বিবিসি জানার চেষ্টা করেছে, ঠিক কী ঘটেছিল গত ফেব্রুয়ারিতে, যখন ভারতের উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় হিমালয় পর্বতমালার বরফে মোড়ানো একটি বিশাল পাথরখণ্ড নিচের উপত্যকায় আছড়ে পড়েছিল।
ওই ঘটনায় ঋষিগঙ্গার কাছে কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত তপোবন বিষ্ণুগাদ হাইড্রোলিক পাওয়ার প্রজেক্ট ধ্বংস হয়ে যায়, অলকনন্দা ও ধউলিগঙ্গা নদীতে দেখা দেয় প্রবল বান। পানির তোড়ে পাঁচটি ঝুলন্ত সেতু আর বহু ঘরবাড়ি ভেসে যায়, প্রাণ যায় দুইশর বেশি মানুষের।
ভয়ঙ্কর ওই ঘটনার ভিডিও অনেকেই সে সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছেন। দানবীয় পানির দেয়াল বিপুল শক্তি নিয়ে নেমে যাচ্ছে ভাটির দিকে, ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পথে যা পাচ্ছে সবকিছু।
পঞ্চাশ জনের বেশি গবেষকের একটি আন্তর্জাতিক দল চামোলি বিপর্যয় নিয়ে সম্প্রতি একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। স্যাটেলাইটের ছবি, মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ আর বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে সেখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে- কতটা ভয়ঙ্কর ছিল প্রকৃতির সেই প্রতিশোধ।
গবেষকরা হিসাব করে বের করেছেন, প্রায় ২ কোটি ৭০ লাখ ঘন মিটার পাথর আর বরফ নেমে এসেছিল মাত্র এক মিনিটের ওই যাত্রায়। এক পর্যায়ে তা মুক্তভাবে উপত্যকায় নেমে আসে।
যে পরিমাণ পাথর আর বরফের কথা বলা হচ্ছে, আয়তন হিসাবে তা মিশরের গিজার গ্রেট পিরামিডের ১০ গুণ।
ওই পরিমাণ ভর যখন নিচে রোন্তি গাদ উপত্যকার মাটিতে আঘাত করল, তাতে হিরাশিমায় ফেলা আনবিক বোমার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি শক্তি তৈরি হয়েছিল।
গবেষক দলের প্রধান কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিগ্যারির ড. ড্যান শুগার বিবিসিকে বলেন, ওই ধসে পাথর ও বরফের অনুপাত ছিল ৮০:২০। প্রায় দুই কিলোমিটার উঁচু থেকে নামার সময় পাথরে-পাথরে ঘর্ষণে প্রবল তাপ সৃষ্টি হয়, তা সঙ্গে থাকা বরফ গলে পানিতে পরিণত করে।
বরফ গলে পানি হয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ, সে কারণেই বিপর্যয়ের মাত্রা বড় হয়েছে। তা না হলে এটা আর দশটা পাহাড় ধসের মতই হত।
বিপুল পরিমাণ পাথর আর পানি উপত্যকায় আঘাত হানার পর চারদিকে বৃষ্টির মত ছিটকে পড়ে লাখ লাখ বোল্ডার, যার কোনো কোনোটি ১০ মিটারের বেশি চওড়া। আর তাতে বাতাসে যে চাপ সৃষ্টি হয়, তা কাছাকাছি থাকা ২০ হেক্টর বনাঞ্চলকে পুরোপুরি মাটিতে মিশিয়ে দেয়।
পাহাড় ধসের ক্ষেত্রে উপর থেকে আছড়ে পড়া পাথরের বেশিরভাগ অংশ উপত্যকায় পতনের স্থানেই থেমে যায়। তবে চামোলিতে তা হয়নি। কংক্রিটের জন্য সিমেন্ট-বালি-খোয়ার মিশ্রন যেভাবে ঢেলে দিলে গড়িয়ে যায়, এক্ষেত্রেও পাথর, পানি আর আবর্জনার স্তূপ ভাটির দিকে গড়াতে থাকে।
ওই ঢল যখন ১৫ কিলোমিটার দূরে ঋষিগঙ্গায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আঘাত হানে, তখন এর সম্মুখভাগের গতি ছিল সেকেন্ডে ২৫ মিটার, বা ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটার। অর্থাৎ, ওই ঢল তখন ছুটছিল একটি দ্রুতগতির গাড়ির সমান গতি নিয়ে। আরও ১০ কিলোমিটার দূরে তপোবন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে আঘাত করার সময় এর গতি ছিল সেকেন্ডে ১৬ মিটার।
এই বিপর্যয়ে যাদের প্রাণ গেছে, তাদের অধিকাংশই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে হয় কাজ করছিলেন, অথবা সেখানে পরিদর্শন করছিলেন। কী ধেয়ে আসছে, তার কোনো সতর্কবার্তা তারা পাননি।
কিন্তু গবেষক দলটি ওই ধারণা বাতিল করে দিয়েছে। যে জায়গায় ওই ঘটনা ঘটেছে, সেখানে এরকম কোনো পানির উৎস তারা চিহ্নিত করতে পারেননি।
ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি বড় প্রশ্ন উঠেছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো প্রভাব এই বিপর্যয়ের পেছনে আছে কিনা।
এর জবাবটি সরল নয়। গবেষকরা বলছেন, কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনার জন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী বলে দেওয়া যায় না। তবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে তামপাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমালয় পর্বতমালায় পর্বত খণ্ড খসে পড়ার হারও বেড়েছে।
সায়েন্স ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাদের গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, “হিমবাহের সংকোচন পর্বতের পাঁজরগুলো উন্মুক্ত ও অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এর তলায় থাকা পাথরের জলজ ও তাপীয় ব্যবস্থাকে দারুণভাবে পরিবর্তিত করেছে।”
“তবে আমরা যেটা জানতে পেরেছি, খসে পড়া ওই পথরখণ্ড চার বছর আগে থেকেই স্থানচ্যুত হওয়া শুরু করেছিল। স্যাটেলাইটের পুরনো ছবি ঘেটে ওই পথরখণ্ডের বেশ কিছুটা সরে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুর্ভাগ্য হল, সেটা মানুষের চোখে পড়ার উপায় ছিল না।”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ঘটনা উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য ভবিষ্যতের কী বার্তা দিচ্ছে?
ভারতের ওয়াটার পলিসি বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক কবিতা উপাধ্যায় বলেন, এ ধরনের অঞ্চলে বড় অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও বিস্তারিত চিন্তা ভাবনা করা দরকার। কেবল ভূমিধস নয়, বন্যা ও ভূমিকম্পও এসব অঞ্চলের নিয়মিত ঘটনা।
তিনি জানান, এই জলবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো এবারই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এরআগে ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৬ সালের বন্যার সময়ও ক্ষতি হয়েছিল।
“উঁচু পার্বত্য এলাকায় ব্যয়বহুল অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে আমরা যে ঝুঁকিগুলো যথাযথভাবে বিবেচনায় নিচ্ছি না, চামোলির বিপর্যয় আমাদের সেটাই বলে গেল।”
এই গবেষকের ভাষায়, যখন সবকিছু স্থিতিশীল, তখনও এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণে ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। আর জলবায়ুর পরিবর্তন তাকে আরও অনেক বাজে দিকে নিয়ে যেতে পারে।
“আমাদের এই ঝুঁকির বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে, না হলে এ ধরনের প্রকল্পের ফলে মানবিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশের ক্ষতি আমরা কেবল বাড়তেই দেখব।”
পুরনো খবর: