মানবদেহে নতুন বার্ড ফ্লুর সংক্রমণ নিয়ে ‘এখনই দুশ্চিন্তার কিছু নেই’

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে চলতি বছরের শুরুতে মানবদেহে বার্ড ফ্লু ভাইরাসের একটি ধরনের সংক্রমণ নিয়ে খানিকটা উদ্বেগ দেখা দিলেও আপাতত এ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে বলে মত দিয়েছেন বেশিরভাগ বিজ্ঞানী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 April 2021, 12:03 PM
Updated : 22 April 2021, 12:03 PM

রাশিয়ায় বছরের শুরুতে বড় একটি পোল্ট্রি খামারে এইচ৫এন৮ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর সংক্রমণ মোকাবেলায় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ৮০ হাজার মুরগি হত্যা করে সেগুলোকে মাটিতে পুঁতে ফেলেছিল। খামারটিকে করা হয়েছিল পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত।

কেবল হাঁস-মুরগি বা পাখিই নয়, মানবদেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ নিশ্চিত হতে কর্তৃপক্ষ সেসময় ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালায় বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

বার্ড ফ্লুর এ এইচ৫এন৮ ধরনটি বন্য ও গৃহপালিত পাখির জন্য খুবই বিপজ্জনক। এশিয়ায় প্রথম দেখা গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপে পাখিদের মধ্যে ভাইরাসটির প্রাণঘাতী প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কিছু পোল্ট্রি খামারেও এইচ৫এন৮ সংক্রমণের ঘটনা দেখা গেছে, যদিও সেখানকার ধরনের সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপে পাওয়া ধরনের পার্থক্য আছে। 

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিন সপ্তাহে ইউরোপ ও এশিয়ায় এইচ৫এন৮ প্রাদুর্ভাবে প্রাণ হারিয়েছে ৭০ লাখেরও বেশি পাখি।

ইউরোপের পোল্ট্রি খামারগুলোতে এভিয়ান ফ্লুর এ ধরনটির ১৩৫টি প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে, বন্য পাখিদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ৩৫টি প্রাদুর্ভাব।

তবে এই এইচ৫এন৮ ভাইরাস পাখিদের ক্ষেত্রে যত বিপজ্জনকই হোক না কেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত মানবদেহে এর সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি।

রাশিয়ার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ আস্ত্রাখানের যে খামারে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল, তা পরিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত প্রায় ২০০ মানুষের মধ্যে ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্তে নাক থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এবং পরে রক্তে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পাওয়া যায় কিনা, তা দেখতে পরীক্ষা চালায়। 

তাদের প্রতিবেদনেই প্রথম মানবদেহে এইচ৫এন৮ সংক্রমণের তথ্য মেলে। শনাক্তকরণ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৭ কর্মী ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে ধারণার কথাও জানায় তারা, তবে এদের কেউই অসুস্থ হননি।

পরে ‘জেনেটিকালি সিকোয়েন্সিং’ এর মাধ্যমে ওই ৭ জনের একজনের দেহে ভাইরাসটির উপস্থিতিও নিশ্চিত হওয়া যায়। 

ভাইরাসটির সম্ভাব্য বিপদ ও মানবদেহে এর উপস্থিতি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারী বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসক ড. ডেনিয়েল আর লুসিকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়।

আস্ত্রাখানের ঘটনা জনসমক্ষে আসার পরপরই তিনি ব্লগে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞদের জন্য এ নিয়ে লিখতে শুরু করেন। 

এইচ৫এন৮ ভাইরাসটি সম্ভবত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার মতো বিবর্তিত হয়েছে- এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার এক জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা এমনটা বলেছিলেন বলেও জানান লুসি। রুশ কর্মকর্তার ওই মন্তব্য জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মহামারী বিশেষজ্ঞকে আতঙ্কিত করে তোলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৬ ফেব্রুয়ারিতে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেয়। তাদের প্রতিবেদনে আস্ত্রাখানের ঘটনা নিয়ে ‘বিশেষভাবে সতর্ক’ করা হয়নি।

প্রতিবেদনে মানুষ থেকে মানুষে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি খুব কম বলেও ধারণা দেওয়া হয়।

নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এইচ৫এন৮ নিয়ে লুসি যতটা উদ্বিগ্ন অন্য বিজ্ঞানীরা ততটা নন। 

মাউন্ট সিনাইয়ের আইকান স্কুল অব মেডিসিনের ফ্লু বিষয়ক গবেষক ড, ফ্লোরিয়ার ক্রামার জানান, তিনি এইচ৫এন৮এর চেয়েও এইচ৫এন১ এর মতো এভিয়ান ফ্লু ভাইরাসগুলো নিয়ে বেশি চিন্তিত, যেগুলো এরই মধ্যে মানুষের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে।

আরেকটি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, এইচ৭এন৯। এর মানবদেহে সংক্রমণের বিষয়টি ২০১৩ সালে প্রথম জানা যায়। এরপর থেকে ভাইরাসটিতে দেড় হাজারের বেশি আক্রান্ত এবং ৬০০র বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

অবশ্য ২০১৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজনের দেহে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে; এটি সহজে একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে স্থানান্তরিতও হয় না।

ক্রামার বলছেন, যে কোনো ভাইরাসের পক্ষেই মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে সক্ষম এমন পর্যায়ে পৌঁছানোর সক্ষমতা অর্জন এবং আরও বিপজ্জনক হয়ে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্য ভাইরাসের হুমকির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এইচ৫এন৮কে সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে এ দুটো ‘হার্ডলই’ অতিক্রম করতে হবে।

সেইন্ট জুড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বায়োমেডিকেল সায়েন্সেসের ফ্লু বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোলাবোরেটিং সেন্টার ফর স্টাডিজ অন দ্য ইকোলজি অব ইনফ্লুয়েঞ্জা ইন এনিমেলস অ্যান্ড বার্ডসের পরিচালক ড. রিচার্ড জে ওয়েবি বলেছেন, সব এইচ৫ ভাইরাস নিয়েই উদ্বেগ আছে, কেননা সেগুলোর কোনো কোনোটির মানুষকে আক্রান্ত করা ও প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে।

কিন্তু এ সবগুলোরই মানব কোষের সঙ্গে জুড়ে যাওয়ার ক্ষমতা সীমিত, বলেছেন তিনি।

ফ্লু ভাইরাস পাখির কোষে যেভাবে সংযুক্ত হয়, মানব কোষে সেভাবে হয় না।

ওয়েবি আরও বলেন, রাশিয়ায় কেবল একজনের শরীরেই ভাইরাসটির উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্য ৬ জনের দেহে ভাইরাসের উপস্থিতির সম্ভাব্যতার পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে তাদের নাক থেকে নেওয়া নমুনা ও রক্তে অ্যান্টিবডির পরীক্ষা।

তার মতে, কারও দেহে কোনো উপসর্গ দেখা না যাওয়ায় নাক থেকে নেওয়া নমুনায় ভাইরাসের উপস্থিতি ইঙ্গিত করছে, শ্বাসের মাধ্যমে তাদের দেহে ভাইরাসটি প্রবেশ করেছিল; কিন্তু তারা এতে সংক্রমিত হননি।

রক্তে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনাও কম নয়, তাছাড়া এর মাধ্যমে কোনো একটি ফ্লু ভাইরাসকে অন্য ভাইরাস থেকে আলাদা নাও করা যেতে পারে, বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোলাবোরেটিং সেন্টার ফর স্টাডিজ অন দ্য ইকোলজি অব ইনফ্লুয়েঞ্জা ইন এনিমেলস অ্যান্ড বার্ডসের এ পরিচালক।

লুসি জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন মানবদেহে এইচ৫এন৮ সংক্রমণ মোকাবেলায় একটি ‘ক্যান্ডিডেট’ বা প্রার্থী ভ্যাকসিন বানিয়েছে দেখে তিনি আপ্লুত হয়েছেন।

সম্ভাব্য কোনো সংকট মোকাবেলা করার পরিকল্পনার প্রথম ধাপে এ ধরনের ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিন বানানো হয়, এটিকে ব্যাপক যাচাই বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতেও হয় না। অনেক ভাইরাসের জন্যই এ ধরনের ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিন আছে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।

“মানবদেহে এই ধরনের ভাইরাসের উপস্থিতি সংক্রান্ত পরীক্ষা নিয়মিত হওয়া উচিত, বিশেষ করে পাখিদের মধ্যে যখন এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায় তখন,” বলেছেন লুসি।

রুশ কর্তৃপক্ষ আস্ত্রাখানের খামারের ঘটনায় যেসব পদক্ষেপ অনুসরণ করেছে তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এ মহামারী বিশেষজ্ঞ বলছেন, যখনই পাখিদের মধ্যে ভাইরাসের কোনো প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে, তখন ওই অসুস্থ পাখিদের সংস্পর্শে আসা মানুষদের দেহেও ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্তে পরীক্ষা হওয়া উচিত।

জার্নাল ট্রাভেল মেডিসিন অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজের প্রকাশিত হতে যাওয়া সম্পাদকীয়তে এবার আস্ত্রাখানের ঘটনাটির উল্লেখ থাকবে বলে জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। সম্পাদকীয়তে সব এইচ৫ ভাইরাস নিয়ে নজরদারি আরও বাড়ানোর আহ্বানও জানানো হবে, বলেছে তারা।