যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব নেতৃত্বের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছেন ট্রাম্প, সামনে কী?

যুক্তরাষ্ট্র গত ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। মিত্র বা শত্রু দেশগুলোর পছন্দ হোক বা না হোক; আন্তর্জাতিক নানা নিয়ম-কানুন যুক্তরাষ্ট্রই ঠিক করে দিয়েছে এবং সবাইকে তা মানতে বাধ্য করেছে।

শামীমা নাসরিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2020, 06:04 PM
Updated : 1 Nov 2020, 07:19 PM

কিন্তু দেশটির এই অবস্থান আর বেশিদিন ধরে রাখার আশা একেবারেই নেই। বিশেষ করে গত চার বছরে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছেন।

এক ট্রাম্প ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রেসিডেন্টই পৃথিবীর যে কোনও সংকটে সামনে থেকে এগিয়ে গিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ট্রাম্প করেছেন ঠিক তার উল্টো।

তিনি তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে চলতে গিয়ে তার পূর্বসূরিদের করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন এবং পৃথিবীর কল্যাণে গঠন করা নানা আন্তর্জাতিক সংস্থায় তহবিল যোগান বন্ধ করে দিয়েছেন।

ট্রাম্প তহবিলের যোগান বন্ধ করে দিলেও ওই সব সংস্থাগুলো কিন্তু ভেঙে পড়েনি বা দীর্ঘদিনের নেতা পিছিয়ে গেলেও পৃথিবী কিন্তু ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না। বরং বাকি বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই নানা আন্তর্জাতিক চুক্তি এগিয়ে নিচ্ছে এবং নানা সংস্থাগুলো পুনর্বিন্যাস করছে।

যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বের জন্য এখন চীন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ এখন বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে, তা সে দেশ চীনে মিত্র হোক বা শত্রু।

অবশ্য ক্ষমতার এই পালাবদল অনেক আগেই শুরু হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় নীতি নির্ধারকদের বিশ্বাস, আমেরিকার নেতৃত্ব অনন্য এবং দেশটি ‘অনন্তকাল ধরে’ বিশ্বের নেতৃত্ব দিয়ে যাবে।

তবে বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব ধরনের একাধিপত্যের শেষ আছে। কারণ, ‍অন্যান্য শক্তিও দিন দিন বাড়বে এবং তারা একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্বনেতার ভূমিকা গ্রহণ করা যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভ করে নিজের আধিপত্যের প্রমাণ দেয়। স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভের সময়কে ‘একাধিপত্যের মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করেন বিশেষজ্ঞরা। যা প্রায় ৩০ বছর স্থায়ী হয়।

কিন্তু গত দুই দশক ধরে ওই একাধিপত্য ক্ষয়ে যাওয়ার স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমেরিকানরা নেতৃত্বের ভার বহন করতে করতে হয়ত ক্লান্তও হয়ে পড়ছেন। আর বাকি বিশ্ব একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মেনে নিয়েছে আবার নেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গা নিতেও আগ্রহ প্রকাশ করছে।

যেমন, স্বাস্থ্যখাতে জার্মানি বিশ্বনেতার ভূমিকা নিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের আগেই সর্বশেষ জি২০ সম্মেলনে বিশ্বস্বাস্থ্য কে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে উপস্থাপন করে এ খাতে আরও তহবিল বাড়ানোর কথা বলেছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। দেশটি নিজেরা স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা ও উন্নয়ন কাজে তহবিল অনেক বাড়িয়েছে।

করোনাভাইরাস মহামারীর সময় যখন সব দেশ নিজেদের রোগীদের হাসপাতালে জায়গা দিতে এবং চিকিৎসা করতে হিমশিম খেয়েছে তখন জার্মানি প্রতিবেশী দেশ থেকে সঙ্কটাপন্ন কোভিড-১৯ রোগীদের নিয়ে এসে চিকিৎসা দিয়েছে।

আর ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র মহামারীর এই সংকটময় সময়ে বিশ্বকে রক্ষায় বলতে গেলে কোনও ভূমিকাই রাখেনি। বিশ্বকে কী বাঁচাবেন, ট্রাম্প তো মহামারী মোকাবেলায় নিজে দেশেই চরম ব্যর্থ হয়েছেন। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যু উভয় তালিকাতেই এক নম্বর নাম যুক্তরাষ্ট্র। মহামারীর ছোবলে দেশটির প্রায় দুই কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন।

মহামারী নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলা এবং নির্বাচনের আগে দিয়ে নিজেই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে সারাবিশ্বে সংবাদের শিরোনাম হওয়া ছাড়া দেশবাসীর জন্য তেমন কিছুই করেননি ট্রাম্প।

বরং বিশ্বে গত এক শতকের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে বড় এ সংকটের সময়ে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, বন্ধ করে দেন তহবিল। পুরো বিশ্ব তার এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে।

ডব্লিউএইচও-র তহবিল বন্ধ করে দিলেও সংস্থাটির সংস্কার প্রস্তাব দিতে তিনি পিছপা হননি। যদিও তার ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে। পরে মেরকেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে নিজেদের প্রস্তাব দেন।

ওই প্রস্তাবে জার্মানি এবছর ডব্লিউএইচও কে বাড়তি আরও ২০ কোটি ইউরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তহবিল বন্ধ করে দেয়ায় যে সংকট দেখা দিয়েছে তা পূরণেই জার্মানির এই উদ্যোগ। ডব্লিউএইচও তে এখন জার্মানির মোট অবদান ৫০ কোটি ইউরো। অথচ, ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচও-র সবচেয়ে বড় দাতা দেশ।

শুধু জার্মানি নয়, বরং গত মাসে যুক্তরাজ্যও আগামী চার বছর ডব্লিউএইচও তে তাদের তহবিল ৩০ শতাংশ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। যার ফলে তারাই এখন সংস্থাটির সবচেয়ে বড় দাতা দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে।

দিন দিন নিজেদের অর্থনীতি শক্তিশালী হলেও চীন এখনও আন্তর্জাতিক নানা তহবিলে সেভাব অবদান রাখে না। বিশ্বের কল্যাণে অবদান আরও বাড়াতে চীনের উপর তাই আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। এবার চীনও ডব্লিউএইচও তে তাদের তহবিল বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডও একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এত প্রতিশ্রুতির পরও যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণ হওয়া নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে এটা বলতেই হবে, ওই শূন্যতা পূরণে যেভাবে অন্যান্য শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো এগিয়ে এসেছে তা সত্যিই দারুণ সূচনা। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, ঘোষণা দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের সত্যি সরে যাওয়া কি উচিত হবে?

ভবিষ্যৎ কী?

বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের সহজ বিকল্প এখনও নেই। তবে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক স্কট লুকাস মনে করেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুতে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘‘এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা অব্যাহত আছে এবং তা বাড়ছে।”

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতার অবশ্য লম্বা তালিকা আছে। তারা এখনও ইরাক ও আফগানিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি তে পৌঁছানোর ধারেকাছেও যেতে ব্যর্থ হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শত হুমকির পরও ইরান এবং উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্র প্রস্তুত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ আটকতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। এশিয়ায় চীনের প্রভাব বিস্তার রোধেও চরম ব্যর্থ দেশটি। ট্রম্পের ক্ষমতা গ্রহণের আগেই এসব ‍শুরু হয়ে গিয়েছিল।

লুকাস বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যের এই ক্ষয়ে যাওয়ার শুরুটা অবশ্য ট্রাম্পের আমলে নয়। বরং প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ইরাক অভিযান ছিল সবচেয়ে ‘সংঙ্কটপূর্ণ মুহূর্ত’।

“অন্তত এটুকু বলতে পারি, ‍অনেক দেশ ওই অভিযান নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ার মত অনেক দেশ এখনো বিশ্বাস করে ওই যুদ্ধ ন্যায়সঙ্গত ছিল না।

একক সিদ্ধান্তে শুধু যুক্তরাজ্যকে সঙ্গে নিয়ে ইরাকে সামরিক অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। যাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বরং এ যুদ্ধের ফলাফল হয় ভয়ঙ্কর। বহু মানুষ এ যুদ্ধে প্রাণ হারায়। ইরাকে এখনও স্থিতিশীলতা ফেরেনি। তাই যুক্তরাষ্ট্র যে ধারণার ভিত্তিতে নেতৃত্ব দিচ্ছিল এবং বাকিরা যেটিকে অনুসরণ করছিল সেটি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়।”

আগামী দিনের বিশ্ব কেমন হবে তা আগে থেকে বলা না গেলেও কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, একমাত্র চীনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সত্যিকারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে সক্ষম। বিশ্ব নেতৃত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা ‍অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং স্নায়ু যুদ্ধের আমলের মতো বাকি বিশ্ব হয়ত কোনও একটি পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য হবে।

যুক্তরাষ্ট্র অনেক কিছু থেকেই নিজেদের সরিয়ে নেওয়ায় তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে চীন নিজের আখের গুছাচ্ছে। তাদের মুখে এখন শান্তি, উন্নয়ন, সমতা গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার বাণীতে সবাইকে একযোগে হাত মেলানোর আহ্বান। অন্যদিকে, ট্রাম্প চীনকে মহামারীর জন্য দোষ দেওয়া নিয়েই মেতে আছেন। ট্রাম্পের এই দোষারোপের খেলা থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে চীন।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ হিসাবে চীন কিছুদিন আগেই কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে আর কিছু না হলেও অন্তত এই দিক থেকে বিশ্বে নেতৃত্ব দেওয়া এবং এর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিশ্বের অন্যান্যদের সঙ্গে চলার ব্যাপারে চীনের ইচ্ছার প্রকাশ তো ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী দেশ হয়েও যে ভূমিকা দেখাতে পারেনি।

তবে ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিশ্লেষক শন ব্রেসলিন অবশ্য সূদূর ভবিষ্যতে কেবল চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমেরু ক্ষমতার বলয়ে বিশ্বের কোনও একটি পক্ষকে বেছে নিতে বাধ্য হওয়ার বিষয়টিতে একমত নন। তার মতে, একমেরু বিশ্বের পরিবর্তন ঘটার সময়টি বিশৃঙ্খলায় পর্যবসিত হবে। ফলে এ থেকে বহুমেরুর একাধিক শক্তির বিশ্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনাই বেশি থাকবে।