সময়ের আবর্তনে আবার চলে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বছর। নানা ঘটনাবহুল চার বছর পেরিয়ে এবারও ট্রাম্প হোয়াইট হাউস দখলের লড়াইয়ে মরিয়া।
সাদা বাড়িতে চার বছর
এ সময়ের মধ্যে অসংখ্যবার বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছেন ট্রাম্প। কখনও ড্রোন-মিসাইল ছুড়ে, কখনও উল্টোপাল্টা কথা বলে, কখনও টুইট করে, মিথ্যা বলে, অবস্থান বদলে- বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট ট্রাম্পের এই সব কীর্তিকলাপের হিসাবও রেখেছে।
হোয়াইট হাউসে আস্তানা গাড়ার পর থেকে দেশের ভেতরে -বাইরে অনেক ওলট-পালট ঘটিয়ে দিয়েছেন তিনি। এক মেয়াদে বদলেছেন একাধিক চিফ অব স্টাফ। প্রেস সেক্রেটারি, উপদেষ্টা- কখন যে কে পদত্যাগ করছেন, কাকে যে ট্রাম্প বরখাস্ত করছেন, তা নিয়ে খাবি খেতে হয়েছে বিশ্বের গণমাধ্যমকে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ট্রাম্পের অভিষেকের দিন থেকে বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু তাতে তো দমবার পাত্র নন ট্রাম্প। উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে সারাক্ষণই তটস্থ রেখেছেন ৭৪ বছর বয়সী এই প্রেসিডেন্ট।
কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে শুরু, এরপর একে একে ওবামাকেয়ার বাতিল, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ, মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর অভিবাসনপ্রত্যাশীদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে বাধা, সরকার অচল, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের উসকে দেওয়া, উগ্র ডানপন্থা সমর্থনের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প আমেরিকান সমাজের ভেতরকার অনুঘটকগুলোর রূপ বদলে দিয়েছেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও কংগ্রেসের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে প্রতিনিধি পরিষদে অভিশংসিতও হয়েছিলেন তিনি। যদিও উচ্চকক্ষ সিনেট রিপাবলিকানদের দখলে থাকায় পদ হারাতে হয়নি তাকে। ২০১৬-র নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে আঁতাত নিয়ে তদন্ত, ট্যাক্স রিটার্ন প্রকাশসহ বেশ কিছু বিষয়ে বিরোধীরা সত্তরোর্ধ এ প্রেসিডেন্টকে বেশ ভোগালেও প্রতিবারই পিছলে যেতে পেরেছেন তিনি।
আমেরিকাকে ‘শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট’ পরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসা ট্রাম্প চার বছরে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেওয়া থেকে শুরু করে আগ্রাসী প্রশাসনিক নীতি নেওয়া, বাগদাদে ড্রোন হামলায় কুদস বাহিনীর কমান্ডার কাশেম সোলেমানি হত্যা, জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নানান আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়া, চীনসহ নানা দেশের অসংখ্য পণ্যে একের পর এক শুল্কারোপ, তেলের দামের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে বিতর্কিত অবস্থান নিয়ে মেয়াদের প্রায় পুরো সময়ই ‘স্পট লাইট’নিজের দিকে টেনে রেখেছেন।
পাদপ্রদীপের সে আলোয় আরও চার বছর থাকতে তার মরিয়া অবস্থান আর ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে টালবাহানাও ‘গণতন্ত্রপ্রেমীদের’ চোখ কপালে তুলে দিয়েছে। নির্বাচনে হারলে তিনি যে সহজে ছেড়ে দেবেন না, ডাকযোগে ভোট নিয়ে তার সন্দেহ আর সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীলদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সে আভাসও দিচ্ছে।
আশা-আশঙ্কার দোলাচল
ট্রাম্পের মেয়াদে বর্ণবাদ আর পুলিশি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য শহরে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের বছরে এসে, এমনকী মহামারীর মধ্যেও সেইসব বিক্ষোভ না থামায় শঙ্কা বেড়েছে রিপাবলিকান শিবিরের।
কেবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভই নয়; করোনাভাইরাস নিয়েও তাদের দুশ্চিন্তা কম নয়। এই মহামারীতে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মৃত্যু ছাড়িয়েছে সোয়া দুই লাখ। ট্রাম্প নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। এরপরও তার বেপরোয়া মনোভাব ভোটের বাক্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
তাছাড়া, সাবেক উপদেষ্টা, আত্মীয় পরিজনের প্রকাশিত নানান বিস্ফোরক বই এবং ২০১৬-১৭ সালে মাত্র ৭৫০ ডলার করে কর দেওয়ার অভিযোগও তাকে বেকায়দায় ফেলতে পারে। নির্বাচনের দোরগোড়ায় এসে বেশির ভাগ জনমত জরিপে সে ইঙ্গিতও মিলছে।
কর সংস্কার, মার্কিন নাগরিকদের কাজের সুযোগ বাড়ানো, মধ্যপ্রাচ্য থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) বিতাড়নসহ এর প্রধান আবু বকর আল বাগদাদীকে হত্যা, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর ওষুধের দাম কমানোসহ অনেক ইস্যুতে ট্রাম্পের ভূমিকা তার সমর্থকদের আশাও দিচ্ছে।
তবে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত ‘সাদা বাড়ির’ দখল ধরে রাখতে পারেন কি-না, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।
ধনকুবের থেকে রাজনীতিবিদ
অথচ ২০১৬ সালের নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ট্রাম্পকে চিনত দেশটির সবচেয়ে রঙদার, জাঁকালো এক ধনকুবের হিসেবে। ব্যবসায়ী ট্রাম্প যে ৭০ বছর বয়সে এসে আমেরিকার রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রে আবির্ভূত হবেন, সেসময় কয়জনই তা ভেবেছিল?
রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী আর অধিকারকর্মীদের এতটা অনাস্থা নিয়ে, একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগ সামাল দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব কি-না, ছিল সে প্রশ্নও।
নিউ ইয়র্কের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ফ্রেডরিক ট্রাম্পের পাঁচ সন্তানের মধ্যে চতুর্থ ডনাল্ড; ১৯৪৬ সালের ১৪ জুন কুইন্সে তার জন্ম।
বাবা ফ্রেডরিক কুইন্স, স্টাটান আইল্যান্ড আর ব্রুকলিন এলাকায় সাধারণ মধ্যবিত্তদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট বানাতেন। অভিবাসীবিরোধী ইমেজ গড়ে তোলা ট্রাম্পের মা একজন স্কটিশ বংশোদ্ভূত; ছুটিতে নিউ ইয়র্ক বেড়াতে এসে ফ্রেডরিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তার।
ধনীর ঘরে জন্ম নিলেও ছোটবেলায় বাবার প্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন-স্তরে কাজ করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন ডনাল্ড। ছোটবেলা থেকেই পরিচিতি পান উদ্যমী আর আগ্রাসী হিসেবে। স্কুলে বেয়াড়াপনার ধারাবাহিক অভিযোগের মধ্যে ১৩ বছর বয়সে তাকে পাঠানো হয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে।
সেখানে উদীয়মান অ্যাথলেট ও ছাত্রনেতা হিসেবে নজর কাড়েন ট্রাম্প। ১৯৬৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ভর্তি হন ফোর্ডহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বছর পর ট্রান্সফার হন পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির হোয়ারটন স্কুল অব ফাইন্যান্সে। ১৯৬৮ সালে সেখান থেকেই অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেন।
কলেজে থাকার সময় গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে বাবার প্রতিষ্ঠানে সময় দিতেন; এলিজাবেথ ট্রাম্প অ্যান্ড সন্স কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে ট্রাম্প তার বাবার কাছ থেকে ১০ লাখ ডলার ধার করে নিজেই রিয়েল এস্টেট ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
বড় ভাই ফ্রেড পাইলট হওয়ার পথে গেলে বাবার ব্যবসার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ডনাল্ডের হাতে। অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের কারণে ৪৩ বছর বয়সেই মারা যান ফ্রেড।
পরে বাবার সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে নিজের ব্যবসার বিস্তৃতিও বাড়িয়ে তোলেন ট্রাম্প। গ্র্যাজুয়েশনের পর ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোর ব্যাপারে বাবাকে রাজি করান তিনি। ১৯৭১ সালে ট্রাম্প কোম্পানির নাম বদলে হয় ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’। ১৯৯৯ সালে ট্রাম্পের বাবা মারা যান।
পারিবারিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ বুঝে নিয়ে ব্রুকলিন ও কুইন্স থেকে প্রকল্প সরিয়ে ম্যানহাটানে বড় বড় ভবন নির্মাণে নজর দেন ট্রাম্প। সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। ম্যানহাটানের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আঁচ করে সেখানে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকেন ট্রাম্প। চমৎকার নির্মাণশৈলী ও জনগণের আস্থার কারণে সেই কাজগুলোই পরে তাকে বিপুল মুনাফা এনে দেয়।
ব্যবসা করতে গিয়ে ট্রাম্প প্রথম প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে। ওই বছর রাজ্য সরকার ট্রাম্প, তার বাবা ও তাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষের অভিযোগ আনে। অভিযোগে বলা হয়, ট্রাম্পের কোম্পানি ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে জাতিগত বৈষম্য করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্টের’ স্পষ্ট লঙ্ঘন। ট্রাম্প অবশ্য বরাবরই সে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৭৫ সালে ট্রাম্পের কোম্পানির সঙ্গে রফায় আসে রাজ্য সরকার। ট্রাম্প তার কর্মচারীদের ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্টের ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার এবং তাদের অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ফেয়ার হাউজিং প্র্যাকটিস নিয়ে প্রচার চালানোর শর্ত মেনে নেন। ১৯৮৭ সালে ট্রাম্পের আত্মজীবনী ‘আর্ট অব দ্য ডিল’-এ ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প।
ওই মামলা চলার সময়ই ট্রাম্প গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল নির্মাণে হাত দেন। ম্যানহাটানের গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনের কাছে পেন সেন্ট্রাল কোম্পানির কমোডোর হোটেল তখন লোকসানে চলছিল। ১৯৭৫ সালে ট্রাম্প হায়াত হোটেল কর্পোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে সেখানে নতুন হোটেল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। হায়াত চেইনের তখনও কোনো বড় হোটেল ছিল না। ট্রাম্প সেখানে নির্মাণ করেন দৃষ্টিনন্দন এক কাচের দালান।
১৯৮০ সালে গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল খুলে দেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লোকসানি একটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক সাফল্য এনে দেওয়ায় ট্রাম্পের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
কমপ্লেক্সটি ১৯৮২ সালে উন্মুক্ত হয়, যার নাম পরে হয় ট্রাম্প টাওয়ার। ৫৮ তলা এই ভবনে রয়েছে ৮০ ফুট দীর্ঘ একটি কৃত্রিম ঝর্ণা। বিলাসবহুল এ ভবন ব্যবসায়ী ও সেলিব্রেটিদেরও আগ্রহী করে তোলে।
১৯৭৭ সালে নিউ জার্সিতে জুয়ার ব্যবসা আইনি বৈধতা পেলে সেখানে টাকা ঢালেন ট্রাম্প। ১৯৮০ সালে তিনি আটলান্টিক সিটিতে জমি কেনেন। হলিডে ইন কর্পোরেশনের অংশীদারিত্বে ১৯৮৪ সালে সেখানে নির্মাণ করেন ২৫ কোটি ডলারের ট্রাম্প প্লাজা। কিছুদিন পর হলিডে ইনের শেয়ার কিনে নেন এবং ওই প্লাজায় নির্মাণ করেন হোটেল ও ক্যাসিনো।
আটলান্টায় হিলটন হোটেলের ক্যাসিনো-হোটেলটিও কিনে নেন ট্রাম্প; ৩২ কোটি ডলার খরচ করে গড়ে তোলেন ট্রাম্প ক্যাসল। অল্প সময়ের মধ্যে ট্রাম্পের হাতে আসে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো হোটেল তাজমহল। ১৯৯০ সালে সেটি ট্রাম্প তাজমহল হোটেল নামে যাত্রা শুরু করে।
আটলান্টিক সিটিতে বড় বড় সব নির্মাণ কাজের সময় ট্রাম্প নিউ ইয়র্কেও বারবাইজন প্লাজা হোটেল ও সেন্ট্রাল পার্কে জমি কিনে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাতে ওই এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়ে যাবে আশঙ্কা করে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো জোট বেঁধে আদালতে যায়। আদালত স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষেই রায় দেয়। পরে ট্রাম্প বারবাইজন প্লাজা হোটেল সংস্কার করেন এবং নাম দেন ট্রাম্প পার্ক।
১৯৮৫ সালে ম্যানহাটানের পশ্চিম পাশে ৭৬ একর জমি কিনে সেখানে টেলিভিশন সিটি নামে একটি কমপ্লেক্স বানানোর ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ডজনের উপর সুউচ্চ ভবন, একটি মল ও নদীমুখী পার্ক নির্মাণের এ পরিকল্পনা প্রযোজনা সংস্থা ও টেলিভিশন কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তুললেও এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে প্রকল্পটি ঝুলে যায়।
১৯৮৮ সালে ট্রাম্প ৪০ কোটি ৭০ লাখ ডলারে প্লাজা হোটেলটি কিনে নেন এবং আরও পাঁচ কোটি ডলার খরচ করে তা ঝকঝকে করে তোলেন। দক্ষিণাঞ্চলে সাম্রাজ্য গড়ার সময় ট্রাম্প ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচেও একটি বিলাসবহুল প্রকল্পের কাজ শেষ করেন।
১৯৮৯ সালে তিনি ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারে ইস্টার্ন এয়ারলাইনস শাটলের একটি শাখা কিনে নেন, পরে যার নাম হয় ট্রাম্প শাটল। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ট্রাম্প ১৯৯২ সালে ওই কোম্পানি বিক্রি করে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে মুম্বাই, ইস্তাম্বুল ও ফিলিপিন্সেও ট্রাম্প টাওয়ারের শাখা আছে।
বিভিন্ন হোটেল ও ক্যাসিনো চারবার দেউলিয়ার খাতায় তার নাম তুললেও বৃহস্পতি ট্রাম্পকে ছেড়ে যায়নি। ১৯৯০ এর জানুয়ারিতে ট্রাম্প লস অ্যাঞ্জেলসে একশ কোটি ডলারের একটি প্রকল্পের ঘোষণা দেন, যেখানে ১২৫ তলা একটি সুউচ্চ অফিস ভবন থাকবে।
২০০০ সালে সুউচ্চ একটি ভবন নির্মাণে আদালতের বাধা অতিক্রম করে আবারও শিরোনামে আসেন ব্যবসায়ী ট্রাম্প। অন্য নির্মাতারা অভিযোগ করে বলেছিলেন- ৮৫৬ ফুট উঁচু ওই ভবন শহরের নির্মাণবিধি লঙ্ঘন করছে। তাদের দাবির মুখে নগর কর্তৃপক্ষও নির্মাণবিধি সংশোধন করে এ ধরনের উঁচু ভবন নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু আদালতের রায় ছিল ট্রাম্পের পক্ষে, তার সেই ভবন নির্মাণ আটকানো যায়নি।
বিনোদোন জগতে পদচারণা
এক সময় বিনোদন জগতেও সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান ডনাল্ড ট্রাম্প। ১৯৯৬ সাল থেকে পরবর্তী দুই দশক তার কোম্পানির ঝুলিতে জমা পড়ে মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ ও মিস টিন ইউএসএ প্রতিযোগিতা আয়োজনের কৃতিত্ব।
২০০৪ সালে এনবিসি টেলিভিশনে ‘দ্য অ্যাপ্রেন্টিস’ নামে একটি রিয়েলিটি শো শুরু করেন ট্রাম্প, যেখানে প্রতিযোগীদের পুরস্কার ছিল ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপকের চাকরি। টানা ১৪টি সিজন ওই শো উপস্থাপনা করেন ট্রাম্প। সেই প্রতিযোগিতা তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার এনে দিয়েছিল।
ওই সময়ই ট্রাম্পের কণ্ঠের ‘ইউ আর ফায়ারড’ ডায়ালগটি বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে। দ্য অ্যাপ্রেন্টিস বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ ডলার সংগ্রহ করেছিল বলেও রিপাবলিকান নির্বাচনী শিবিরের দাবি।
অ্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত ট্রাম্প বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন। তার রয়েছে একটি চেইন শপের ব্যবসা। বিশ্বজুড়ে টাই থেকে শুরু করে বোতলজাত পানি বিক্রি করছে ওই কোম্পানি।
ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, এ ধনকুবেরের সম্পদের পরিমাণ ২০১৬ সালেই ছিল ৩৭০ কোটি ডলারের উপরে। ট্রাম্প অবশ্য সেসময় ওই অংক কোনোভাবেই হাজার কোটি ডলারের কম হতে পারে না বলে দাবি করেছিলেন।
২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ের পর তার ব্যবসার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের পদের ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের’ প্রসঙ্গও সামনে চলে এসেছিল; মেয়ে ইভাঙ্কা আর জামাতা জ্যারেড কুশনারকে হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা বানানোয় তার বিরুদ্ধে ‘স্বজনপ্রীতির’ অভিযোগও ওঠে। নানান মারপ্যাঁচে সেসব দিক ঠিকই সামলে উঠেছিলেন তিনি।
বাবা ও স্বামী
ইভানা ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন; গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল ও প্লাজা হোটেল সংস্কারেও তার ভূমিকা ছিল। এ দম্পতির তিন সন্তান- ট্রাম্প জুনিয়র, ইভাঙ্কা ও এরিক। ১৯৯০ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়।
বিচ্ছেদ নিয়ে মীমাংসার সময় বিভিন্ন ট্যাবলয়েড এ দম্পতিকে নিয়ে নানা মুখরোচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এর মধ্যে ছিল ইভানাকে যৌন নির্যাতন ও অবমাননার অভিযোগ। পরে ইভানা নিজেই সেসব প্রতিবেদনকে ‘সত্য নয়’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
১৯৯৩ সালে মডেল মার্লা ম্যাপলসকে বিয়ে করেন ট্রাম্প। ছয় বছর পর বিচ্ছেদের আগে তাদের ঘরে আসে কন্যাসন্তান টিফানি।
মেলানিয়া নউসের সঙ্গে ট্রাম্পের বিয়ে হয় ২০০৫ সালে। সেই বিয়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অতিথি হয়েছিলেন এবারের নির্বাচনের ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ও তার স্বামী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও।
বয়সে ২০ বছরের ছোট মেলানিয়ার ঘরে একটি ছেলে আছে ট্রাম্পের, তার নাম ব্যারন উইলিয়াম ট্রাম্প। ডনাল্ড ট্রাম্পের নাতি-নাতনির সংখ্যা ৭।
হাতির পিঠে হোয়াইট হাউসে
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা প্রথম বলেন ১৯৮৭ সালে। ১৯৯৯ সালে শুরু হয় তার চেষ্টা। তবে ক্যালিফোর্নিয়া প্রাইমারিতে রিফর্ম পার্টির হয়ে বাজেভাবে হারার পর তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন।
২০০৮ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ‘বার্থার’ আন্দোলনের জনপ্রিয় মুখপাত্রে পরিণত হন ট্রাম্প। ওই আন্দোলনে ওবামার জন্মস্থান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন তোলা হয়। ত্যক্ত বিরক্ত ওবামা এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে তার জন্মের সনদ প্রকাশ করেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নেমে চাপের মুখে আগের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ান ট্রাম্প। ওবামার জন্ম যে যুক্তরাষ্ট্রেই, এক বিবৃতিতে তিনি তা মেনে নেন। উল্টো বার্থার আন্দোলন শুরুর দায় দেন প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটনকে। ২০০৮ সালে মনোনয়ন যুদ্ধের সময় হিলারি শিবিরই নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী ওবামার বিরুদ্ধে প্রথম ওই অভিযোগ তুলেছিল, অন্তত ট্রাম্পের তেমনটাই দাবি।
২০১৫ সালের জুনে ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হতে চেয়ে আনুষ্ঠানিক মনোনয়ন দৌড়ে শামিল হন। ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপাবলিকান পার্টিতে যোগ দেওয়া ট্রাম্প দলের সবচেয়ে বড় দাতা ও তহবিল সংগ্রাহকে পরিণত হয়েছিলেন।
নারীদের প্রতি ট্রাম্পের ধারণা ‘বাজে’- ধারাবাহিকভাবে এমন দাবি করে আসছিল প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাট শিবির। নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে ফাঁস হওয়া একটি টেপ সেই দাবিকে সুসংহত করে। ওই টেপে ট্রাম্প নারীদের বিষয়ে আপত্তিকর কথা বলেছিলেন।
ওই ভিডিওকে ট্রাম্প ‘লকার রুমের’ কথোপকথন বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিজের গা বাঁচাতে ঢাল বানানোর চেষ্টা করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারির স্বামী বিলের কেলেঙ্কারিকে। ট্রাম্প বলেন, “আমি তো কেবল বলেছি, বিল ক্লিনটন তো করেই দেখিয়েছে।”
নির্বাচনের আগে হিলারির সঙ্গে মুখোমুখি বিতর্কের মধ্যেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন বেশ কয়েকজন নারী। সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে ট্রাম্প বলেন, তাকে ফাঁসাতে হিলারি শিবির ও প্রভাবশালী কয়েকটি গণমাধ্যম ‘নাটক সাজিয়েছে’।
প্রচারের বিভিন্ন সময় নারীদের নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যসহ অনেক ইস্যুতে প্রভাবশালী অনেক রিপাবলিকান নেতা ও সিনেটর সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় সাময়িক ভাটা পড়ে।
তবে সেসব টপকে নির্বাচনের আগে আগে ইমেইল কেলেঙ্কারিতে পর্যদুস্ত হিলারির সঙ্গে ব্যবধান অনেকটাই কমিয়ে আনেন এই ধনকুবের। বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে ৮ নভেম্বর ভোটে জিতে তিনি হয়ে যান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তার রানিংমেট হয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়ে যান মাইক পেন্স।
বিপদের সময় প্রভাবশালী যে রিপাবলিকান সিনেটররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি দেখিয়ে দেবেন, ‘কী করে জিততে হয়,’আর তা তিনি করেও দেখিয়েছেন।
এবারও কি তাই হতে যাচ্ছে? বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্প জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বিভেদের ক্ষত যেমন আরও গভীর হবে, তেমনি বিশ্বজুড়ে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক লড়াই হবে আরও তীব্রতর।
এমনিতেই বিশ্বজুড়ে বাড়ছে অস্ত্রের ঝনঝনানি, ট্রাম্পের নীতি তাতে আরও হাওয়া দিতে পারে, ফলশ্রুতিতে পৃথিবীজুড়ে সামরিক সংঘাত বেড়ে যেতে পারে। অবশ্য তাতে ট্রাম্পের কী-ইবা এসে যায়? তিনি তো কেবল আমেরিকাকেই ‘গ্রেট’ বানাতে চাইছেন, পুরো বিশ্বকে নয়।