নাগোরনো-কারাবাখ সংঘাত: সর্দারিতে তুরস্ককে চান এরদোয়ান

নাগোরনো-কারাবাখ ঘিরে সংঘাতে আজারবাইজানকে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ানের দৃঢ় সমর্থন একদিকে যেমন তুরস্ককে ওই অঞ্চলের অন্য বৃহৎ শক্তিগুলো থেকে আলাদা করেছে, তেমনি যুদ্ধবিরতি চাওয়া নেটো মিত্রদের করেছে শঙ্কিত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2020, 12:42 PM
Updated : 7 Oct 2020, 01:07 PM

আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের এ সংঘাতে আঙ্কারার এই দৃঢ়চেতা অবস্থান এরদোয়ানের জন্য কৌশলগত অগ্রাধিকারের পাশাপাশি ব্যয়বহুল পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। কেননা এর মাধ্যমে তিনি দেশের বাইরে তার সামরিক শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের ভেতর নিজের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারছেন। 

তুর্কি এ প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি আজারবাইজানের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে গিয়ে তুরস্কের চাহিদার কথাও তুলে ধরেছেন। বলেছেন, বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজের জায়গা প্রাপ্য আঙ্কারার।

সংকট মোকাবেলায় মধ্যস্থতাকারী বৃহৎ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে নাগোরনো-কারবাখের এবারের সংঘাতকে এরদোয়ান সুযোগ হিসেবেই দেখছেন বলে পর্যবেক্ষকদের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তুর্কি প্রেসিডেন্টের আকাঙ্ক্ষা বিতর্কিত ওই অঞ্চলকে ঘিরে যে পরিস্থিতি গত কয়েক দশক ধরে বিরাজ করছিল, তা বদলে দেওয়া।

নাগোরনো-কারবাখ এলাকাটি আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের এলাকা হিসেবে স্বীকৃত হলেও আর্মেনীয় জাতিগোষ্ঠী এটির নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। গত কয়েক দশক ধরে এই দুই পক্ষের মধ্যে কোনো ধরনের সংঘাত বা ঝামেলা বাধলে ফ্রান্স, রাশিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্র মধ্যস্থতা করেছে। 

আঙ্কারা এখন ওই এলাকায় নিজের হিস্যা নিশ্চিত করতে চায় বলে মন্তব্য করেছেন রবার্ট বশ অ্যাকাডেমির ফেলো গালিপ ডালায়।

“তুরস্কের চাওয়া হচ্ছে মানচিত্রের প্রায় প্রতিটি কোণে ঝামেলা পাকানো। যা কিছু এখনকার স্থিতাবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলবে, তা-ই তার জন্য ভালো। কেননা আগের স্থিতাবস্থা যে তার স্বার্থবিরোধী ছিল, তা দেখা গেছে। নাগোরনো-কারবাখকে কেন্দ্র করে একটি হিমশীতল লড়াই চলছিল, নানাবিধ কারণে এটি মূলত আর্মেনিয়ার হাতেই ছিল। তুরস্ক এখন এই খেলাটাকে দুর্বল করতে চায়, যদি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিতে নাও পারে, তাও,” বলেছেন রবার্ট।

আজারবাইজান-আর্মেনিয়া সংঘর্ষে তুরস্কের অবস্থানকে পর্যবেক্ষকরা একদিকে আর্মেনিয়ার জন্য বড় ধরনের হুমকি অন্যদিকে রাশিয়ার জন্য সাবধানবাণী হিসেবে দেখছেন। কেননা রাশিয়ার সঙ্গে আর্মেনিয়ার প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। 

সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকে ড্রোন যুদ্ধের যে অভিজ্ঞতা, সে অনুযায়ী নিজেদের আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন দেখাতেও নাগোরনো-কারবাখ সংঘর্ষে আঙ্কারার দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে পড়া।

সাম্প্রতিক সংঘাতে আজারবাইজানের আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছে তুরস্কের বানানো ড্রোন। আঙ্কারা এ যুদ্ধাস্ত্রের যাবতীয় অবকাঠামোও সরবরাহ করছে বলে রয়টার্সকে তুরস্কের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। লড়াইয়ের মাঠে তুরস্কের কোনো সৈন্য নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।

এরদোয়ান অবশ্য অন্য একটি বিষয় নিয়েও বাজি ধরেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। তার বিশ্বাস, নাগোরনো-কারবাখ নিয়ে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে এখন যে সম্পর্ক তাতে দুই দেশ ওই এলাকায় বিস্তৃত লড়াইয়ে জড়াবে না। 

নাগোরনো-কারবাখকে কেন্দ্র করে এবারের রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরুর পর আগের মতোই রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স যুদ্ধবিরতি চাইলেও এরদোয়ান বলেছেন, এ তিন দেশ গত তিন দশক ধরে মূল সংকটটাকেই এড়িয়ে গেছে, যে কারণে তাদের আর শান্তি প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেওয়া উচিত নয়। 

আঙ্কারার ভাষ্য, নাগোরনো-কারবাখে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা, তা নির্ভর করছে সংঘাতের পর কী কী হবে সে সংক্রান্ত প্রস্তাবনার উপর। 

বিতর্কিত এ অঞ্চলে সংঘাত নিয়ে তুরস্ক-ফ্রান্স কথার লড়াইও চলছে। ফ্রান্সের জন্য এ বিষয়ে নাক গলানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কেননা দেশটিতে আর্মেনীয় বংশোদ্ভূতের সংখ্যা অনেক।

রয়টার্স বলছে, সাম্প্রতিক বিভিন্ন যুদ্ধে আঙ্কারার সামরিক সফলতা এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এর সমরশক্তির বহিঃপ্রকাশ তুরস্কে জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলোর মিত্র ক্ষমতাসীন একে পার্টির জন্য আশীর্বাদ হয়েই আবির্ভূত হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে ধ্বস এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের পরও ভূমধ্যসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অধিকার নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানের কারণে এরদোয়ানের জনসমর্থন ৫ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে মেট্রোপোল রিসার্চ গ্রুপ।

আজারবাইজান থেকে গ্যাস আমদানিও নাগোরনো-কারবাখ সংঘাতে তাদের পক্ষে তুরস্কের দৃঢ় অবস্থানের অন্যতম কারণ। ২০২০ সালের প্রথমভাগে আজারবাইজান থেকে তুরস্কে গ্যাস আমদানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। 

চলতি বছর তুরস্ক তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয়ও অনেক বাড়িয়েছে। তবে এত কিছুর পরও এরদোয়ানের কাছে সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে, ইরাকে ও লিবিয়ায় অভিযান বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তুরস্কের অন্য এক কর্মকর্তা।

“না মহামারী, না বাজেটের অবনতি কোনো কিছুই প্রতিরক্ষা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাধা নয়। এটি পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়, বাধ্যতামূলক। তুরস্ক এখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে একই ময়দানে আছে। আমরা ছোট চিন্তা বা কাজ করতে পারি না,” বলেছেন তিনি। 

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি কমার সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকাগুলোতে সৃষ্টি হওয়া শূন্যস্থান পূরণে তুরস্ক ও রাশিয়া চেষ্টা ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য সিরিয়ার ইদলিবের মতো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আঙ্কারা-মস্কো যেমন কূটনীতির আশ্রয় নিচ্ছে; তেমনি লিবিয়ার মতো ঘটনায় তারা বিপরীত শিবিরে অবস্থান নিতেও দ্বিধা করছে না। 

নাগোরনো-কারবাখ সংঘাতে তুরস্ক তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরীয় বিদ্রোহীদের আজারবাইজানের হয়ে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছে বলে যে দেশগুলো অভিযোগ করেছে তার মধ্যেও রাশিয়া আছে। 

তবে বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুতে একে অপরকে সমর্থন দেওয়া মস্কোর সঙ্গে আঙ্কারার এ বিরোধ বেশিদূর গড়াবে না বলেই বিশ্বাস তুর্কি ওই কর্মকর্তার। যে কারণে নাগোরনো-কারবাখকে কেন্দ্র করে হওয়া সংঘাতে রাশিয়ার বিপরীত শিবিরে থাকা নিয়েও খুব বেশি উদ্বিগ্ন নন তিনি।