বিধ্বস্ত উড়োজাহাজের হতভাগ্য যাত্রীদের খবরের অপেক্ষায় স্বজনরা

ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়া এয়ারের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটির হতভাগ্য আরোহীদের স্বজনরা দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে প্রিয়জনদের খবর পাওয়ার অপেক্ষা করছেন। কেউ কেউ এখনও তাদের প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Jan 2021, 02:08 PM
Updated : 11 Jan 2021, 02:08 PM

গত শনিবার শ্রীবিজয়া এয়ারের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট রাজধানী জাকার্তা থেকে ওয়েস্ট কালিমান্তান প্রদেশের রাজধানী পনতিয়ানাক রওয়ানা হওয়ার চার মিনিটের মধ্যে রাডার থেকে হারিয়ে যায়।

পরে জানা যায়, বিমানবন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে লাকি দ্বীপের কাছে সাগরে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে। উড়োজাহাজটিতে ৬২ জন আরোহী ছিলেন। যাদের বেঁচে থাকার আশা আর নেই বললেই চলে।

উড়োজাহাজটি যেখানে বিধ্বস্ত হয়েছে ওই এলাকায় সাগরের পানি থেকে মানবদেহের খণ্ডাংশ উদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো থেকে কারও পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

উড়োজাহাজের যাত্রীরা কারা তা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে জানা না গেলেও পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিবিসি কয়েকজনের পরিচয় তুলে ধরেছে।

ছবি:বিবিসি

‘দয়ালু’ পাইলট ক্যাপ্টেন আফওয়ান:

শ্রীবিজয়া এয়ারের বিধ্বস্ত এসজে১৮২ ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন ৫৪ বছরের আফওয়ান। যাকে তার সহকর্মী, প্রতিবেশী ও পরিবারের সদস্যরা একজন দয়ালু এবং বুদ্ধিমান পাইলট হিসেবে জানতেন।

তার ভাইয়ের ছেলে ফেরজা মাহার্ধিকা বিবিসি ইন্দোনেশিয়াকে বলেন, ‘‘পুরো পরিবার শোকের মধ্যে রয়েছে। আমরা এখনও ভালো কিছুর ‍জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছি।”

ঘটনার দিন তার চাচা বেশ তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন জানিয়ে মাহার্ধিকা আরও বলেন, ‘‘তিনি ওইদিন এমনকী তার শার্ট ইস্ত্রি পর্যন্ত করেননি। অথচ, সাধারণত তিনি খুবই পরিপাটি থাকতেন। তিন সন্তানকে আবারও ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলে তিনি তাদের কাছে দুঃখও প্রকাশ করেছিলেন।”

ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনীতে কর্মজীবন ‍শুরু করেছিলেন ক্যাপ্টেন আফওয়ান। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ চালানো শুরু করেন।

আফওয়ান একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন এবং প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের সবসময় সাহায্য করতেন।

দিনদা আমেলিয়া:

১৫ বছরের এই কিশোরী জাকার্তা থেকে ছুটি কাটাতে পানতিয়ানাক যাচ্ছিলেন। দিনদার মা যেখানে কাজ করেন সেই মালিকের সথে ওই পরিবারের আরও দুই শিশু মিলে ছুটি কাটাতে যাচ্ছিলেন দিনদা।

দিনদার মা লেনা বলেন, তার মেয়ে ২৭ ডিসেম্বর জাকার্তা গিয়েছিল।

‘‘সে ঠিক তার পঞ্চদশ জন্মদিনে ছুটি কাটাতে বের হয়েছিল। যে খুবই খুশি ছিল। সে আর কখনও ফিরবে না।”

আনগা ফার্নান্দ আফরিওন বেঁচে আছেন, আশা মায়ের:

২৯ বছরের আনগা ফার্নান্দ এক সপ্তাহ আগেই প্রথম বাবা হয়েছিলেন। আনগার মা আফ্রিদা এখনও ছেলের বেঁচে থাকার আশায় বুক বেঁধে আছেন।

আফ্রিদা পশ্চিম সুমাত্রায় বসবাস করেন। তিনি বিবিসি’কে বলেন, ‘‘জার্কাতায় পরিবারের সদস্যরা তার বিষয়ে খোঁজ খবর করছে। আমিও যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করোনভাইরাস মহামারীর কারণে এখন যাতায়াত খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।”

পেশায় একজন নাবিক আনগার সদ্যজাত ছেলের নাম আলভানো ফাইজা আলিনগা। বাবা হওয়ার পর ছেলেকে উজ্জ্বল ভবিষ্যত দিতে আনগা আরও বেশি কাজ করতে চেয়েছিল বলে জানান তার ‍মা।

তিনি বলেন, “আনগা একটি বড় কার্গো জাহাজে কাজ করত। সে আমাকে শুক্রবার ফোন করে বলেছিল তাদের জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সে শেষ মুহূর্তে উড়োজাহাজে পনতিয়ানাক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ, ‍তার বস তাকে সেখানে ডেকে পাঠয়েছে।

‘‘কাজের খাতিরে তাকে ইন্দোনেশিয়ার নানা জায়গায় যেতে হত। সে সাধারণত জাহাজেই ভ্রমণ করত, উড়োজাহাজে খুব কমই চড়ত।”

ছবি: বিবিসি

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আফ্রিদা আরও বলেন, ‘‘আমার ছেলে খুবই শক্ত মনের কিন্তু খুবই বাধ্য ছিল। সে সব সময় সব মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করত।

‘‘যদি সে চলেই গিয়ে থাকে তবে আমি একটা জিনিসই চাই। সেটা হল তাকে বাড়িতে এনে ঠিক মত কবর দেওয়া।”

বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন নবদম্পতি ইহসান ও পুত্রি ওয়াহউনি:

নববিবাহিত এই দম্পতিও বিধ্বস্ত ওই উড়োজাহাজে ছিলেন। ইহসান আদহালান হাকিমের ছোট ভাই আরউইন আমরু হাকিম সাংবাদিকদের বলেন, তার ভাই সুকর্ণ-হাত্তা বিমানবন্দর থেকে ফোন করে খারাপ আবহাওয়ার কারণে তাদের ফ্লাইট বিলম্বিত হওয়ার খবর জানিয়ে পরিবারকে সে খবর দিতে বলেছিল।

ইহসানের পরিবারের বেশ কিছু আত্মীয় পনতিয়ানাকে বসবাস করেন। তাই সেখানে বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল এবং সেজন্যই এ দম্পতি সেখানে যাচ্ছিলেন।

আরউইন বলেন, ‘‘আগামী শনিবার ওই অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা ছিল। এখন পুরো পরিবার তাদের জন্য প্রার্থনা করছে।”

এরকম আরও অনেক স্বজন তার প্রিয়জন না হোক অন্তত প্রিয়জনের ‍মৃতদেহ হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।

এজন্য ইন্দোনেশিয়া কর্তৃপক্ষ পনতিয়ানাক বিমানবন্দরে পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। যাতে ওই নমুনার সঙ্গে সমুদ্র থেকে উদ্ধার মানবদেহের খণ্ডাংশের ডিএনএ পরীক্ষা করে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়।

কর্তৃপক্ষ জানায়, এজন্য ৫১ জন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবার পরিবারের সদস্যরা এখনো এসে পৌঁছাননি। তাই এ কাজ শেষ হতে হয়ত আরও দুইদিন লেগে যাবে।