মিয়ানমারে অভ্যুত্থান: এখন কেন? কোন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে?

মিয়ানমারে গত কয়েকদিন ধরেই সেনা অভ্যুত্থানের হুমকি বা আশঙ্কা নিয়ে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। সোমবার সেই গুঞ্জনই সত্যি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দল এনডিএল-র নেত্রী অং সান সু চি এবং প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে আটকের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতার দখল নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2021, 05:44 PM
Updated : 1 Feb 2021, 06:50 PM

ঠিক এক দশক আগে ২০১১ সালে দীর্ঘ সেনাশাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশটিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, এ ঘটনায় তা আবারও মুখ থুবড়ে পড়ল।

বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরুর পর ২০১৫ সালে মিয়ানমারে প্রথম জাতীয় নির্বাচন হয় এবং বড় জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি)। মেয়াদের পাঁচ বছরে সাংবিধানিকভাবে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেই এনএলডি দেশ পরিচালনা করেছে।

কিন্তু গোল বাধে ২০২০ সালের ৮ নভেম্বর জাতীয় নির্বাচনের ভোট ঘিরে। ওই নির্বাচনে আরও বড় জয় নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে সু চির দল এনএলডি।

সেনা সমর্থিত বিরোধী দল থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোটের ফল অস্বীকার করে নতুন নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানানো হয়। এ নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চাপা উত্তেজনা ছিল।

সোমবার নতুন সরকারের পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু এদিন ভোরেই সু চি এবং প্রেসিডেন্ট মিন্টকে আটক করে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এরপর দেশজুড়ে ঘোষণা করে এক বছরের জরুরি অবস্থা। তবে কী মিয়ানমারে আবারও জান্তা শাসন ফিরে আসতে চলেছে? কী ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে দেশটির জন্য? আর এখনই বা কেন হল অভ্যুত্থান? এসব প্রশ্নেরই জবাব খোঁজা হয়েছে বিবিসি’র বিশ্লেষণে।

এখনই কেন হল অভ্যুত্থান?

সময়টা কেন এখনই- সে ব্যাখ্যা দেওয়া সহজ। বিবিসি’র দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সংবাদদাতা জোনাথন হেড বলছেন, সোমবারই নির্বাচনের পর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল এবং তা যদি হত তাহলে নির্বাচনের ফল সুরক্ষিত থাকত। কিন্তু অভ্যুত্থানের ফলে সেটি এখন আর হবে না।

২০১৭ সালে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সেনাঅভিযানের নামে গণহত্যার ঘটনায় নীরব ভূমিকায় থাকা সু চি আন্তর্জাতিক মহলে দারুণ সমালোচিত হলেও দেশে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তার উপর ভর করেই নভেম্বরের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে তার দল এনএলডি ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পায়।

ভোটে ‘ট্রাম্পধাঁচের’ জালিয়াতির অভিযোগ

ভোটের ফল প্রকাশের পরপরই সেনা সমর্থিত বিরোধীদল ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোটের ফল মানতে অস্বীকৃতি জানায়। যার তেমন কোনও প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি।

সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ত সুয়ের সই করা একটি বিবৃতিতেও পুনরায় একই অভিযোগ তোলা হয়। সাবেক জেনারেল সুয়ে মিয়ানমারের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেনাবাহিনী সোমবার ক্ষমতা দখলের পর সুয়েকে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দিয়ে দেশে এক বছরের জরুরি অবস্থা জারি করেছে।

বিবৃতিতে সুয়ে বলেছেন, ‘‘২০২০ সালের ৮ নভেম্বর হওয়া জাতীয় নির্বাচনের ভোটার তালিকায় বড় ধরনের অনিয়ম ছিল। ওই সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন।” যদিও এই অভিযোগের পক্ষে তাদের হাতে খুব সামান্য প্রমাণই আছে।

যেমনটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। রিপাবলিকান প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ক্রামগত ‘ভোট চুরির’ প্রমাণহীন অভিযোগ করে গেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি পরাজয় স্বীকার করেননি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের উপ পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, ‘‘নিশ্চিতভাবেই অং সান সু চি নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছেন।

“সেখানে নির্বাচনে প্রতারণার যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা অনেকটা ‘ট্রাম্পিয়ান’ অভিযোগের মত। প্রমাণহীন ভোট কারচুপির অভিযোগ।”

এই অভিযোগে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার দখলকে ‘অবর্ণনীয়’ বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘‘ভোটের অর্থ কী ক্ষমতা হারানো? উত্তর হল, না।”

মিয়ানমারে সেনাঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জাপানে বিক্ষোভ। ছবি: রয়টার্স

বিব্রত হয়েছে সেনাবাহিনী

নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) খুব অল্প ভোট পেয়েছে।মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী অবস্থান যদিও তাতে খর্ব হয়নি। কারণ, ২০০৮ সালে জান্তা শাসন আমলে করা দেশটির বিতর্কিত সংবিধানে সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া আছে।

সংবিধান অনুযায়ী, মিয়ানমারের পার্লামেন্টের একচতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ। এছাড়া স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত সুরক্ষা মত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সব সময়ই থাকবে সেনাবাহিনীর হাতে।

আর যতদিন এই সংবিধান সংশোধন না হবে ততদিন সেনাবাহিনী দেশটির রাজনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকায় থাকবে।

এনএলডি সরকারের পক্ষে এই সংবিধান সংশোধন করা বলতে গেলে অসম্ভব। কারণ, সংবিধান সংশোধনের জন্য পার্লামেন্টের ৭৫ শতাংশ সমর্থন পেতে হবে। সেনাবাহিনীর হাতে অন্তত ২৫ শতাংশ আসনের নিয়ন্ত্রণ থাকায় প্রয়োজনীয় সমর্থন পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

তাহলে কেন অভ্যুত্থান? সে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দেশটির সাবেক সাংবাদিক আয়ে মিন থান্ত এর পেছনে আরেকটি কারণ তুলে ধরেছেন। ইয়াংগুন থেকে বিবিসি’কে তিনি বলেন, নির্বাচনের ফলে সেনাবাহিনী বিব্রত হয়েছে, লজ্জায় পড়ে গেছে।

“তারা (সেনাবাহিনী) এই হার মেনে নিতে পারছে না। যাদের পরিবারের সদস্যরা সামরিক বাহিনীতে আছে - এমনকী তারাও তাদের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। "

মিন থান্ত আরও বলেন, “মিয়ানমারে সেনাবাহিনী নিজেদের কোন অবস্থানে দেখে আমাদেরকে সেটাও বুঝতে হবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে অং সান সু চিকে প্রায়ই মিয়ানমারের ‘মা’ বলা হয়। আর সেনাবাহিনী নিজেদের মনে করে তারাই ‘জাতির পিতা।”

“সেকারণে যখনই দেশের শাসনের প্রসঙ্গ আসে তখনই সেনাবাহিনী এটি তাদের অধিকার এবং কর্তব্য বলে মনে করে।” ভোটের ফলে সেনাবাহিনীর সেই ‘জাতির পিতা’র গরিমা খর্ব হয়েছে।

তাছাড়া, “সম্প্রতি কয়েকবছরে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আরও অবাধ হয়েছে। যেমনটি আগে ছিল না। সেনাবাহিনী বিশেষ করে বাইরের লোকদেরকে বিপদ হিসেবেই দেখে থাকে।"

তার ওপর করোনাভাইরাস মহামারী এবং নভেম্বরের নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ভো্ট দিতে না দেওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণেও হয়ত সামরিক বাহিনী এখনই কিছু একটা করতে উদ্যোগী হয়েছে বলেও মনে করেন সাংবাদিক মিন থান্ত। যদিও এরপরও অভ্যুত্থানের ঘটনা তার কাছে বিস্ময়করই ঠেকেছে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা দখলের পর রাজধানী নেপিডো তে পার্লামেন্টে যাওয়ার পথে সড়কে সেনা চেকপোস্ট।ছবি: রয়টার্স

কী ঘটবে সামনে?

অনেক রাজনীতি বিশ্লেষকই এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না ঠিক কী কারণে সেনাবাহিনী এই অভ্যুত্থান ঘটাল। কারণ, এতে তাদের যে তাদের বিশেষ কোনও লাভ হবে তেমনটি মনে হচ্ছে না।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের এশিয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পোস্ট ডক্টরাল ফেলো জেরার্ড ম্যাককার্থি বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা দারুণভাবে সেনাবাহিনী বান্ধব: সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে স্বায়ত্তশাসিত, নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে তাদের হাতে উল্লেখ করার মত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আছে এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে বেসামরিক সরকার তাদের রাজনৈতিক সুরক্ষাও দিচ্ছে।”

“এখন তাদের ঘোষণা অনুযায়ী, এক বছরের জন্য ক্ষমতা দখল করায় চীনের বাইরে অন্যান্য অংশীদারদের তারা হারাবে। এতে সেনাবাহিনীর বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং একই সঙ্গে এটা দেশের ভেরতও গণবিক্ষোভ শুরু হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি উসকে দেবে। যে লাখ লাখ ভোটার সু চি ও তার দল এনএলডিকে আরেক মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় এনেছে তারা বিক্ষোভ শুরু করে দিতে পারে।”

সেনাবাহিনী হয়ত পরবর্তী নির্বাচনে নিজেদের সমর্থিত দল ইউএসডিপি’র অবস্থান আরো ভালো হওয়ার আশায় এখন অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও অনেক ঝুঁকি আছে বলে মনে করেন ম্যাককার্থি।

এই অভ্যুত্থান মিয়ানমারকে আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে করে ফেলার ঝুঁকিতে ফেলবে বলে মনে করেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন। একইসঙ্গে দেশের জনগণের মধ্যেও ক্ষোভ সঞ্চার হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় না মিয়ানমারের জনগণ ছেড়ে দেবে না। তারা পুনরায় সেনাশাসনে ফিরতে চায় না। তারা সু চিকে সেনাশাসন ফিরে আসার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ঢাল বলেই মনে করে।”

এখনও আলোচনার মাধ্যমে চলমান সংকট সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। তবে তিনি এও বলেন, ‘‘যদি দেখা যায় বড় ধরনের বিক্ষোভ শুরু হচ্ছে, তাহলে আমরা গভীর সংকটে পড়ে যাব।”