারিতে কোজো মারফোর চিত্র প্রদর্শনী। ছবি: জেডি মালাট গ্যালারি

 

অবশ্য পাহাড়ি এলাকা থেকে উঠে আসা মারফোর কাছে টাকা বাড়তি কোনো মূল্য বহন করে না। তার কাছে টাকা কেবল বেঁচে থাকার রসদ।

“কোয়াহুর মাটি চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে সেখানে টিকে থাকার জন্য অন্য কোনো পথ করে নিতে হয়। ঘানার মানুষ কোয়াহুর অধিবাসীদের অর্থলোভী হিসেবে দেখে। কিন্তু পকেটে যা আছে তা নিয়েই আমি সবসময়ই খুশি থেকেছি।”

ছবি আঁকার তুলি ছেড়ে আবারও কখনো কসাইয়ে চাকু ধরতে চান কোজো মারফো? সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না এই শিল্পী।

“কসাইয়ের কাজটা এখনও আমার মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে। কাজটা ঠিকঠাক কীভাবে করতে হয়, সেটা শিখে নেওয়ার ইচ্ছা আছে আমার।”

গরু, কুকুর ও পাখির সঙ্গে মানুষ। ছবি: কোজো মারফো/জেডি মালাট গ্যালারি