মোদীর অধীনে ভারতের অর্থনীতি দ্যুতি হারালো যেভাবে

অনেক অনেক চাকরি, সমৃদ্ধি আর লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানোর বিশাল বিশাল সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চে ঝড় তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদী, কিন্তু সাত বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে বিজেপির এ নেতার অর্থনৈতিক রেকর্ড সবাইকে হতাশ করেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 June 2021, 11:23 AM
Updated : 22 June 2021, 11:34 AM

করোনাভাইরাস মহামারী দেশটির প্রত্যাশার চেয়েও খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও তলানিতে নিয়ে গেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

২০১৪ আর ২০১৯ সালে মোদীর নেতৃত্বাধীন জোটের বিশাল জয় দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশটিতে বড় ধরনের সংস্কারের আশা জাগিয়েছিল, কিন্তু মোদীর আমলে এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির কী হাল দাঁড়িয়েছে তা উঠে এসেছে বিবিসির ওই প্রতিবেদনে।

মন্থর প্রবৃদ্ধি

মোদী ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতিকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করার পর যা প্রায় তিন ট্রিলিয়নে দাঁড়াবে; মোদীর ঘোষিত জিডিপির এই লক্ষ্যমাত্রা এখন এক দিবাস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

কোভিড পূর্ববর্তী স্বাধীন এক পর্যালোচনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ভারতের অর্থনীতি সর্বোচ্চ দুই দশমিক ছয় ট্রিলিয়নে পৌঁছাতে পারে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারী সেখান থেকেও ২০০ বা ৩০০ বিলিয়ন ছেঁটে ফেলেছে।

বিশ্ববাজারে তেলের দরের কারণে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিও ভারতের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগ হয়ে হাজির হয়েছে বলে মত অর্থনীতিবিদ অজিত রানাডির।

মোদী যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তখন ভারতের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হার ছিল সাত থেকে আট শতাংশ, এক দশকের মধ্যে তা সর্বনিম্নে নেমে এসে ২০১৯-২০ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে তিন দশমিক এক শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

২০১৬ সালে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত ভারতের বাজারে নগদ অর্থ প্রবাহের ৮৬ শতাংশই নির্মূল করে দিয়েছিল আর বিভিন্ন পণ্য ও সেবার ওপর জিএসটি করারোপ দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্যে কঠিন আঘাত হেনেছিল। এসব থেকেই পরবর্তী বড় সমস্যাটি তৈরি হয়েছিল বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। 

আকাশচুম্বী বেকারত্ব

“২০১১-১২ থেকে বিনিয়োগে মন্দাই ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। ২০১৬ সাল থেকে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক অর্থনৈতিক ধাক্কায় ভুগেছি আমরা,” বলেছেন সেন্টার ফর মনিটরিং দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমির (সিএমআইই) প্রধান নির্বাহী মহেশ ভিয়াস।

নোট বাতিল, জিএসটি এবং মাঝে মাঝে দেওয়া লকডাউন সবই কর্মসংস্থান হ্রাস করেছে, বলেছেন তিনি।

বেকারত্ব বাড়তে বাড়তে ২০১৭-১৮ সালে তা ছয় দশমিক এক শতাংশে পৌঁছে যায় বলে সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক হিসাবে জানা গেছে, এ হার ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ওই হার এখন ২০১৭-১৮ সালের হিসাবেরও প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি বলে সিএমআইই-র পরিবার জরিপ থেকে জানা গেছে। শ্রম বাজারের পরিস্থিতি সংক্রান্ত তথ্যর বিকল্প হিসেবে প্রায়ই এ ধরনের জরিপ ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

২০২১ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশটির আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন। ভারতের সাড়ে সাত কোটির বেশি মানুষ ফের দারিদ্র্যের মধ্যে ডুবে গেছে, যাদের মধ্যে দেশটির ১০ কোটির শক্তিশালী মধ্যবিত্তর এক তৃতীয়াংশও আছে; যার ফলে ভারত অর্ধদশকের অগ্রগতি হারিয়ে ফেলেছে বলে এক মূল্যায়নে বলছে পিউ রিসার্চ।

ভারতের অর্থনীতিতে প্রতিবছর দুই কোটি চাকরির চাহিদা থাকলেও মোদী সরকার এর ধারেকাছেও কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন রানাডি। গত এক দশক ধরে দেশটি বছরে মাত্র ৪৩ লাখের কাছাকাছি চাকরি যোগ করতে পেরেছে।

উৎপাদন, রপ্তানির প্রত্যাশাও অপূর্ণ 

লাল ফিতার দৌরাত্ম কমিয়ে ভারতকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী উৎপাদক দেশে পরিণত করা এবং বিনিয়োগ টেনে এনে রপ্তানি হাবে রূপান্তর করার লক্ষ্যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল তুলেছিলেন মোদী।

উদ্দেশ্য ছিল উৎপাদন খাতকে জিডিপির ২৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। সাত বছর পরও ওই হিস্যা ১৫ শতাংশেই স্থবির হয়ে আছে। কেবল তাই নয়, উৎপাদন খাতে চাকরি সর্বশেষ পাঁচ বছরে অর্ধেকে নেমে গেছে বলেও জানিয়েছে সেন্টার ফর ইকোনমিক ডাটা অ্যান্ড অ্যানালাইসিস।

গত প্রায় এক দশক ধরে দেশটির রপ্তানিও ৩০০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে।

মোদীর শাসনামলে ভারত ক্রমাগত বাংলাদেশের মতো ছোট প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে বাজারের শেয়ার হারাতে বসেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোদী ‘আত্মনির্ভরশীল’ দেশ গড়ার কথা বলে ক্রমে হয়ে উঠছেন সংরক্ষণ নীতির সমর্থক, তিনি ধারাবাহিকভাবে শুল্কও বাড়িয়ে চলেছেন।

অবকাঠামো নির্মাণে অগ্রগতি-বিরল উজ্জ্বল খাত

মোদীর সরকার গড়ে প্রতিদিন ৩৬ কিলোমিটার মহাসড়ক নির্মাণ করেছে, আগের সরকারগুলোর আমলে যা ছিল ৮-১১ কিলোমিটার, বলেছেন অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ফিডব্যাক ইনফ্রার সহপ্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক চট্টোপাধ্যায়।

গত পাঁচ বছরে দেশটির নবায়নযোগ্য সৌর ও বায়ুচালিত জ্বালানি সক্ষমতাও দ্বিগুণ হয়েছে। দেশটির নবায়নযোগ্য জ্বালানি এখন প্রায় ১০০ গিগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৩ সালের মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াটে পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথেই আছে।

খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ বন্ধে লাখ লাখ টয়লেট বানানো, গৃহঋণ, দরিদ্রদের জন্য রান্নার গ্যাস ও পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহে ভর্তুকি দেওয়ার মতো মোদীর বেশ কয়েকটি জনতুষ্টিবাদী প্রকল্পকেও অর্থনীতিবিদরা স্বাগত জানিয়েছেন।

যদিও মোদীর বানানো অসংখ্য টয়লেট অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, অনেকগুলোতে পানি সরবরাহও সচল নয়। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভর্তুকির সুবিধাও খুব একটা কাজে লাগছে না।

জনতুষ্টিবাদী এসব প্রকল্পে বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের সঙ্গে কর থেকে আসা আয় বা রপ্তানির সামঞ্জস্য না থাকায় অর্থনীতিবিদরা ভারতের রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে যাওয়া নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন।

আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে বেড়েছে যোগ

একে মোদীর আরেকটি বড় অর্জন বলা যেতে পারে।

সরকার সমর্থিত এক পেমেন্ট পদ্ধতির কারণে ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম নেতৃস্থানীয় আসনে যেতে ভারত লাফিয়ে লাফিয়ে এগুচ্ছে। মোদীর ‘জন ধন’ প্রকল্প ব্যাংকের বাইরে থাকা লাখ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ব্যাংক হিসাবে ন্যুনতম কোনো অর্থ না রেখেও আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে।

এই প্রকল্পের কারণে ব্যাংকগুলোতে অ্যাকাউন্ট ও জমার পরিমাণ বেড়েছে, যাকে শুভ লক্ষণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। যদিও নতুন এ ব্যাংক হিসাবের অনেকগুলোই অব্যবহৃত থাকছে বলে বেশকিছু প্রতিবেদনে ধারণা পাওয়া গেছে।

এরপরও মধ্যসত্ত্বভোগীর দৌরাত্ম কমিয়ে সরাসরি লেনদেনের সুবিধা করে দেওয়ায় অর্থনীতিবিদরা একে ‘সঠিক পথে বড় ধরনের পদক্ষেপ’ হিসেবেই অভিহিত করেছেন।

স্বাস্থ্যসেবায় হতাশাজনক ব্যয়

“আগের সরকারগুলোর মতো এ সরকারও স্বাস্থ্যসেবাকে অবজ্ঞা করে যাচ্ছে। বিশ্বের যে দেশগুলো স্বাস্থ্যসেবায় সবচেয়ে কম অর্থ ব্যয় করে, ভারত তার মধ্যে একটি,” বলেছেন অর্থনীতিবিদ ঋতিকা খেরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত প্রতিরোধমূলক বা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় খরচ না করে বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবায় বেশি জোর দিচ্ছে।

“এটি আমাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র স্টাইলের ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে ধাবিত করছে, ফলাফলও ভালো হচ্ছে না,” বলেছেন খেরা।

২০১৮ সালে মোদী উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটি স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, অথচ কোভিড পরিস্থিতিতেও ওই প্রকল্পটির ব্যবহার খুব একটা দেখা যাচ্ছে না।

“এটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ছিল, যদিও এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আরও সম্পদের দরকার,” বলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. শ্রীনাথ রেড্ডি।  

তার মতে, ভারতকে কোভিড পরিস্থিতিকে দেখতে হবে ‘ওয়েক আপ কল’ হিসেবে, যেন দেশটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে শক্তিশালী করতে সেখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগে যায়।

কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমেনি

ভারতের শ্রমশক্তির অর্ধেকেরও বেশি কৃষিখাতে থাকলেও জিডিপিতে এর অবদান তুলনামূলক অনেক কম।

বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই দেশটির কৃষিখাতের সংস্কারের বিষয়ে একমত। গত বছর মোদী সরকার বাজারপন্থি বেশ কয়েকটি আইন পাস করলেও ক্ষুব্ধ কৃষকদের কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভের মুখে এর বাস্তবায়ন আটকে আছে।

এসব আইন তাদের আয় আরও সংকুচিত করবে বলে ভাষ্য কৃষকদের।

অন্যদিকে কৃষি আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া মোদী বলছেন, কৃষকদের এ উৎকণ্ঠা বাস্তব নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের টুকরো টুকরো সংস্কারে ভারতের অর্থনীতির খুব একটা লাভ হবে না। এর বদলে সরকারের উচিত কৃষি যেন আরও সাশ্রয়ী ও লাভজনক হয় সেজন্য ব্যয় করা, বলেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আর রামকুমার।

“নোট বাতিল সরবরাহ চেইনকে ধ্বংস করে দিয়েছে, এর মধ্যে কিছু ক্ষতি তো অপূরণীয়। জিএসটি ২০১৭ সালে সব পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২০ সালের ক্ষত (কোভিড লকডাউনের কারণে সৃষ্ট) নিরাময়েও সরকার খুব সামান্যই করেছে,” বলেছেন তিনি।

অর্থনীতিবিদ রানাডি বলছেন, সংকটের সমাধান কিছুটা কৃষির বাইরেই আছে।

“কৃষি তখনই ভালো করবে যখন অন্যান্য খাতও উদ্ধৃত শ্রমকে টানতে সক্ষম হবে,” মত তার।

এটা তখনই ঘটবে যখন ভারত বেসরকারি বিনিয়োগে পুনরুত্থান দেখবে, যা এ মুহুর্তে ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বলে জানাচ্ছে সিএমআইই; মোদীকেও সম্ভবত তার শাসনামলে সবচেয়ে বড় এ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করতে হচ্ছে।