নাটকীয় সেই পলায়নপর্বের গল্প শোনালেন সাবেক নিশান বস কার্লোস ঘোন

রাত তখন সাড়ে ১০টা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তখন প্রচণ্ড শীত। উড়োজাহাজের ভেতরে বাক্স-বন্দি একজন রাঘব-বোয়াল।  

নিউজ ডেস্ক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2021, 05:36 PM
Updated : 19 July 2021, 06:39 AM

তিনি জাপানের গাড়িনির্মাতা কোম্পানি নিশানের সাবেক প্রধান কার্লোস ঘোন; আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালাচ্ছেন জাপান থেকে।

বিবিসির কাছে জাপান থেকে পালানোর অভিজ্ঞতা প্রথমবারের মতো নিজেই বর্ণনা করেছেন এক সময় নিশান ও ফরাসি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেনোর শীর্ষ পদে থাকা ঘোন।

সেই মুহূর্তগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, উড়োজাহাজ উড়াল দেওয়ার কথা ছিল রাত ১১টা।

“উড়োজাহাজের ভেতরে বাক্সের মধ্যে ৩০ মিনিটের ওই অপেক্ষা, টেকঅফের জন্য অপেক্ষমার সময়, সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম অপেক্ষা।”

বিবিসিকে দেওয়া এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে ঘোন বর্ণনা করেছেন কীভাবে তিনি ছদ্মবেশ নিয়ে টোকিওর রাস্তায় কারও চোখে ধরা না পড়ে একটি হোটেলে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে কীভাবে তিনি একটি বাদ্যযন্ত্রের বড় বাক্সে নিজেকে লুকিয়ে উড়োজাহাজে চড়েন এবং শেষ পর্যন্ত জাপান থেকে পালিয়ে মাতৃভূমি লেবাননে পৌঁছান।

ঘোন বলেন, “সেই যে উত্তেজনা, শেষ পর্যন্ত গল্পটা আমি এখন বলতে পারছি।”

নিশান বার্ষিক বেতন গোপন করার এবং কোম্পানির তহবিলের অপব্যবহারের অভিযোগ আনলে ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয় কার্লোস ঘোনকে। সেই অভিযোগ এখন পর্যন্ত অস্বীকার করে আসছেন তিনি।

গ্রেপ্তারের সময় ঘোন জাপানি গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ছিলেন। একই সময়ে তিনি ফ্রান্সের রেনোরও চেয়ারম্যান ছিলেন এবং একইসঙ্গে ত্রিপক্ষীয় জোটেরও প্রধান ছিলেন, যে জোট গঠিত হয়েছিল আরেক জাপানি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি মিৎসুবিশিকে সঙ্গে নিয়ে।

নিশানে তার ব্যয় সঙ্কোচনের পদক্ষেপ নিয়ে শুরুতে প্রশ্ন উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা কোম্পানিকে টিকিয়ে দিয়েছিল। আর তাতেই ঘোন সম্মানিত ও পরিচিত একজন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।

অবশ্য ঘোন এখন দাবি করছেন, রেনোর আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে নিশানের পাল্টা পদক্ষেপে তিনি ‘বলির পাঁঠা’ হয়েছেন। ফ্রান্সের রেনো এখনও জাপানের নিশানের ৪৩ শতাংশের মালিক।

তিন বছর আগে টোকিও বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তটি স্মরণ করে কার্লোস ঘোন বলেন, “ঘটনাটি এতোটাই অপ্রত্যাশিত ছিল… আমার অনুভূতিটা ছিল এরকম- একটি বাস বোধহয় আমাকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছে, অথবা খুবই ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে।

“ওই মুহূর্তের একমাত্র যে স্মৃতি আমার ভেতরে কাজ করে, সেটা হল প্রচণ্ড ধাক্কা, জমাট বাঁধা ভয়ের অনুভূতি।”

গ্রেপ্তারের পর ঘোনকে টোকিওর ডিটেনশন সেন্টারে নেওয়া হয়, সেখানে তাকে কয়েদির পোশাক দেওয়া হয় এবং একটি সেলে বন্দি করে রাখা হয়। ঘোন

“হঠাৎ করেই আমাকে সেখানে শিখতে হল- ঘড়ি, কম্পিউটার, টেলিফোন, সংবাদ, এমনকি কলম- এসব কিছু ছাড়া কী করে বাঁচতে হয়।”

এক বছরের বেশি সময় ঘোনকে দফায় দফায় দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। জামিন পাওয়ার পর টোকিওতে তাকে থাকতে হয়েছে গৃহবন্দি অবস্থায়।

এটা স্পষ্ট ছিল না যে কখন তার বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। তার আশঙ্কা ছিল, হয়ত বহু বছর লেগে যাবে। আর শেষ পর্যন্ত দোষী প্রমাণ হলে তার ১৫ বছরের কারাদণ্ড হবে। জাপানে ৯৯ দশমিক ৪ শতাংশ মামলায় আসামি দোষী প্রমাণিত হয়।

সাক্ষাৎকারে ঘোন বলেছেন, গৃহবন্দি থাকার সময় যখন তাকে জানানো হল যে স্ত্রী ক্যারোলের সঙ্গে তিনি আর যোগাযোগ করতে পারবেন না, তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন- পালাতে হবে।

“পরিকল্পনাটা ছিল এরকম- যেহেতু কোথাও আমার চেহারা দেখানো যাবে না, আমাকে কোথাও লুকাতে হবে। সেটা করার একমাত্র উপায় হল কোনো বড় বাক্স বা লাগেজের ভেতরে লুকিয়ে পড়া, যাতে বিমানে করে পালানোর সময় কেউ আমাকে দেখতে না পারে, চিনতে না পারে। সেটা করা গেলে পালানোর পরিকল্পনা হয়ত কাজে লাগবে।”

লুকিয়ে পড়ার জন্য কেমন বাক্স হলে ভালো হয়? ঘোন ভাবলেন, যে ধরনের বাক্সে পিয়ানোর মত বড় আকারের বাদ্যযন্ত্র বহন করা হয়, তেন কিছু দরকার। আর বছরের ওই সময়টায় জাপানে প্রচুর কনসার্ট হয়। ফলে বাদযন্ত্রের বাক্সই তার কাছে সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান বলে মনে হল।

কিন্তু গৃহবন্দি দশায় বাড়ি থেকে বের হবেন কীভাবে? এমন পরিচিত মুখ নিয়ে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বিমানবন্দরেই বা যাবেন কীভাবে? ঘোন পরিকল্পনা করলেন, যতোটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে যেতে হবে তাকে।

“অন্য দিনের মতই আমি স্বাভাবিক পোশাক পরে, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাজকর্ম করতে থাকব এবং হঠাৎই সব বদলে যাবে।”

পলায়ন পর্বে পরিচয় লুকাতে তিনি স্যুট বাদ দেওয়ার কথা ভাবলেন। অটোমোবাইল ব্যবসার কেউকেটা হিসেবে তাকে মানুষ ওইরকম স্যুটে দেখেছে বহু বছর। তিনি ভাবলেন জিন্স আর ট্রেইনার পোশাকের কথা।

“কল্পনা করে নিন, আমাকে এমন জায়গায় যেতে হয়েছে, যেখানে আমি কখনো যাইনি, এমন সব পোশাক কিনতে হয়েছে, যা আমি কখনো আগে কিনিনি। এর সবই করতে হয়েছে, যাতে সফল হওয়ার সর্বোচ্চ সুযোগটা আমি পাই, নিজের দিকে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে।”

 

এরপর সেই মুহূর্ত

বাসা থেকে বের হয়ে টোকিও থেকে বুলেট ট্রেনে ওসাকা পৌঁছান কার্লোস ঘোন। সেখানে স্থানীয় বিমানবন্দরে একটি প্রাইভেট জেট অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তার আগে তো লুকাতে হবে। সেজন্য সেই বাক্সটা অপেক্ষা করছিল কাছাকাছি একটি হোটেলে।

ঘোন বলেন, “আপনি যখন ওরকম একটা বাক্সে ঢুকবেন, আপনি না অতীত নিয়ে ভাববেন, না আপনার মধ্যে ভবিষ্যতের কোনো ভাবনা কাজ করবে, আপনার ভাবনা থাকবে শুধু ওই মুহূর্তটি ঘিরে।

আপনি ভীত নন, আপনার মধ্যে কোনো অনুভূতি কাজ করছে না, শুধু আপনি গভীর মনোযোগে ভাবছেন ‘এটাই আমার শেষ সুযোগ, এটা আমি হারাতে পারি না। যদি আমি এটা হারাই, আমাকে জীবন দিয়ে এর মাশুল গুণতে হবে, জাপানে কাটাতে হবে বন্দি জীবন’।”

বাক্সবন্দি ঘোনকে হোটেল থেকে বিমানবন্দরে নিয়ে যান দুইজন- বাবা মাইকেল টেইলর এবং ছেলে পিটার টেইলর, যারা নিজেদের পরিচয় দিয়েছিলেন বাদক হিসেবে।

সব মিলিয়ে ঘোনকে ওই বাক্সে কাটাতে হয় প্রায় দেড় ঘণ্টা। কিন্তু তার কাছে তখন মনে হচ্ছিল বছর দেড়েক লেগে গেল বুঝি!

সেই প্রাইভেট জেট নির্দিষ্ট সময়েই টেইকঅফ করে, এবং ঘোন তার কফিন থেকে বেরিয়ে আসেন। সারারাত ভ্রমণ শেষে পৌঁছান তুরস্কে, সেখানে বিমান বদলে পরের দিন সকালে বৈরুতে নামেন।

জাপানের সঙ্গে লেবাননের বন্দি বিনিময় চুক্তি নেই। তাই ঘোন সেখানে থাকতে পারছেন। যদিও তাকে সহায়তা করায় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক মাইকেল টেইলর ও তার ছেলে পিটারকে জাপানি কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। সেখানে তাদের জেল খাটতে হচ্ছে।

নিশানে ঘোনের সাবেক সহকর্মী গ্রেগ কেলিও কারাদণ্ডের মুখে আছেন, যাকে বর্তমানে টোকিওতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে ঘোনকে তার আয়ের তথ্য গোপনে সহায়তা করার অভিযোগে। কেলি অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

জাপানে যারা আটকে গেলেন, তাদের এখন কী হবে? জবাবে ঘোন বলেন, “আমাকে জানানো হয়েছে সম্ভবত এই বছরের শেষ নাগাদ (গ্রেগ কেলির) বিচার শেষ হতে পারে। ঈশ্বরই জানেন, বিচারের রায় কী হবে।”

জাপানে ‘আটকে রেখে বিচার’ করার এই পদ্ধতি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঘোন।

কার্লোস ঘোনের এই অনবদ্য পলায়নের গল্প নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি সিরিজ প্রচার করছে বিবিসি। তবে তার এই গল্প নিয়ে একটি হলিউডি সিনেমাও বানিয়ে ফেলা যায়, তার সব উপাদানই এ গল্পে আছে।

তবে বৈরুতে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে কাটাতে বাধ্য হওয়া ঘোনের ধারণা, অসাধারণ এই নাটক এখানেই শেষ হচ্ছে না।