বাইডেনের শুরু, ট্রাম্পের সারা

যুক্তরাষ্ট্রে আজ এক নতুন দিন। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে বন্ধুর এক পথে যাত্রা শুরু করছেন ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন। আর চারবছরের দীর্ঘ পথযাত্রা সদ্যই শেষ করলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Jan 2021, 02:44 PM
Updated : 20 Jan 2021, 04:31 PM

তার ঝঞ্জামুখর শাসনামলের শেষ দুই সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ক্যাপিটল হিলের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-হাঙ্গামার প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের জন্য নতুন এক শঙ্কার আবহে ক্ষমতা নিচ্ছেন বাইডেন।

নতুন সূচনার এই মুহূর্তের অনুভূতি ফুটে উঠেছে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের এক ডেমোক্র্যাটের কথায়, “খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। কিন্তু আমরা যে ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছি তা ভোলা কঠিন।”

“এখন উদ্বেগটা ক্যাপিটলের সেই দাঙ্গা পরবর্তী নিরাপত্তা নিয়ে নয়, বরং আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আর কিভাবেই বা সামনে এগুব তা নিয়ে।”

তবে পরিস্থিতি যাই হোক বাইডেন এ মুহূর্তে বেশিরভাগ ভোটারের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় বসছেন। গত নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে বাইডেনের আচরণ নিয়ে ইতিবাচক মত প্রকাশ করেছেন ৬৪ শতাংশ ভোটার। তাদের বেশিরভাগই মন্ত্রিসভায় বাইডেনের নিয়োগ এবং ভবিষ্যত নীতি ও পরিকল্পনা সবকিছুই সমর্থন করেছেন।

এর ঠিক বিপরীত চিত্র ডনাল্ড ট্রাম্পের। তিনি হোয়াইট হাউজ ছাড়ছেন সবচেয়ে কম, মাত্র ২৯ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে তার আচরণ এবং কর্মকাণ্ড নিয়েও ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে।

তাছাড়া, ৬ জানুয়ারি কংগ্রেস ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা, ভাংচুরের ঘটনায় ট্রাম্পের দায় কিছুটা হলেও আছে বলে মনে করেন তিন-চতুর্থাংশ মানুষ। ৫২ শতাংশ মানুষ মনে করেন ট্রাম্প ওই ঘটনার জন্য অনেকখানি দায়ী। আর তাকে দায়ী মনে করেন না মাত্র ২৪ শতাংশ মানুষ।

বিদায় বেলায়ও আলো কেড়েছেন ট্রাম্প

ক্যাপিটলে হামলা উস্কে দেওয়ার অভিযোগে বিদায়বেলায় ট্রাম্প প্রতিনিধি পরিষদে ফের অভিশংসিত হয়েছেন। এই প্রক্রিয়া এখন শেষ হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত কি হয় তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনায় বাইডেনের এই নবযাত্রার সময়েও আলো কেড়েছেন ট্রাম্প।

তিনি বিদায় নিলেও তাকে ঘিরে রাজনৈতিক দৃশ্যপট সহসাই শেষ হচ্ছে না সেনেটে তার অভিশংসনের বিচার ঝুলে থাকার কারণে। এ বিচার শেষে ফের হোয়াইট হাউজের দৌড়ে ট্রাম্প নামতে পারবেন? নাকি কোনও দলের হয়ে ‘কিংমেকার’ হবেন? এসব নিয়ে আছে জল্পনা।

ট্রাম্প নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করছেন এমন খবর এরই মধ্যে বেরিয়েছে গণমাধ্যমে। ট্রাম্পের জনসমর্থনও এখনও একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বিদায়ী ভাষণে ট্রাম্প এও বলেছেন, যে আন্দোলন চলছে তা সবেমাত্র শুরু।  

মঙ্গলবার শেষ সময়ে ট্রাম্প অবশ্য বিদায়ী এক ভিডিও বার্তায় সুর নরম করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সাফল্যের জন্য প্রার্থনার আবেদনও জানিয়েছেন দেশবাসীর কাছে। তবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের নামটি উচ্চারণ করেননি তিনি। আর তা করে ট্রাম্প প্রমাণ করে দিয়েছেন নির্বাচনে হার এখনও তিনি মানতে পারেননি।

ভাষণে চারবছরে নিজের নানা অর্জনের কথা জানান দিয়েছেন ট্রাম্প। বলেছেন, “যা করতে এসেছিলাম, করেছি। আরও অনেক কিছুই করেছি। কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছি। কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

আবেগে কেঁদেছেন বাইডেন

ট্রাম্পের ওই আত্মবিশ্বাসের বিপরীতে বুধবার অভিষেক ঘিরে বাইডেনকে দেখা গেছে অনেকটাই আবেগপ্রবণ। ওয়াশিংটনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে ডেলাওয়্যারে নিজ শহরে প্রয়াত ছেলের স্মৃতিচারণ করতে দেখা গেছে তাকে।

ডেলাওয়্যার ছাড়ার আগে জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছেন তিনি। ভাষণে তিনি বলেছেন, “এখন সময়টা অন্ধকার, কিন্তু আলো সবসময়ই আছে।”

বাইডেন অ্যামট্র্যাক ট্রেনে করে ওয়াশিংটনে শপথ অনুষ্ঠানে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও পরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তিনি তা না করে বরং প্রাইভেট বিমানে করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

ভাষণে জাতীয় ঐক্যের ডাক

ট্রাম্পের রেখে যাওয়া বিভক্ত দেশ আর সবকিছু ওলট-পালট করে দেওয়া চারবছরের পর এবার বাইডেনের দেওয়া উদ্বোধনী ভাষণের মূল প্রতিপাদ্য ‘ঐক্যবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র’। প্রায় আধঘন্টার এই ভাষণে জাতীয় ঐক্যের জন্য থাকছে তার ইতিবাচক আহ্বান।

এ আহ্বানকে সামনে রেখেই নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন তিনি। সেই ভাষণের অন্তর্নিহিত অর্থের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে বাইডেনের এবারের ভাষণের মূল বক্তব্য। যে ভাষণের প্রতিপাদ্য ছিল “আমাদের একে অপরকে সুযোগ দিন।”

যাতে বলা হয়েছিল, “এখন কঠোর সব বাগাড়ম্বর পরিহারের সময়, উত্তাপ কমানোর সময়, আবার একে অপরের দিকে নজর দিন, একে অপরের কথা শুনুন। এগিয়ে যেতে হলে আমাদেরকে আমাদের বিরোধীদের সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করা বন্ধ করতে হবে। তারা আমাদের শত্রু নয়, তারা আমেরিকান।”

সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা যতটুকু সময় নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন বাইডেনের ভাষণ তার চেয়েও একটু দীর্ঘ। চারবছর আগে ট্রাম্প দিয়েছিলেন ১৫ মিনিটের ভাষণ। ২০০৯ সালে বারাক ওবামা দিয়েছিলেন প্রায় ১৮ মিনিটের ভাষণ। আর এবার বাইডেনের ভাষণটি প্রায় ২০ মিনিটের।

নতুন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন এবং কমলা হ্যারিসের শপথের পরই দেশবাসীর উদ্দেশে এ ভাষণ দেওয়া হবে।

প্রথমদিনই ১৫ নির্বাহী আদেশ, অভিবাসনে অগ্রাধিকার:

বুধবার অভিষেকের আগেই বাইডেন এক ‍বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছেন, শপথের পরই ১৫ টি নির্দেশে সই করছেন তিনি। তার মধ্যে অন্তত ৬ টিই থাকছে অভিবাসন নিয়ে।

যার মধ্যে প্রথমত, ট্রাম্প যে সাত মুসলিম প্রধান দেশের মানুষের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পথ বন্ধ করেছিলেন, সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন বাইডেন।

ট্রা্প দেশের নিরাপত্তার রক্ষার যুক্তিতে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। আর বাইডেন তা তুলে নিয়ে বিশ্বমঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের ইচ্ছাই জানান দিচ্ছেন।

এরপর বাইডেন অবিলম্বে বন্ধ করবেন যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তের দেয়াল নির্মাণ। যে দেয়াল ট্রাম্প নির্মাণ করছিলেন অবৈধ অভিবাসী আটকাতে। দেশে অবৈধ অভিবাসীদেরকে বৈধতা দিতে বাইডেন একটি ইমিগ্রেশন বিলও ঘোষণা করবেন।

যুক্তরাষ্ট্রে অপ্রাপ্ত বয়সে প্রবেশ করা ১০ লাখের বেশি অভিবাসীর জন্য চালু করা ডেফার্ড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভ্যাল (ডাকা) কর্মসূচিতে ট্রাম্প যে কড়াকড়ির পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বাইডেন তারও অবসান ঘটাবেন। এই কর্মসূচির সুরক্ষিত রাখার জন্য হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এবং এটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দিয়ে একটি স্মারক সই করবেন তিনি।

অভিবাসন ছাড়াও বাইডেনের প্রথম অগ্রাধিকার করোনাভাইরাস। সংক্রমণ রুখতে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলাসহ সিডিসি’র নির্দেশনা অনুযায়ী সব  স্বাস্থ্যবিধি কেন্দ্রীয় সরকারি ভবন, কর্মচারির ক্ষেত্রে মেনে চলার নির্বাহী আদেশ দেবেন তিনি।

সব গভর্নর, সরকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, মেয়র, ব্যবসায়িক নেতা ও অন্যান্য সবাইকে মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্য সব বিধি মেনে চলার আহ্বানও বাইডেন জানাবেন।

বাইডেনের অন্যান্য নির্বাহী আদেশের মধ্যে আছে, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফেরার বিষয়টিসহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা এবং বর্ণবাদ, এলজিবিটি সম্প্রদায়ের অধিকার এবং নারী-পুরুষ সমতার মতো আরও কিছু বিষয়।

(সূত্র: বিবিসি/সিএনএন/রয়টার্স)