কোভিড-১৯: দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে যে কারণে ব্যর্থ ভারত

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘বিজয় উল্লাস’ প্রকাশের দুই মাসের মধ্যেই মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারত। হু হু করে বাড়তে থাকা আক্রান্তের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2021, 09:26 AM
Updated : 19 April 2021, 09:26 AM

কোভিড- ১৯ নিয়ন্ত্রণে ‘দম্ভ’ প্রকাশ করে নীতিনির্ধারকদের নানা ‘অবাস্তব’ সিদ্ধান্তই এমন পরিণতি এনেছে বলে বিবিসির বিশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

দেশটিতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে দৈনিক আক্রান্তের গড় ১০ হাজারের অঙ্ক ছাড়িয়ে এপ্রিলে এসে লাফিয়ে পার হয়ে যায় দুই লাখের ঘর। স্বজনদের স্তব্ধ করে দিয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়ায় দেড় হাজার।

পরিসংখ্যান আর ঘটনাপ্রবাহের তুলনা করে ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের এমন উল্লফনের পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখেছে বিবিসি।

মার্চের শুরুতেই ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন কোভিড- ১৯ মহামারি বিরুদ্ধে ‘শেষ খেলা’ চলছে বলে ঘোষণা করেন। তার এমন আশাবাদ খতিয়ে দেখা যায়, গত বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি দৈনিক আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার। পরের মাসগুলোতে তা কমে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি হয় দিনে ১১ হাজার। তখন সপ্তাহে গড় মৃত্যু ছিল একশ’রও নিচে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষ দিকে দেশটির রাজনৈতিক নেতা, নীতি-নির্ধারক এবং গণমাধ্যমের একটা অংশ ধরেই নিয়েছিল করোনাভাইরাস মহামারী থেকে বেরিয়ে এসেছে ভারত।

ডিসেম্বরে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, “কোভিড সংক্রমণের ঢেউকে অবনমিত করছে ভারত।”

এমনকি কাব্য করে বলা হয়, “শীতের দীর্ঘায়িত ছায়া ছিন্ন করে সূর্যালোকের পথে অর্থনীতি।”

ফেব্রুয়ারির শেষে ভারতের নির্বাচন কমিশন পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণা করে। এই নির্বাচনে ৮২৪টি আসনে ভোটার সংখ্যা ১৮ কোটি ৬০ লাখ।

২৭ মার্চ শুরু হয়ে এক মাসের এই নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ভোট নেয়া হয় আট দফায়। কোনো ধরনের সতর্কতা ও সামাজিক দূরত্ব না মেনে এসময় পূর্ণ মাত্রায় নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়।

মার্চের মাঝামাঝি গুজরাটে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে দুটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ দেখার অনুমোদন দেয় ক্রিকেট বোর্ড। সেখানে এক লাখ ৩০ হাজার ক্রিকেট অনুরাগীর বেশিরভাগই মাস্ক ছাড়াই খেলা উপভোগ করেন।

এর এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাল্টে যায় সব। এপ্রিলের মাঝামাঝি হতেই করোনাভাইরাসে দৈনিক আক্রান্তের গড় সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ। এরপরই রেকর্ড হয় দুই লাখ ৭০ হাজার আক্রান্তের। দৈনিক মৃত্যু এক হাজার ৬০০ ছাড়িয়ে যায়।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, গোটা ভারতজুড়ে এমন মৃত্যু আর মহামারীর মধ্যেও প্রতিদিনই চলছে ব্যয়বহুল ক্রিকেট ম্যাচ। নির্বাচনী প্রচারে নেতাদের পেছনে মিছিল করছে হাজার হাজার মানুষ। লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটছে কুম্ভ মেলায়।

এসব নিয়ে দেশটির সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক শিব বিশ্বনাথ বলেন, “যা ঘটছে তা যেন পরাবাস্তব।”

ল্যানসেট কোভিড- ১৯ কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো না গেলে জুনের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ ভারতে করোনা আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যু দুই হাজার ৩০০ ছাড়াবে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে করোনার সুবিশাল টিকা কর্মসূচিও এখন বেশ কসরত করে এগুচ্ছে। গত সপ্তাহের মধ্যে ১০ কোটি টিকা দেওয়া সম্পন্ন হলেও এরই মধ্যে টিকার ঘাটতির খবর পাওয়া গেছে।

অথচ দেশটিতে থাকা বিশ্বের বৃহত্তম টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, সক্ষমতা বাড়ানোর পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় আগামী জুনের আগে তারা উৎপাদনের গতি বাড়াতে পারবে না।

এরই মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা রপ্তানি বন্ধ করেছে ভারত। অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বিদেশি টিকা আমদানিরও। এমনকি বাড়তে থাকা চাহিদা মেটাতে অক্সিজেনও আমদানি করা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রর মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব পরিসংখ্যানবিদ ভ্রমর মুখোপাধ্যায় টুইটারে জানিয়েছিলেন, “যখন সংক্রমণের মাত্রা কম ছিল তখনই টিকা কর্মসূচি বাড়ানো দরকার ছিল।”

কিন্তু যথাসময়ে এসব পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়নি বলে উল্লেখ করেছে বিবিসি।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমে আসায় সবার মধ্যে ‘বিজয়ের উল্লাস ছিল’ বলে জানিয়েছেন ‘পাবলিক হেল্থ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়া’র সভাপতি পি শ্রীনাথ রেড্ডি।

“কেউ কেউ মনে করেছে আমরা হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করেছি। সবাই চেয়েছে কাজে ফিরে যেতে। বেশিরভাগের কাছে এই বিষয়টাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, অল্প যা কিছু সতর্কবাণী ছিল সেসব শোনা হয়নি,” বলেছেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণ জনসংখ্যা, স্থানীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, বড় গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এই ধারণাগুলোর ওপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা ছিল নির্মমভাবে একটি অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের কলামনিস্ট মিহির শর্মা বলেন, “ভারতে যে বিষয়গুলো সচরাচর দেখা যায়, কর্মকর্তাদের ঔদ্ধত্য, উগ্র-জাতীয়তাবাদ, জনপ্রিয়তার জন্য মুখিয়ে থাকা এবং অনেক বেশি আমলাতান্ত্রিক অযোগ্যতা, এসব মিলেই এই সংকট তৈরি করেছে।”