কোভিড-১৯: ভারতে ওষুধের ঘাটতি, মরিয়া রোগীরা কালোবাজারে

শনাক্ত রোগীর সংখ্যায় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভারতে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় জরুরি অনুমোদন পাওয়া বেশকিছু ওষুধের ঘাটতি থাকলেও কালোবাজারে তা কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বলে বিবিসির এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2021, 10:46 AM
Updated : 16 April 2021, 05:49 PM

রাজধানী দিল্লিসহ দেশটির অনেক শহরেই এখন হাসপাতাল বা ওষুধের দোকানে রেমডিসিভির বা টসিলিজুমাব ওষুধ মিলছে না।

অথচ দিল্লির তিনজন এজেন্ট বিবিসির প্রতিবেদককে ২৪ হাজার রুপিতে ১০০ মিলিগ্রাম রেমডিসিভির সরবরাহে রাজি হয়েছেন; এই দাম ওষুধটির সরকার নির্ধারিত মূল্যের প্রায় ৫ গুণ।

করোনা ভাইরাসে রেমডিসিভির ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারতের চিকিৎসকরা কোভিড রোগীদের আপাতত এ ওষুধই দিচ্ছেন।

কেন্দ্রীয় সরকার ওষুধটি দেশের বাইরে রপ্তানি বন্ধ রেখেছে; এরপরও ভারতজুড়ে বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য রেমডিসিভির বানাতে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

একই অবস্থা টসিলিজুমাব ওষুধের ক্ষেত্রেও। কোভিড- ১৯ রোগীর চিকিৎসায় আর্থ্রাইটিসের এই ওষুধ কাজ করে এমন তথ্য চাউর হওয়ার পর ভারতের বাজারে আর ওষুধটি পাওয়া যাচ্ছে না।

“পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আমি আমার নিজের পরিবারের সদস্যদের জন্যও ওষুধটি যোগাড় করতে পারিনি। আমরা কালোবাজারিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি,” বলেছেন অল ইন্ডিয়া কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়শনের সাধারণ সম্পাদক রাজীব সিংঘল।

ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে রেমডিসিভিরের ছয়টি ১০০ মিলিগ্রামের শিশি সেবনের নির্দেশনা দিলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৮টি শিশি লাগে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সেক্ষেত্রে একজন রোগীকে কেবল রেমডিসিভিরের পেছনেই প্রায় দুই লাখ রুপি খরচ করতে হচ্ছে।

মধ্যবিত্ত কোনো পরিবারের পক্ষে এই খরচ যোগাড় করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন দিল্লির একটি হাসপাতালে মা’কে নিয়ে আসা অতুল গার্গ। জানালেন, কেবল অর্থই নয় মায়ের জন্য ওষুধটি যোগাড়ে কয়েক’শ ফোনের পাশাপাশি দীর্ঘ সময় উদ্বেগের মধ্যেও থাকতে হয়েছে তাকে।

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় হিমশিম খাওয়া ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে এখন আসন ও অক্সিজেনের সংকটও প্রবল। ছোট শহরগুলোর সরকারি ল্যাবে এক্সরে ও সিটি স্ক্যানের ব্যবস্থাও পর্যাপ্ত নয়।

“এটা অবিশ্বাস্য! আমি রোগীর এক্সরে করাতে পারছি না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রোগের অবস্থা বুঝতে আমাদের কেবল রক্ত পরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে,” বলেছেন তিনি।

ভারতজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এখন আক্রান্তদের বাঁচাতে পরিবারের সদস্যদের আকুতিতে ভরে উঠছে।  কোনো হাসপাতালে আসন খালি হয়েছে কিনা, সেসব হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট আছে কিনা, তার খোঁজ করছেন অসংখ্য মানুষ।

“আমার স্কুল জীবনের সেরা বন্ধু কোভিড- ১৯ আক্রান্ত। তার ফুসফুস কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে, যে হাসপাতালে সে আছে সেখানে ভেন্টিলেটর নেই। তার ভেন্টিলেটর দরকার। আহমেদাবাদে ভেন্টিলেটর সুবিধাসহ কোনো হাসপাতালে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে দয়া করে আমাকে জানান,” টুইটারে লিখেছেন অঞ্জলে জৈন নামের এক ব্যবহারকারী।

বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয় স্বজনের এ ছোটাছুটি কেবল অনলাইনেই নয়, চলছে অফলাইনেও।

অনেক খুঁজে দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করাতে পেরে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন অখিলেশ মিশ্র।

“আমিতো হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল চিকিৎসা ছাড়াই মারা যাবেন বাবা। কোনো সন্তানকেই যেন এমন পরিস্থিতির মাঝে পড়তে না হয়,” বিবিসিকে বলেছেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার তারই প্রথম জ্বর এসেছিল, সঙ্গে হালকা কাশি। একে ফ্লু ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অখিলেশ। কিন্তু পরদিন বাবারও একই উপসর্গ দেখে চিন্তায় পড়ে যান তিনি।

অনলাইনে নিবন্ধন করে দু’জনের কোভিড শনাক্তকরণ পরীক্ষার তারিখ পড়ে রোববার। কয়েকদিন পরেই অখিলেশের বাবা যোগেন্দ্রর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। চিকিৎসকরা তাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। এরপর নয়দা আর দিল্লির বিভিন্ন হাসপাতালে চলে বেডের খোঁজ। শেষ পর্যন্ত যোগেন্দ্রর স্থান হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে।

ভারতজুড়ে একই পরিস্থিতি এখন লাখ লাখ পরিবারের। সবাই হাসপাতাল খুঁজছে; সব হাসপাতালে আবার সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা নেই। বেড মিললে এরপর ওষুধের জন্য ছুটতে হচ্ছে কালোবাজারে।

গত দুইদিনে ভারতে ২ লাখের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে; সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম না টানা গেলে তা যে দেশটির স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনাকে আরও নাজুক করে তুলবে, তা অনুমানে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না।