দীর্ঘপ্রতিক্ষীত এই রায়ে ফ্লয়েডকে হত্যার অভিযোগে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় পর আদালতের বাইরেসহ বিভিন্ন স্থানে উল্লাস করতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তের নানা শ্রেণীর মানুষের মতামত তুলে ধরে বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এবং আইনজীবীদের মাঝেও সন্তোষ দেখা গেছে। জেগে উঠেছে পরিস্থিতি বদলানোর আশা।
ঘুরে দাঁড়াবে যুক্তরাষ্ট্র?
কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ওপর পুলিশের সহিংসতার বিরুদ্ধে জর্জ ফ্লয়েড হত্যা মামলা এক মাইলফলক। মিনেসোটার হেনেপিন কাউন্টির আদালত ‘সেকেন্ড ডিগ্রি’, ‘থার্ড ডিগ্রি’ খুন ও নরহত্যার অভিযোগে শভিনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। পুলিশ ব্যবস্থায় সংস্কারের জন্য যারা আওয়াজ তুলেছেন, এ মামলার রায় তাদের জন্য এক বড় ধরনের জয়।
মিনেয়াপলিস এবং সেন্ট পলে আইনজীবী হিসেবে কাজ করা জ্যাক রাইসের মতে, “এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, পুলিশ কর্মকর্তারা আইনের ঊর্ধ্বে নন। ভবিষ্যতে আদালতে গড়ানো এ ধরনের মামলায় এ রায় প্রভাব ফেলবে।
এটি সামান্য অপরাধ মামলার চেয়েও বড় কিছু মন্তব্য করে তিনি বলেন “সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে রাস্তায় দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের আচরণে এর প্রভাব পড়বে।”
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে রায় এল তাতে পুলিশ এখন থেকে অনেক বেশি নজরদারিতে থাকবে। কোনও অপকর্মের জন্য তাদের বিচার হওয়া এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ল।
পুলিশ কর্মকর্তারা আরও জবাবদিহিতার মুখে পড়তে পারেন, পুলিশের শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে চালু হতে পারে নতুন নিয়ম নীতি, বলছেন বিশ্লেষকরা। আবার অনেকে এ বিচারকে দেশের ব্যবস্থাপনায় কাজ হওয়ার লক্ষণ বলেও মনে করছেন।
গত বছর মে মাসে মিনেয়াপলিসের একটি দোকানের সামনে জাল নোট ব্যবহারের অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর ফ্লয়েডের ঘাড়ে পুলিশ কর্মকর্তা শভিনের (৪৫) হাঁটু গেড়ে বসে থাকার ৯ মিনিটের ভিডিও সাড়া বিশ্বে সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। সেসময় ফ্লয়েড বারবারই ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’ বলে আকুতি জানালেও তা মন গলাতে পারেনি তাকে আটক করা পুলিশ কর্মকর্তার।
ওই ঘটনায় ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর বর্ণবাদ ও পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
সোমবার সেই হত্যা মামলায় জুরিদের রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আদালতের বাইরে কয়েকশ মানুষ বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠেন। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে দ্রুত এই খবর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। যুগান্তকারী এই রায়ের খবর রাখতে মোবাইল ফোন কিংবা টিভিতে সরাসরি নজর রাখছিল মানুষ।
এমনকী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনেও নিবিড়ভাবে এদিকে নজরে রেখেছিলেন। রায়ের পরই তিনি ফ্লয়েডের পরিবারকে ফোন করেন। তার মুখেও শোনা গেছে আশার কথা। যুক্তরাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের যাত্রাপথে এ রায় এক বড় ধরনের অগ্রগামী পদক্ষেপ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ফ্লয়েডের পরিবারের সঙ্গে ফোনকলে বাইডেন বলেন, “এখন অন্তত কিছুটা হলেও সুবিচার তো হয়েছে।” তবে ‘এখানেই থেমে থাকলে চলবে না’ সেকথাও বলেছেন তিনি।
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মী ১৯ বছর বয়সী রোজা গোমেজ মামলার রায়ের খবরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “এটা অনেক বড় একটা পরিত্রাণ দিয়েছে।” বাসায় থাকা অবস্থায় খবর পেয়ে আরেক আন্দোলনকর্মী এরিকা অ্যাটসন বলেন, “আমি খুশি, আসলে দারুণ খুশি।”
এই মামলার কার্যক্রম চলার সময় কয়েক সপ্তাহ ধরে মিনেয়াপলিসে নানা শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলেছেন বিবিসি’র সাংবাদিক। তাদের নানা মত পাওয়া গেলেও সবাই মনে করেন, এই অভিজ্ঞতা তাদের পাল্টে দিয়েছে।
তবে মিনেসোটার হেনেপিন কাউন্টির সাবেক শেরিফ রিচ স্টানেক জানিয়েছেন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া।মামলার রায়ে তিনি ও তার সহকর্মীরা অবাক হননি। রায় ঘোষণার সময় আইডাহোয় আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের সাথে একটি কনফারেন্সে ছিলেন স্টানেক। সেখানে কোনও উল্লাস হয়নি বরং লোকজন ছিল গম্ভীর মেজাজে।
এই মামলায় মিনেয়াপলিসের পুলিশ প্রধানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারাও ডেরেক শভিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, কাউকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি সাধারণের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। যে কোনও সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
১৯৯০ সালে সেনাবাহিনীতে শভিনের ঊর্ধ্বতন পদে থাকা জেরি ওবিয়েগলো জানান, ফ্লয়েডকে মাটিতে চেপে ধরা শভিনের ভিডিও দেখে তিনি মর্মাহত হয়েছেন। তাকে বেশ শান্ত বলেই জানতেন তিনি। তবে রায়ে শভিনের বিরুদ্ধে হত্যা ছাড়াও তিন দফায় অভিযুক্ত করার বিষয়টি উল্লেখ করে জুরিদের যথার্থ বিবেচনা পাননি বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
আন্দোলন আর উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ প্রচারের কারণে জুরিরা চাপের মধ্যে ছিলেন বলেও অভিমত তার। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় আজ রাতে যেন তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া না হয় তার নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন তারা।”
২০২০ সালের মে মাসে ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক লুটতরাজ, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনকর্মী এরিকা অ্যাটসন বলেছেন, “আমি জানি যে সহিংসতাই উত্তর নয়, কিন্তু আমরা কতটা সময় পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ থাকতে পারি? এখনও আমি মনে করি, সহিংসতাকে আমাদের ব্যবহার করতে হবে। আমাদের সরকারি ভবন ধ্বংস করতে হবে। আমার খারাপ লাগে যখন আমি সেসব করি, কিন্তু আমি এটাও মনে করি- এটা আমাদের করতেই হতো।”
কয়েকশ মাইল দূরে আইওয়ার একজন কৃষিকর্মী তার খামার থেকে থেকে ফ্লয়েড হত্যা মামলার রায় শোনার পর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে বলেছেন, মাটিতে ফেলে ফ্লয়েডের ঘাড়ে চেপে বসা শভিনের ভিডিওটা দেখে তিনি খুবই মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন।
পুলিশের এমন বর্বরতার বিষয়টি তার জানা ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এমনটাই সবসময় হয়। এ বিষয়ে আমার যতটা ভাবা উচিত ছিল, ততটা ভাবিনি। তাই আমার মনে হয় এটা এক ধরনের জেগে ওঠার ডাক।”
এ বিষয়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন কর্মী রোজা গমেজ একটি বিলবোর্ডের লেখার স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমরা জাতিবিদ্বেষের যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছি না। আমরা এর ইতি টানার চেষ্টা করছি।”
বিবিসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, এমন আরও অনেকের কাছেই এই মামলার রায় সেই পথযাত্রারই একটি পদক্ষেপ।