চীনকে থামাতে ‘দেরি হয়ে গেছে’

শীর্ষ চীনা ভিন্নমতাবলম্বী, শিল্পী ও চলচ্চিত্রনির্মাতা আই ওয়েইয়েই বলেছেন, বিশ্বে বেইজিংয়ের প্রভাব এত ব্যাপক হয়েছে যে একে আর এখন কার্যকরভাবে থামানো যাবে না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2020, 09:00 AM
Updated : 29 Sept 2020, 09:16 AM

“চীনকে নিয়ে পশ্চিমের আরও কয়েক দশক আগেই উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার ছিল। ইতোমধ্যেই কিছুটা দেরি হয়ে গেছে, কেননা চীনে পশ্চিমারা যে শক্তিশালী ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে, এখন তা কেটে ফেলতে চাইলে সেটি গভীরভাবে আঘাত করবে। এ কারণেই চীন বেশ উদ্ধত,” বলেছেন তিনি।

সুপরিচিত এ শিল্পী চীনের ব্যাপারে তার আগের অবস্থানেই অটল আছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

“এটা একটা পুলিশি রাষ্ট্র,” বলেছেন আই।

চীনা এ শিল্পী ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের জন্য বার্ড’স নেস্ট স্টেডিয়ামের নকশা করে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

চীনের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে ব্যাপক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার পর ২০১৫ সালে তিনি ইউরোপ চলে যান। প্রথমে জার্মানির বার্লিনে বসবাস করলেও গত বছর থেকে তিনি যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজে থাকছেন।

আই’র ধারণা, চীন এখন তার বিপুল অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বজুড়ে তার রাজনৈতিক প্রভাব চাপিয়ে দিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন অনেক বেশি আগ্রাসীও হয়ে উঠেছে।

এক দশক আগেও বিশ্বজুড়ে চীন নিজেদের একটা ‘বিনয়ী চেহারা’ হাজির করতো। দেশটির সরকারের আনুষ্ঠানিক স্লোগানও ছিল- ‘শক্তি লুকিয়ে রাখো, অনুকূল সময়ের অপেক্ষা করো’।

সেসময় মন্ত্রীরা যে দিকটির উপর জোর দিতেন তা হল- চীন এখনও একটি উন্নয়নশীল দেশ এবং পশ্চিমাদের কাছ থেকে এর এখনও অনেক কিছু শেখার আছে।

শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর চীনের সুর বদলে যায়।

২০১২ সালে শি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হওয়া পরের বছর চীনের প্রেসিডেন্ট হন। এরপর থেকে চীনের আগের ‘বিনয়ী চেহারা’ উধাও হয়ে যায়। তাদের নতুন স্লোগান হয়- ‘অর্জনের জন্য সংগ্রাম’।

এক হিসেবে চীন এখনও একটি উন্নয়নশীল দেশ, কেননা এর প্রায় ২৫ কোটি বাসিন্দা এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এর মধ্যেই দেশটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী এক দশকে কিংবা তারও আগে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।

চীনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক হু শিজিন। ছবি: সিএনএন

এমন এক সময়ে বিশ্বজুড়ে চীনের প্রভাব বাড়ছে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব প্রতিদিনই একটু একটু করে কমছে। বেইজিংয়ের প্রভাবও এ কারণেই গ্রিনল্যান্ড থেকে ক্যারিবীয় অঞ্চল, পেরু থেকে আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে, পাকিস্তান থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত প্রতিদিনই আরও বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। 

বারবাডোজ যে সম্প্রতি তাদের রাষ্ট্রপ্রধানের স্থান থেকে রানিকে বাদ দিয়েছে এ জন্যও চীনকে দায়ী করা হচ্ছে। বেইজিংয়ের চাপের কাছে মাথা নত করেই বারবাডোজ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির প্রধান টম টুগেনডাটের। 

দালাই লামা যখন ডাউনিং স্ট্রিট সফর করেছিলেন, তখন অ্যাংলো-চীনা সম্পর্ক অনেকটাই শীতল হয়ে পড়েছিল।

চেক রিপাবলিকের পার্লামেন্ট স্পিকার সম্প্রতি তাইওয়ান সফরে যাওয়ার পর চীনের এক শীর্ষ কূটনীতিক সতর্ক করে বলেছিলেন, “চেক সিনেটের স্পিকার এবং তার পেছনে থাকা চীনবিরোধী শক্তির এমন খোলামেলা উসকানির মুখে চীনের সরকার ও জনগণ চুপচাপ বসে থাকবে না। (এর জন্য) তাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হবে।” 

সারাবিশ্বেই চীনের উপস্থিতি এখন এতটাই প্রকট যে, কোনো দেশ যদি বেইজিংয়ের মৌলিক কোনো স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ জানায়, তাহলেই তাকে ভুগতে হচ্ছে।

যদিও চীনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক হু শিজিন এ অভিযোগ মানতে নারাজ।

“আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, চীন কি কখনও কোনো দেশকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে চাপ দিয়েছিল? এরকমটা করে যুক্তরাষ্ট্র। তারা ধারাবাহিকভাবে বিশ্বজুড়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে। তারা অসংখ্য দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

“এমন কোনো দেশের কথা কি আপনি জানেন, চীন যাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে? আমরা কি কখনো একটি পুরো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি? কেবল সুনির্দিষ্ট কিছু ইস্যুতে আমরা মাঝে মধ্যে আমাদের অসন্তোষের কথা জানাই, তাও জানাই তখন, যখন আমাদের দেশকে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়,” বিবিসির সাংবাদিককে হু এমনটাই বলেছেন।

চীনের সঙ্গে এই মুহুর্তে তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কানাডা, ভারত, ব্রিটেন ও অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের রাখঢাকহীন দ্বন্দ্ব চলছে। ভারতের সঙ্গে সম্প্রতি সীমান্তে প্রাণঘাতী সংঘর্ষেও জড়িয়েছে তারা।

কিছুদিন আগে হু গ্লোবাল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে অস্ট্রেলিয়াকে ‘চীনের জুতার নিচের অংশে লেগে থাকা চুইংগাম’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রভাবশালী এ সম্পাদক জানান, অস্ট্রেলিয়ার এখনকার ক্ষমতাসীনরা চীনকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ ও বিরক্ত করে যাচ্ছে।

“আমার মনে হয়েছে তারা আমার জুতার নিচে আটকে থাকা চুইংগামের মতো। ঝাঁকি দিয়েও যা আমি ফেলতে পারছি না। এটা মোটেও চমৎকার কোনো অনুভূতি নয়। আমি আমার মত বলেছি, আর যে কোনো বিষয়ে মতামত প্রকাশের অধিকার  আমার আছে,” বলেছেন চীন সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এ সম্পাদক। 

হংকং নিয়েও তার মতের সঙ্গে বেইজিংয়ের অবস্থানের মিল রয়েছে।

“চীনের সরকার হংকংয়ের গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা, এমনকী রাস্তায় তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার নিয়েও আপত্তি জানায়নি। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে- তাদেরকে শান্তিপূর্ণ থাকতে হবে। সহিংস প্রতিবাদের বিরুদ্ধে হংকং পুলিশের আরও কঠোর অবস্থানকেও আমরা সমর্থন দেবো।

“যদি সহিংস বিক্ষোভকারীরা পুলিশ সদস্যদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠে, যখন তারা ধারালো প্রজেক্টাইল ছোড়ে, পুলিশ সদস্যদের দিকে পেট্রল বোমা বা মলোটোভ ককটেল ছোড়ে, আমার মনে হয় তখন পুলিশকে তাদের বন্দুক ব্যবহারের এবং তারা যেন গুলি ছুড়তে পারে তার অনুমতি দেওয়া উচিত,” বলেছেন হু।

অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, চীনের এ আগ্রাসী আচরণের পেছনে সে আসলে তার ‘নার্ভাসনেস’ আড়াল করছে। কেননা, দেশটির সরকারে থাকা কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচিত নয়; এ কারণে চীনা জনগণের মধ্যে দলটির সত্যিকারের সমর্থক কতজন, তা জানার কোনো উপায়ও নেই।

জনগণের সমর্থন ছাড়া বড় কোনো সংকট, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটে তারা টিকে থাকতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

দেশটির প্রেসিডেন্ট শি এবং তার সহকর্মীদের স্মৃতিতে ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সালের মধ্যেই বিরাট সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের স্মৃতিও থাকার কথা।

হু অবশ্য বলছেন, বিশ্বে নতুন কোনো স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন না তিনি।

নানান বিষয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ থাকলেও বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আক্রমণাত্মক কথাবার্তার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন; নির্বাচনে জয়লাভের জন্যই তিনি এসব বলছেন বলে ধারণা হু’র।

“নির্বাচনের পর, যে-ই জিতুক না কেন, পরিস্থিতির উন্নতি হবে,” বলছেন তিনি।