কোভিড: তিন দিন, ছয়টি হাসপাতাল এবং বাবাকে বাঁচানোর লড়াই

ভারতের হাজার হাজার মানুষের মত উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের ৫৯ বছর বয়সের অনুপ সাক্সেনা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। হাসপাতালে তার চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2021, 07:46 PM
Updated : 18 May 2021, 07:46 PM

অনুপকে বাঁচাতে তার পরিবার যে লড়াই করেছে, ভারতের লাখ লাখ পরিবারকে সেই একই লড়াই করতে হয়েছে বা হচ্ছে।

বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে অনুপকে বাঁচাতে তার পরিবারের লড়াইয়ের ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

কোভিড পরীক্ষার জন্য লড়াই:

গত ২৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার অনুপের জ্বর ‍অনেক বেড়ে গেলে চিকিৎসক তাকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার পরামর্শ দেন। অনুপের পরিবার প্রথমে বাসা থেকে তার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ল্যাব থেকেই জনবলের অভাবের কথা বলে বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ সেবা বন্ধ রাখার কথা জানায়।

বাধ্য হয়ে অনুপের পরিবার তাকে একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। যেখানে তাদের লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। অনুপের ছেলে তুষার বিবিসি’কে বলেন, ‘‘আমার মনে হচ্ছিল লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে ঠেলে সরিয়ে দেই। কিন্তু তাদের প্রত্যেকেই গুরুতর অসুস্থ ছিল।”

ঘণ্টা দুই পর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই ‍অনুপ জ্ঞান হারান। ওই অবস্থায় আর অপেক্ষা না করে তুষার বাবাকে বাড়িতে নিয়ে যান।

শ্বাসকষ্ট শুরু:

দুইদিন পর শনিবার (১ মে) সকালে ঘুম থেকে উঠে অনুপ জানান তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

পরিবারের লোকজন একটি নেবুলাইজারের ব্যবস্থা করে। যাতে তার সাময়িক আরাম হয়। কিন্তু অনুপের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করে। ওই দিন সকাল ১০টার দিকে চিকিৎসকরা অনুপকে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন।

পরিবার থেকে প্রথমে একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা হয়। কারণ, তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। সেটা না পেয়ে তারা তাদের এক আত্মীয়কে তার গাড়িটি দেওয়ার ‍অনুরোধ করে। যিনি গাজিয়াবাদ থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে বাস করেন।

দুপুর ২টার দিকে ওই আত্মীয় তার গাড়ি নিয়ে গাজিয়াবাদের অশোক নগরে অনুপদের বাড়িতে আসেন। কিন্তু কোনও হাসপাতালে শয্যা ‍খালি পাওয়া যাচ্ছিল না।

বিকাল ৪টার দিকে অনুপের পরিবার তাকে গুরদুয়ার শ্রী গুরু সিং সভা মন্দিরে নিয়ে যায়। যেখানে তাকে একটি সিলিন্ডার দিয়ে অক্সিজেন দেয়া শুরু হয়। ওই মন্দিরে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিনামূল্যে অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

হাসপাতালে ভর্তির আশায় ছোটাছুটি:

অক্সিজেন দেওয়ার পর ‍অনুপের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু মন্দিরের স্বেচ্ছাসেবকরা তার পরিবারকে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। বলেন, অনুপের জন্য অনির্দিষ্টকালের অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। বাবাকে বাঁচাতে তুষার তাদের হাতে-পায়ে ধরেন। কিন্তু এটাও জানতেন, বাবার জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা তাকে খুঁজে পেতেই হবে।

অনুপকে তার পরিবার রাজ্য পরিচালিত এমএমজি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর তারা বুঝতে পারে, সহসা সেখানে কোনো শয্যা খালি হবে না।

রাত ৮টার দিকে তুষার তার ভাইকে ফোন করে যেভাবে হোক একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করতে বলেন। তুষারের ভাই লাল কুয়ান এলাকায় অক্সিজেন প্ল্যান্টের সামনে লম্বাই লাইনে গিয়ে ‍দাঁড়ায়। দুই ভাইয়ের আশঙ্কা, ‍অক্সিজেন সিলিন্ডার না পেলে রাতেই হয়তো বাবা মারা যাবেন।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে তুষার তার বাবাকে বাড়িয়ে ফিরিয়ে আনেন এবং ২৫টি ছোট ছোট অক্সিজেনের ক্যান কেনেন। প্রতিটি ক্যানের দাম আড়াই হাজার রুপি। অথচ, সাধারণ সময়ে এগুলোর দাম এক হাজার রুপিরও কম।

ওই সব ক্যানে যে সামান্য পরিমাণ অক্সিজেন থাকে তা দিয়ে খুব বেশিক্ষণ কাজ চালানো সম্ভব না। তাছাড়া, তুষারদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য ক্যানের দামও অনেক। কিন্তু তাদের সামনে আর ‍কোনো পথ খোলা ছিল না।

তুষার ক্যানের অক্সিজেন দিয়েই তার বাবার অবস্থা স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছিলেন। আর তার ভাই অক্সিজেন সিলিন্ডার পেতে লাইনে দাঁড়িয়ে তার পালা আসার অপেক্ষায় ছিল।

কিন্তু মধ্যরাতের পর (রাত ১টার দিকে) তার ভাই খালি হাতেই ফেরত আসে। কারণ, তার পালা আসার আগেই প্ল্যান্ট থেকে অক্সিজেন দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ক্যানের অক্সিজেন দিয়ে অনুপকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল তার ছেলেরা। কিন্তু তার অবস্থা প্রতিমুহূর্তে খারাপ হতে থাকে।

যে করেই হোক হাসপাতালে একটি শয্যা চাই:

পরদিন (২ মে) রোববার সকাল ১০টার দিকে চিকিৎসক আবারও অনুপের পরিবারকে তাকে হাসপাতালে নিতে বলেন। তারা তাকে কাছের গার্গি হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু হাসপাতালকর্মীরা তাদের অন্য কোথায় চেষ্টা করতে বলেন। কারণ, তাদের ওখানে শয্যা খালি নেই।

অনুপকে সার্বযোগ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেও একই অবস্থা, শয্যা খালি নেই। ততক্ষণে অনুপর শ্বাসকষ্ট চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। তিনি তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন। যদিও তার পরিবার তখনই হাল ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না।

দুপুর ১২টার দিকে অনুপকে সন্তোষ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলা হয়। সেখানে ১০ মিনিট অপেক্ষা করার পর অনুপকে অন্য একটি হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তার পরিবার। উদ্বিগ্ন ‍তুষার তখন ভাবছিলেন কোন হাসপাতালে তার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। তার মধ্যেই তার মা ফোনে জানান, তিনি হাসপাতালে একটি শয্যার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তারা ওই হাসপাতালে পৌঁছান। ওই হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী তাদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। বলেন, যদি কেউ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায় বা মারা যায় তবেই কেবল তাদের ভর্তি নেওয়া হবে। তুষার ভাবতেই পারছিলেন না, কারও মৃত্যুই কেবল তার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারে।

এদিকে ক্যানের অক্সিজেন শেষ হওয়ার পথে। অনুপের শ্বাসকষ্টও মারাত্মক বেড়ে গেছে। দুপুর ২টার দিকে অক্সিজেনের অভাবে অনুপ প্রায় মরতে বসেছেন। ফলে তার পরিবার আর অপেক্ষা না করে তাকে আবার গুরদুয়ারে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে একটি সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন দেওয়ার পর অনুপের রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা আবার বাড়তে শুরু করে।

তুষার যখন তার বাবাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছিল তখন তার ভাই অক্সিজেন সিলিন্ডারের আশায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু সেই লাইনও যে অনেক লম্বা। লাইনে একজন তাকে এক ঘন্টা দূরের শহর বুলান্দশাহর কথা বলে। যেখানে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে।

তুষারের ভাই সেখানে যেতে যেতেই বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তুষারের ভাই গাজিয়াবাদ ফিরে আসেন এবং কালোবাজার থেকে পাঁচ লিটারের একটি ছোট সিলিন্ডার কেনেন।

শেষ চেষ্টা:

হাসপাতালে একটি শয্যার খোঁজে আট ঘণ্টা ধরে চেষ্টা করছে অনুপের পরিবার। অনুপ তখনও গুরদুয়ারে। তার মধ্যে অনুপের মেয়ে ফোনে জানায়, গাজিয়াবাদ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে আলিগড়ে তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালে একটি শয্যার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে অনুপের পরিবার ছোট একটি সিলিন্ডারের ভরসায় তাকে নিয়ে আলিগড়ে রওনা হয়।

রাত সাড়ে ৮টার দিকে তারা ওই হাসপাতালে পৌঁছায় এবং অনুপকে সঙ্গে সঙ্গে আইসিইউ’তে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানান, অনুপের অবস্থা গুরুতর এবং তার বেঁচে যাওয়ার আশা খুবই কম।

হেরে যাওয়া লড়াই:

সোমবার ভোর ৪টার দিকে চিকিৎসকরা অনুপের পরিবারকে জানান তার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে, তারা যেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। তারও ছয় ঘণ্টা পর সকাল ১০টার দিকে চিকিৎসকরা অনুপের পরিবারকে ডেকে তাকে শেষ দেখা দেখতে বলেন। ১১টার দিকে অনুপ মারা যান।

তুষার বলেন, তারা বাবা অক্সিজেনের অভাবে এতটা কষ্ট পেয়েছেন, যেমনটা মাছকে পানি থেকে তুলে রেখে দিলে হয়। ‘‘কোভিড নয়, ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে”, বলেন তিনি।

বাবার মৃত্যুর শোক পালন করার সুযোগও পাননি তুষার। গাজিয়াবাদ ‍থেকে খবর আসে তার মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। তাই আবার গাজিয়াবাদের পথ ধরতে হয় তাকে।