গত বছর ৫৫ বছর বয়সী ক্যালিফোর্নিয়ার এ সিনেটর ছিলেন বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী। দুজনেই লড়েছিলেন দলীয় মনোনয়ন পেতে। ওই দৌড়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল কমলা হ্যারিসের; তবে এরপর অবশ্য বেশি দিন অপেক্ষাও করতে হয়নি ভারতীয়-জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত এ নারীকে।
এ বছর অগাস্টেই তিনি পেয়ে যান প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও বড় দলের হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার টিকেট।
ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নের লড়াইয়ে যার দিকে সবচেয়ে বেশি বার ছুঁড়েছিলেন তীব্র তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, এবার সেই বাইডেনকে সঙ্গে নিয়েই কমলাকে নামতে হয়েছে রিপাবলিকান ডনাল্ড ট্রাম্প-মাইক পেন্স জুটিকে হারানোর মিশনে।
দীর্ঘ কর্মজীবনে অনেকগুলো ‘প্রথমের’ জন্ম দেওয়া এ নারীর সামনে এখন ইতিহাস গড়ার সুযোগ। ৩ নভেম্বরের নির্বাচনে জিতলে তিনিই হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ভারতীয়-বংশোদ্ভূত নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রবেশের বছরই ক্যাপিটল হিলে কমলার সদম্ভ পদচারণার শুরু। গত চার বছরে দুইজনের মধ্যে খোঁচাখুঁচিও কম হয়নি। সপ্তাহ কয়েক আগেও কমলাকে ‘ন্যাস্টি’ বলেছেন ট্রাম্প; এর জবাবে প্রেসিডেন্টকে ‘যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য ক্ষতিকর’ বলেছিলেন কমলা।
এ কারণে এবারের নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্পের সঙ্গে কমলারই দ্বৈরথ দেখা যেতে পারে বলে অনুমান করছে ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’।
কৃষ্ণাঙ্গ বাবা, ভারতীয় মা
কমলার বাবা ডনাল্ড হ্যারিস জ্যামাইকান। মার্কসীয় ঘরানার অর্থনীতিতে দখল থাকা এ অধ্যাপক এক সময় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। কমলার মা ক্যান্সার গবেষক শ্যামলা গোপালান, ভারতীয় এক কূটনীতিকের মেয়ে।
“বার্কলেতে নাগরিক অধিকার আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে একে অপরের প্রেমে পড়ে যান তারা,” কমলা তার আত্মজীবনী ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড: অ্যান আমেরিকান জার্নি’তে বাবা-মায়ের পরিচয়, ঘনিষ্ঠতার কথা জানাতে গিয়ে এমনটাই বলেছেন ।
জ্যামাইকার এক জোতদার পরিবারে বাবার দিককার এক দাদীর কাছে বেড়ে ওঠা ডনাল্ড হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন ১৯৬১ সালে। এখানেই তার পরিচয় হয় শ্যামলার সঙ্গে। এরপর প্রেম, সংসার।
কমলা দেবী হ্যারিস এই দম্পতির প্রথম সন্তান। তার জন্ম ওকল্যান্ডে, ১৯৬৪ সালের ২০ অক্টোবর। কমলার নামের শেষাংশ বাবার কাছ থেকে নেওয়া; প্রথমটুকু মায়ের দেওয়া।
ওই সময় ডনাল্ড হ্যারিস আর শ্যামলা নাগরিক অধিকার আন্দোলনে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, এলাকার প্রায় সব প্রতিবাদ কর্মসূচিতেই তাদের দেখা মিলত। মাঝে মাঝে স্ট্রলারে করে মেয়েকেও নিয়ে যেতেন তারা।
মেয়েদের এমন নাম রাখার পেছনে শ্যামলার যুক্তি ছিল সুস্পষ্ট।
“যে সংস্কৃতিতে দেবীর অর্চনা করা হয়, সে সংস্কৃতিই শক্তিশালী নারীর জন্ম দিতে পারে,” ২০০৪ সালে ‘লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস’কে এমনটাই বলেছিলেন তিনি।
শৈশবে বেড়ে ওঠা
কমলার ৭ বছর বয়সে বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। এরপর দুই মেয়েকে নিয়ে শ্যামলার সংগ্রামী জীবন শুরু হয় বার্কলের একটি হলুদ ডুপ্লেক্স ভবনের উপরের তলায়।
মেয়েরা যেন নিজেদের শেকড় ভুলে না যায় সেদিকে ছিল ভারতীয় এ নারীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মায়ের কারণেই শৈশবে কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য বানানো ব্যাপটিস্ট চার্চ এবং হিন্দু মন্দির দুই জায়গাতেই কমলা ও মায়ার যাতায়াত ছিল নিয়মিত।
“মা ভালো করেই বুঝেছিলেন যে, তিনি দুটি কৃষ্ণাঙ্গ কন্যাকে বড় করছেন। তিনি জানতেন, তার বেছে নেওয়া দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) মায়া ও আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই দেখবে। আমরা যেন আত্মবিশ্বাসী, গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে বেড়ে উঠি তা নিশ্চিত করতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন,” আত্মজীবনীতে লিখেছেন কমলা।
বাল্যকালে ভারতে বেড়াতে যাওয়া কমলার ওপর যে তার স্বাধীনতা সংগ্রামী নানারও যথেষ্ট প্রভাব ছিল, ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড: অ্যান আমেরিকান জার্নি’ থেকে তারও আঁচ পাওয়া যায়।
শ্যামলা গোপালান কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি নিলে কমলা-মায়াকে মায়ের সঙ্গে বেশ কিছু কাল মন্ট্রিয়লেও থাকতে হয়েছিল।
‘উদীয়মান তারকা’
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি পড়ার পর কমলা হেস্টিং কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি নেন। ১৯৯০ সালে তিনি ওকল্যান্ডে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর ২০০৪ সালে সান ফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি হন কমলা।
দ্বিতীয় মেয়াদে বারাক ওবামাকে প্রার্থী করা ডেমোক্রেটিক পার্টির ২০১২ সালের ন্যাশনাল কনভেনশনে অসাধারণ বক্তৃতা দিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের নজর কাড়েন কমলা।
অবশ্য ওবামার সঙ্গে কমলার সখ্য বেশ পুরনো। ২০০৪ সালে ওবামা সিনেটর হওয়ার আগে থেকেই একে অপরের পরিচিত তারা। ২০০৮ সালে ওবামা প্রেসিডেন্ট পদের মনোনয়ন দৌড়ে নামলে তাকে সমর্থন দেওয়া সরকারি পদধারী ব্যক্তিদের তালিকায়ও কমলা ছিলেন প্রথম।
২০১৪ সালে আইনজীবী ডগলাস এমহফের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধেন কমলা। এর দুই বছর পর সিনেট নির্বাচনে সহজে জয়লাভ করে তিনি পা রাখেন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উচ্চকক্ষে।
প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত, আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে দ্বিতীয় মার্কিন সিনেটর হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারণায় কমলা অভিবাসন ও বিচার প্রক্রিয়ার সংস্কার, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, নারীর প্রজনন অধিকার নিয়ে ছিলেন ব্যাপক সোচ্চার।
সিনেটের সিলেক্ট কমিটি অন ইন্টেলিজেন্ট ও জুডিসিয়ারি কমিটির সদস্য কমলা কংগ্রেসের বিভিন্ন শুনানিতে ধারাল, বুদ্ধিদীপ্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও দ্রুত খ্যাতি অর্জন করেন।
২০১৭ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল জেফ সেশনস এবং পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে ব্রেট কাভানহ’র শুনানিতে তার জিজ্ঞাসাবাদের ধরন দলের ভেতরে-বাইরে তুমুল প্রশংসা অর্জন করে।
প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে রানিংমেট
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আত্মজীবনীমূলক বই ‘দ্য ট্রুথস উই হোল্ড: অ্যান আমেরিকান জার্নি’ প্রকাশিত হওয়ার কিছু দিন পরই কমলা ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
মনোনয়ন লড়াইয়ের শুরুর দিকে কমলাকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ভারমন্টের সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং ম্যাসাচুসেটসের সেনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয়েছিল।
এক বিতর্কে বাইডেনকে অতীতের নেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত এবং সম্প্রদায়গত বিভিন্ন ইস্যুতে নাজেহাল করেও ছেড়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই নারী।
সে সময় জনমত জরিপগুলোতে কমলার অবস্থান একটু একটু করে শক্তিশালী হতে দেখা গেলেও ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে তার জনপ্রিয়তায় ভাটা দেখা দেয়, কমলার প্রচারণা শিবিরেও দেখা দেয় নানান জটিলতা। পরে ডিসেম্বরে মনোনয়ন দৌড় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন কমলা।
মনোনয়ন লড়াই থেকে ছিটকে পড়ার পর চলতি বছরের মার্চে কমলা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে সমর্থন দিয়ে বলেন, “তাকে (বাইডেন) যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট করতে সাধ্যের সবটাই করব।”
মে মাসে মিনিয়াপোলিসে পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকে ডেমোক্রেট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে কমলার নাম সামনের দিকে চলে আসে। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্রের যে কয়জন রাজনীতিবিদ সমাজ ও বিচারব্যবস্থায় সংস্কারের দাবিতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, কমলা ছিলেন তাদের একজন।
পরবর্তীতে গত ১১ অগাস্ট কমলা হ্যারিসকে নির্বাচনী জুটি হিসাবে বেছে নেন বাইডেন৷
রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন, গর্ভপাত, সবেতন ছুটি, সমকামীদের অধিকার, শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বাড়ানো, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, আবাসন, কর ব্যবস্থাপনা সংস্কারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কমলা ডেমোক্রেট মধ্যপন্থি ও প্রগতিশীলদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। যদিও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে তার বার বার অবস্থান বদল ভোটারদের দ্বিধায় ফেলতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন।
আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বাহিনীর যুদ্ধের বিরোধী কমলা ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে আসারও কঠোর সমালোচক।
তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একনিষ্ঠ সমর্থক। ২০১৭ সালে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, “ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং তাদের আত্মরক্ষার অধিকারের প্রশ্নে ব্যাপক সমর্থন জোগাড়ে আমার ক্ষমতার মধ্যে যা যা থাকবে, তার সবটাই আমি করব।”
মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে থাকার পাশাপাশি কমলা বিভিন্ন সময়ে পুলিশ নীতিতে বদল আনারও দাবি তুলেছেন।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত এ নারীর বাগ্মিতা, অভিবাসী শেকড়, কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতি এবং অ্যাটর্নি ও সিনেটর হিসেবে অভিজ্ঞতা দিয়ে ডেমোক্রেটরাও যুক্তরাষ্ট্রে বিভাজনের রাজনীতির ইতি টানার স্বপ্ন দেখছে।
বাইডেনের বয়স এখন ৭৭, যে কারণে এক মেয়াদের বেশি তার প্রেসিডেন্ট পদে থাকা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। ৫৬ বছর বয়সী কমলাকে তরুণ বলা না গেলেও অন্তত বাইডেনের তুলনায় তিনি কম বয়সী তো বটেই।
তাই বয়সের কারণে জো বাইডেন যাদের কাছে মনঃপুত নন, যারা তরুণ কাউকে নেতৃত্বে দেখতে চান, তাদের কাছে পছন্দনীয় হবেন কমলা হ্যারিস; ভোটের ওপরও এর কিছুটা হলেও প্রভাব থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আর বাইডেন যদি নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যানও, তবু বয়সের কারণে তিনি নিজেই চার বছরের বেশি হোয়াইট হাউসে থাকতে ইচ্ছুক নন বলে ঘনিষ্ঠদের ইঙ্গিতও দিয়েছেনও। সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবে কমলাই হয়ে উঠবেন দলের পরবর্তী কাণ্ডারি।
অবশ্য এসব কিছুই নির্ভর করছে ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। হোয়াইট হাউসে ঢুকতে হলে আগে তো ট্রাম্পকে হারাতে হবে।
(সূত্র: ব্রিটানিকা ডটকম, পলিটিকো ডটকম, বিজনেস ইনসাইডার)