ট্রাম্পের সামনে ‘অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়লেও তিনি চুপচাপ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন না; তার আসন্ন ব্যক্তিগত জীবন বিভিন্ন ইতিবাচক ও নেতিবাচক সম্ভাবনার দোলায় দুলছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2020, 09:48 AM
Updated : 16 Dec 2020, 09:48 AM

৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট জো বাইডেনের কাছে হারের ফল উল্টে দিতে ব্যর্থ আইনি চেষ্টার পর ২০ জানুয়ারি থেকে তিনি ফের ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, তার ওই জীবন কেমন হবে তা অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। 

বাইডেন সোমবার ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। কংগ্রেসে এই ভোটের ফল অনুমোদিত হওয়ার পর ২০ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেবেন তিনি। সেদিনই এ ডেমোক্র্যাট হোয়াইট হোয়াইট হাউসে ঢুকবেন আর ট্রাম্পকে ছাড়তে হবে তার প্রিয় ‘সাদা বাড়ি’।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর ট্রাম্পের সামনে যেসব সম্ভাবনা থাকছে, তার মধ্যে আছে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা কিংবা মিডিয়ায় নতুন কোনো কর্মকাণ্ডে জড়ানো; তবে তার এ সব সম্ভাবনাকেই মেঘাচ্ছন্ন করে দিতে পারে নানান আইনি জটিলতা ও ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ।

কেবল একটি বিষয়ই নিশ্চিত, পাদপ্রদীপের আলোর প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে ট্রাম্প তার পূর্বসূরী জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো নীরবে ছবি আঁকাআঁকি কিংবা জিমি কার্টারের মতো বিশ্বজুড়ে নানান সেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পদক্ষেপ অনুসরণ করবেন না।

সম্ভবত প্রেসিডেন্ট আমলের মতোই ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ হতে যাচ্ছে জাঁকালো, বেপরোয়া ও দুর্বিনীত। তবে এর পুরোটাই তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। কেননা তাকে তার পারিবারিক ব্যবসা ও প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে করা বেশ কিছু কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত একাধিক দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পাদপ্রদীপের আলোয় থাকতে রিয়েল এস্টেট মুঘল থেকে একসময় রিয়েলিটি টিভি শো-র তারকা বনে যাওয়া ট্রাম্প নানান কৌশলেরও আশ্রয় নিতে পারেন বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।

নির্বাচনে হার মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানো এবং নভেম্বরের ভোটের পর থেকে প্রমাণ ছাড়াই ‘ব্যাপক কারচুপির’ অভিযোগ করে যাওয়া ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের দৌড়ে আরেকবার নামার কথা বিবেচনা করছেন বলে মিত্রদের জানিয়েছেন।

বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানে না গিয়ে ওই দিনই ২০২৪ সালের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার ঘোষণা দেবেন কিনা, তা নিয়েও আলোচনা করেছেন তিনি। এ পদক্ষেপ তাকে ২০১৬ ও চলতি বছরের নভেম্বরের আগের মতো বড় বড় শোডাউন ও সমাবেশ করার সুযোগ করে দেবে।

ট্রাম্প প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলে তা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে ইচ্ছুক মাইক পেন্স, নিকি হ্যালি, মাইক রুবিও ও টম কটনের মতো রিপাবলিকানদের সম্ভাবনাকে জটিলতার দিকে ঠেলে দিতে পারে, যাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- তারা ট্রাম্পের পক্ষে থাকবেন, না তাকে টপকে প্রার্থীতা জিতে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নেবেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থীরা আর পরের নির্বাচনে অংশ নেন না; কিন্তু ট্রাম্পের চরিত্র অনুযায়ী এটাই হতে পারে ‘মোক্ষম পদক্ষেপ’।

দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। ওই দুইবার যে টানা হতে হবে, এমন কোনো কথাও নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডই হচ্ছেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকলেও তা টানা ছিল না। ১৮৮৯ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর তিনি হোয়াইট হাউস ছেড়ে গেলেও পরে ফিরে আসেন ঠিক চার বছর পর, ১৮৯৩ সালে।

ট্রাম্প এরই মধ্যে একটি ‘পলিটিকাল অ্যাকশন কমিটি’ গঠন করেছেন, যা তাকে নির্বাচনে লড়ার জন্য ফের অর্থ উত্তোলন এবং হোয়াইট হাউস ছাড়ার পরও দলের ভেতর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাকে পরবর্তী নির্বাচনে প্রার্থী করা হবে কিনা তা নির্ধারণে ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেবে।

তিনি যে রাজনীতিতে সরব থাকতে এবং দলে প্রভাব টিকিয়ে রাখতে চান, ঘনিষ্ঠ মিত্র রোনা ম্যাকডেনিয়েলকে ফের রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারউইম্যান পদে সমর্থন দিয়ে তিনি তা বুঝিয়েও দিয়েছেন।

ম্যাকডেনিয়েল ওই পদে থাকবেন কিনা, জানুয়ারির শেষদিকে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির ভোটে তা নির্ধারিত হবে। দলে ট্রাম্প কতখানি শক্তিশালী এবং রিপাবলিকানরা তাদের দলকে সদ্যবিদায়ী প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার অনুগামী হতে দেবেন কিনা ভোটে তার ‘আগাম পরীক্ষাও’ হয়ে যাবে।

টিভিতে ফিরবেন?

রিয়েলিটি সিরিজ ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’-র সাবেক তারকা ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর নতুন কিছু নিয়ে গণমাধ্যম জগতে ফেরার কথা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন বলে তার উপদেষ্টারা জানিয়েছেন।

ট্রাম্পের ভাবনার মধ্যে নতুন একটি টিভি চ্যানেল বা সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানি আছে; যেগুলো সেসব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সঙ্গে লড়বে, যাদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন বলে মনে করছেন রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট।

এটি হতে পারে নতুন একটি খবরভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল, যা ‘ফক্স নিউজকে ছাড়িয়ে যাবে’, বলেছেন ট্রাম্পঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি।

চলতি বছরের নির্বাচনে ফক্স নিউজ যথেষ্ট সমর্থন দেয়নি বলে মনে করেন ট্রাম্প; বিশেষ করে নির্বাচনের রাতেই দোদুল্যমান রাজ্য অ্যারিজোনা বাইডেনের পকেটে গেছে বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ায় চ্যানেলটির প্রতি তার ক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে।

বাইডেন শেষ পর্যন্ত ঠিকই অ্যারিজোনায় জিতেছেন; কিন্তু বেশিরভাগ গণমাধ্যম এ তথ্য দিয়েছে গণনাকৃত ভোটের ধারা অনুযায়ী বেশ কয়েকদিন পরে। ফক্স সে তুলনায় আগেভাগেই সম্ভাব্য ফল জানিয়ে দিয়েছিল।

চ্যানেলটিকে একহাত নিতে ট্রাম্প বিদ্যমান কোনো রক্ষণশীল ক্যাবল নেটওয়ার্ক, যেমন ওয়ান আমেরিকা নিউজ নেটওয়ার্ক বা নিউজম্যাক্সের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন বলেও অনেকে মনে করছেন। এই দুটি গণমাধ্যমই ট্রাম্পকে ইতিবাচকভাবে চিত্রায়িত করে আসছে। 

ট্রাম্প তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে নতুন একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানি খোলার পরিকল্পনা নিয়েও কথা বলেছেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স। মূলত টুইটারের সঙ্গে বিরোধ থেকেই তার মাথায় এ ভাবনা এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি চলতি বছর অসংখ্যবার ট্রাম্পের টুইটে ‘সতর্কতামূলক লেবেল’ জুড়ে দিয়েছে।

অবশ্য এত কিছু করার আগে রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্টকে তার আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। প্রেসিডেন্টের মেয়াদকালে নানান সিদ্ধান্ত ও মন্তব্য তার ব্যবসায়িক ব্র্যান্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলেই ধারণা অনেকের। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ট্রাম্পের রিয়েল এস্টেট, ভ্রমণ ও বিনোদন ব্যবসার ক্ষতিও কম হয়নি।

ট্রাম্পের মোট সম্পদের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ৬০ কোটি ডলার কমে আড়াইশ কোটি ডলারে নেমে এসেছে বলে সেপ্টেম্বরে ফোর্বসের এক আনুমানিক হিসাবে জানানো হয়েছে।

যেসব আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে পারেন

প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকাকালে আইনি সুরক্ষার সুবিধা পেলেও হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব ছাড়ার পর ওই সুরক্ষার সুযোগ আর নিতে পারবেন না ট্রাম্প। যে কারণে তাকে সামনের দিনগুলোতে বেশ কয়েকটি আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি সাইরাস ভেন্স ট্রাম্প ও তার পারিবারিক কোম্পানির কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি তদন্ত করছেন; এই তদন্তে ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে ট্রাম্পের সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়ানোর দাবি করা দুই নারীর মুখ বন্ধ রাখতে ট্রাম্প বেআইনিভাবে টাকা খরচ করেছেন কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

ডেমোক্র্যাট ভেন্স অবশ্য সম্প্রতি আদালতে জমা দেওয়া নথিতে তার তদন্তের আওতা আরও বিস্তৃত এবং তিনি সম্ভাব্য ব্যাংক, কর ও বীমা জালিয়াতি এবং ব্যবসায়িক নথি জালিয়াতি নিয়েও তদন্ত করছেন বলে জানিয়েছেন।

নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাট অ্যাটর্নি জেনারেল ল্যাটিসিয়া জেমসও ট্রাম্প ও তার পারিবারিক ব্যবসার কর জালিয়াতির অভিযোগের তদন্ত করছেন। এসব অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে ট্রাম্পকে জেলে যেতে হবে না, কিন্তু বড় ধরনের আর্থিক জরিমানা দিতে হতে পারে। 

ট্রাম্প অর্গানাইজেশন এসব অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করে আসছে।

কেবল এগুলোই নয়, দুই নারীকে যৌন হয়রানির অভিযোগের ভিত্তিতে হওয়া পৃথক মানহানির মামলারও মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। ভাতিজি মেরি ট্রাম্প তার ও পরিবারের আরও দুই সদস্যের বিরুদ্ধে জালিয়াতি এবং পারিবারিক রিয়েল এস্টেট কোম্পানির শেয়ার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ যে মামলা করেছে তা নিয়েও লড়তে হবে তাকে।

ট্রাম্প ২০১৬ ও ২০১৭ সালে সাড়ে সাতশ ডলার করে কর দিয়েছেন বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসে কয়েক মাস আগে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তার ভিত্তিতে বাইডেন প্রশাসনের বিচার বিভাগও তার বিরুদ্ধে লাগতে পারে। ট্রাম্প নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সংবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন; তিনি কর দেওয়ার ক্ষেত্রে আইন লংঘন করেছেন কিনা তাও স্পষ্ট নয়।

সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের কোনো মামলা বা তদন্তের জালে জড়াতে গেলে তা বাইডেন প্রশাসনকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেছে রয়টার্স।

২০ জানুয়ারি শপথ নিতে যাওয়া ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট অবশ্য বলছেন, তিনি বিচার বিভাগের কর্মকাণ্ডে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবেন না।