মাইক পেন্স: রক্ষণশীল এক কুশলী নেতা

গত চার বছর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সুসম্পর্ক বাজায় রেখে চলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স। তাকে খুব বেশি খবরের শিরোনাম হতেও দেখা যায়নি। বরং কৌশলে বিতর্কিত বিষয় থেকে তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন।

শামীমা নাসরিন লাকিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Oct 2020, 10:20 AM
Updated : 26 Oct 2020, 10:49 AM

অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প উল্টো নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে প্রতিনিয়তই হয়েছেন খবরের শিরোনাম। আবার পেন্স নিজেকে খবরের আড়ালে রাখলেও তাকে অনেক সময়ই ট্রাম্পের কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতে দেখা গেছে।

তবে ইদানিং ট্রাম্পের আস্থাভাজন হয়ে ওঠা এই নেতা আর প্রেসিডেন্টের নীতির বিরুদ্ধে খুব একটা মুখ খুলছেন না।

ট্রাম্পের রানিংমেট:

এ পথে মাইক পেন্সের যাত্রা শুরু হয় ২০১৬ সালের জুলাই মাসে। ততদিনে রিপাবলিকান পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার টিকেট নিশ্চিত করে ফেলা ট্রাম্প একদিন ইন্ডিয়ানাপলিসে পেন্সের বাড়িতে গিয়ে তাকে রানিংমেট হওয়ার প্রস্তাব দেন।

কেন ট্রাম্প ইন্ডিয়ানার সাবেক এ গভর্নরকে বেছে নিয়েছিলেন তাও খুব পরিষ্কার। কারণ, আমেরিকার রক্ষণশীলদের কাছে পেন্সের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। বাড়তি পাওনা ওয়াশিংটনে তার কাজ করার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, যা ট্রাম্পের একদমই ছিল না।

যদিও সে সময় ট্রাম্পের বেশ কিছু নীতির সরাসরি সমালোচনা করেছিলেন পেন্স।

ট্রাম্প তার নির্বাচনী ইশতেহারে শুরু থেকেই মুলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার কথা বলে এসেছিলেন; যার ঘোর বিরোধিতা করা পেন্স একে ‘আক্রমণাত্মক  এবং  ‍অসাংবিধানিক’ বলে বর্ণনা করেন। তখন কি আর জানতেন যে তাকেই রানিংমেট হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসবেন ট্রাম্প?

তিনি এখন ট্রাম্পের অত্যন্ত আস্থাভাজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর তাই মাইক পেন্স এবছর ৩ নভেম্বরের নির্বাচনেও রিপাবলিকান প্রার্থী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রানিংমেট।

সমালোচনা:

৬১ বছর বয়সের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ মাইক পেন্স সবসময় বিতর্ক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও বিতর্ক পুরোপুরি তার পিছু ছাড়েনি।

২০১৭ সালে প্রথমবার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ‘নেতিবাচক’ খবরে শিরোনাম হন পেন্স। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ভোটের ঠিক আগে দিয়ে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন ব্যক্তিগত ইমেইল একাউন্ট থেকে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় ইমেইল আদান-প্রদানের অভিযোগে দারুণ সমালোচিত হন। পেন্সও তখন হিলারির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।

অথচ ২০১৭ সালের এক তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেল পেন্স নিজেও ইন্ডিয়ানার গভর্নর থাকার সময় একই কাজ করেছিলেন। অনেকেই তখন তাকে ‘ভণ্ড’ বলে সমালোচনা করেন।

আর এবার করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে ট্রাম্পের পাশপাশি পেন্সও দেশজুড়ে সমালোচিত হচ্ছেন। এই মহামারী নিয়ে মানুষের আতঙ্ককে তিনি ‘অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি’ বলেছেন। ভাইরাসের ঝুঁকিকে ট্রাম্প এবং পেন্স দুইজনই অগ্রাহ্য করেছেন।

অথচ এ ভাইরাসই কয়েক মাসে ২ লাখ ১৩ হাজারের বেশি মার্কিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। মৃত্যুর এ মিছিল থামার কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যায়নি। তাই টিকা আবিষ্কার হওয়ার আগে আরও কত আমেরিকানের প্রাণ এ রোগ কেড়ে নেমে তা কেউ জানে না।

জন্ম, বেড়ে ওঠা ও রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা:

ইন্ডিয়ানা রাজ্যের কলম্বাস শহরে এক ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে ১৯৫৯ সালের ৭ জুন জন্ম হয় মাইক পেন্সের। তারা ছয় ভাইবোন। তার বাবা এডওয়ার্ড পেন্স যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা ন্যান্সি পেন্স। পেন্স পরিবার ছিল ডেমোক্র্যাটিক দলের সমর্থক।

পেন্স ২০১২ সালে ‘ইন্ডিয়ানাপলিস স্টার’নামের একটি পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকার বলেছিলেন, ‘‘জন এফ কেনেডি এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো উদার নেতাদের দেখেই তিনি রাজনীতিতে আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।”

১৯৮৮ সালে প্রথমবার কংগ্রেস সদস্য হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী ফিলিপ শার্পের কাছে হেরে যান পেন্স। দুই বছর পর ভোটে আবারও হেরে গিয়ে একটি রেডিওতে ‘দ্য মাইক পেন্স শো’ নামের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা শুরু করেন।

১৯৯৯ সালে আবারও নির্বাচন করে সাফল্যের দেখা পান পেন্স। তারপর টানা ১২ বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের সদস্য ছিলেন। এছাড়া, তিনি হাউজ রিপাবলিকান কনফারেন্সের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। যা দলের তৃতীয় শীর্ষ পদ।

২০১৩ সাল থেকে চার বছরের জন্য ইন্ডিয়ানার গভর্নর নির্বাচিত হন মাইক পেন্স। সে সময় তিনি নিজেকে বর্ণনা করেছিলেন 'যথাক্রমে একজন খ্রিস্টান, একজন রক্ষণশীল এবং একজন রিপাবলিকান' বলে।

কিন্তু ১৯৮০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ভোট দিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী জিমি কার্টারকে।

বিয়ে:

কলেজে পড়ার সময় এক ইভাঞ্জেলিকাল গির্জায় ক্যারেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর থেকেই পেন্সের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসতে শুরু করে।  ১৯৮৫ সালে তারা বিয়ে করেন। এ দম্পতির তিন সন্তান মাইকেল, শার্লট এবং অড্রি।

পেন্স এবং বিতর্ক:

রক্ষণশীল রিপাবলিকান পেন্স ইন্ডিয়ানার গভর্নর থাকার সময় ধর্মীয় স্বাধীনতা পুন‍ঃস্থাপন অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার পর রাজ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল।

সমালোচকদের যুক্তি ছিল,  আইনটি ‘এলজিবিটি’(সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামী) সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক। গণ সমালোচনার চাপে পেন্স পরে ওই আইনে একটি সংশোধনী আনেন। যা আবার রক্ষণশীলদের পছন্দ হয়নি।

পেন্স গর্ভপাতের কড়া বিরোধী। ইন্ডিয়ানায় তিনি গর্ভপাতবিরোধী যে আইন করেন তা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কঠোর আইন।

২০১৭ সালে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি গর্ভপাত বিরোধী একটি সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। অতীতে কোনও ভাইস প্রেসিডেন্ট এমন কখনও করেননি। কিন্তু পেন্স মাঝেমধ্যেই এ ধরনের সমাবেশে যোগ দেন।

২০১২ সালে পেন্স তখন কংগ্রেস সদস্য। ওই বছর সুপ্রিম কোর্ট তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্বাস্থ্য সেবা আইনের পক্ষে একটি রুল জারি করে।

রিপাবলিকান নেতাদের একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে ওই রুলকে ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে তুলনা করেন পেন্স। যা প্রকাশের পর আবারও তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। পরে অবশ্য পেন্স তার ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।

রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি:

করোনাভাইরাস মোকাবিলা থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ, বিচারব্যবস্থায় বৈষম্য, প্রেসিডেন্টের করবিষয়ক স্বচ্ছতা, নারীদের প্রজনন অধিকার এমনকী জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নেও ডেমোক্র্যাটিক ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর কমলা হ্যারিসের থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান প্রার্থী মাইক পেন্স।

গত ৮ অক্টোবরে হ্যারিসের সঙ্গে পেন্সের বিতর্কে দুইজনের রাজনৈতিক অবস্থানে বড় ধরনের এই ফারাকই ধরা পড়েছে। দেশে বিচারব্যবস্থা এবং বর্ণবাদের উপস্থিতি আছে- কমলা হ্যারিসের এমন কথার তীব্র বিরোধিতা করেছেন পেন্স।

বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনায় মাইক পেন্স বলেছিলেন, “মিনেসোটায় কৃষ্নাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ড তাকে মর্মাহত করেছে। তবে এরপরও দাঙ্গা ও লুটপাটের কোনও যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না।”

তাছাড়া, বাইডেন ও হ্যারিস যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘পদ্ধতিগতভাবে বর্ণবাদী দেশ’ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মার্কিন পুলিশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করে বলে দাবি করে আসছেন তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘মারাত্মক অপমানজনক’ বলেও পেন্স মন্তব্য করেন।

কমলা হ্যারিস কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্প প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে মনে করলেও পেন্স মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমদিন থেকেই আমেরিকানদের স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। তার সিদ্ধান্তের কারণে দেশে আরও অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।

মহামারীর জন্য ট্রাম্পের মতো পেন্সও চীনকেই দায়ী করেন এবং মাস্ক পরার ব্যাপারে আমেরিকার মানুষদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থাকা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মাইক পেন্স একে বিদ্যমান হুমকি বলতে নারাজ। তিনি বরং ট্রাম্পের মতোই জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বন ব্যবস্থাপনাকেই দায়ী মনে করেন।

অন্যদিকে, করের ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের কর সংস্কারের ফলে বড় বড় করপোরেশনগুলো বেশি সুবিধা পেয়েছে বলে বিরোধীরা মনে করলেও পেন্স মনে করেন এতে গড়ে আমেরিকার চারজনের পরিবারগুলো উপকৃত হয়েছে।

রিপাবলিকান পার্টিতে জনপ্রিয়, ট্রাম্পের ডানহাত:

রিপাবলিকান পার্টির জন্য শুরু থেকে নিরাপদ পছন্দ হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছেন মাইক পেন্স। দীর্ঘদিনের একজন রিপাবলিকান কর্মকর্তা হিসাবে পার্টিতে তো বটেই সেইসঙ্গে তৃণমূল পর্যায়েও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে উঠেছে।

পেন্সের অভিজ্ঞতা এবং রক্ষণশীল পরিচয়ের জন্য রিপাবলিকান পার্টির সদস্যদের কাছে তিনি প্রশংসিত। কংগ্রেস সদস্য এবং ইন্ডিয়ানার গভর্নর হিসাবে তিনি দুই দশক ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার এই কর্মজীবনে পেন্স সরকারি ব্যয় কমানোর চেষ্টা নিয়ে সুনামও কুড়িয়েছেন।

এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচার শিবিরে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন মাইক পেন্স। ইন্ডিয়ানার সাবেক এই গভর্নর একজন নিবেদিতপ্রাণ ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিস্টান।

তাছাড়া, গর্ভপাত ও সমকামী অধিকারের প্রশ্নেও তিনি রক্ষণশীল। ফলে দলের খ্রিস্টান ভোটারদের মধ্যে তার ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। আর তাই ধর্মীয় ভোট ট্রাম্পের পক্ষে টানতে পেন্সের জুড়ি মেলা ভার।

ট্রাম্প প্রশাসনে অনেক রিপাকলিকানই পেন্সের উপস্থিতিকে খুবই দৃঢ়চেতা এবং নির্ভরযোগ্য হিসাবেই দেখেন। সব মিলিয়ে রিপাবলিকান পার্টিতে তিনি জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।

২০২৪ সালের নির্বাচনে পার্টি থেকে মনোনয়ন পাওয়ার কেন্দ্রীয় অবস্থানেও আছেন পেন্স। তবে সেই জায়গায় পৌঁছানোর আগে তাকে এ মুহূর্তে ৩ নভেস্বরের নির্বাচনে এগিয়ে নিতে হবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে।

পেন্সকে এখন আমেরিকার ভোটারদেরকে একথাই বোঝাতে হবে যে, ট্রাম্পই হচ্ছেন আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজে বসার সঠিক মানুষ।

(তথ্যসূত্র: বিবিসি, উইকিপিডিয়া, রয়টার্স)