মহামারীতে অন্ধকার ভবিষ্যতের পথে লাখো শিশু

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্বজুড়ে গরিব লাখ লাখ শিশুকে পরিবারের খরচ যোগাতে লেখাপড়া ছেড়ে কাজে নামতে হয়েছে, বেড়েছে শিশুশ্রম। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় ওই সব শিশুরা হয়ত চিরদিনের জন্য ঝরে পড়বে।

>> দ্যনিউ ইয়র্ক টাইমস
Published : 28 Sept 2020, 02:19 PM
Updated : 28 Sept 2020, 05:25 PM

মহামারী বহু মানুষকে কর্মহীন করে দিয়েছে। লকডাউনের কারণে বিশেষ করে শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষের আয় বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই পরিবারের খরচ মেটাতে বাবা-মার পাশাপাশি ‍শিশুরাও কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে।

বেশিরভাগ সময় এইসব শিশুদের অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ করতে হয়। কোথাও কোথাও তারা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে। এমনকি কখনও কখনও শিশুদের অত্যন্ত বিপদজনক কাজও করতে দেখা যায়। অথচ বিশ্বের প্রায় সব দেশে শিশুশ্রম অবৈধ।

সব শিশুর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা, শিশুশ্রম বন্ধ এবং জীবনমানের উন্নতির মাধ্যমে তাদের দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল মহামারীর কারণে তার প্রায় সবই এখন বন্ধ হয়ে গেছে।

অসংখ্য মেধাবী শিশুর শিক্ষা জীবন থেমে গেছে। মহামারী যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে কবে স্কুল খুলবে তা কেউ বলতে পারছে না। স্কুল খুললেও সব শিশু ফিরতে পারবে কিনা না নিয়েও ঘোরতর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

মহামারীর মধ্যে দরিদ্র এসব শিশুর দিন কীভাবে কাটছে তা নিয়ে ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ কাজ:

মহামারীর মধ্যে স্কুল বন্ধ, পরিবারের আয়ও কমে গেছে। তাই অনেক শিশুই ইট ভাটায় বা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। সেখানে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিকদের মত ভারী ওজনের মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে।

কেউ কেউ ময়লা পরিষ্কারের কাজ করছে, মেয়ে শিশুরা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক শিশু খনিতে, বিড়ি, সিগারেট বা আতশবাজি তৈরির কারখানায় নোংরা পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে।

এই রকম এক শিশু ভারতের ১১ বছরের রাহুল। যে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। তার শিক্ষকরা জানান, রাহুলের সেই মেধাও আছে। কিন্তু তাকে এখন বাবার সঙ্গে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খালি পায়ে ময়লার ভাগাড় থেকে ‘রিসাইকেল’ করা যাবে এমন জিনিস খুটে বিক্রি করতে হয়।

বর্তমানে ভারতে সবচেয়ে দ্রুত কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ছে। এই দেশটিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্কুল যাওয়ার বয়সী শিশুর বাস। ভারতে ১৪ বছরের কম বয়সের শিশুদের শ্রম অবৈধ। কিন্তু দারিদ্র্যর কারণে দেশটিতে মহামারীর আগেও প্রচুর শিশুকে পরিবারের খরচ মেটাতে কাজ করতে হয়। বর্তমানে সেখানে শিশুশ্রম আরো অনেক বেড়ে গেছে। সেখানে বাল্যবিবাহ, অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ এবং শিশুপাচারও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

লাখো শিশুর স্কুলে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে:

স্কুল বন্ধের সময় যত লম্বা হবে, শিশুরা তত দীর্ঘসময় স্কুলের বাইরে থাকবে। এদিকে, দরিদ্র পরিবারগুলোতে অভাব-অনটন বাড়ছে। ফলে ওই সব পরিবারের শিশুদের স্কুলে ফেরার সম্ভাবনাও দিন দিন কমছে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহামারীর কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় দুই কোটি ৪০ লাখ শিশু স্কুলে থেকে ঝরে যাবে।

মহামারীতে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে স্কুল বন্ধ রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে স্কুলগামী প্রায় ১০০ কোটি শিশুর উপর। তাদের অনেকেই বাড়িতে অনলাইনে ক্লাস করার সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ তাদের বাড়িতে স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেই। কারও কারও বাড়িতে পড়া দেখিয়ে দেওয়ার মতও কেউ নেই।

ওই শিশুদের বেশিরভাগই এখন বাড়িতে বসে না থেকে পরিবারকে সাহায্য করতে নানা কাজ শুরু করেছে। পরিবারগুলোও তাদের আয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ফলে স্কুল খুললেও কাজ বাদ দিয়ে তাদের স্কুলে ফেরা আর হয়ত হবে না।

ভারতের বিহারের ১২ বছরে কিশোর মুমতাজ বলে, ‘‘আমার ভয় হচ্ছে, হয়ত স্কুল খুললেও আমি আর সেখানে ফিরতে পারব না। আমাকে পরিবারের ঋণ শোধ করতে এই কাজই করে যেতে হবে।”

মুমতাজ পাথর তোলার মত কষ্টসাধ্য কাজ করছে। এই সব শিশুদের পরিবারও অসহায় অবস্থায় পড়েছে। তারা বলছে, যদি তারা শিশুদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে নেয় তবে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে।

মহামারীর কারণে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। ফলে শ্রমবাজারে চাহিদা ও যোগানের নিষ্ঠুর খেলা শুরু হয়ে গেছে। শ্রমিকের যোগান বেশি থাকায় মজুরি হ্রাস পেয়েছে। ফলে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির আয় কমে গেছে। কিন্তু খরচ একই আছে বা বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় জীবন বাঁচাতে বাড়তি আয়ের জন্য পরিবারের শিশুরাও শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে।

কয়েক দশকের অগ্রগতি হুমকির মুখে:

কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে দারিদ্র্য কমতে শুরু করেছিল। যার ফলে বেশিরভাগ শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছিল। সরকার থেকেও শিশুদের স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে পরিবারকে আর্থিক সহায়তা এবং স্কুলে শিশুদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার মত নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কায় দেশগুলোর অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। তাদের উন্নয়নের গতি হ্রাস পেয়েছে বা পিছিয়ে গেছে।

অর্থনীতি বাঁচাতে ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশ সংক্রমণ বৃদ্ধির মধ্যেই সব কিছু খুলে দিচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে তা কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর লেগে যাবে। ফলে সমাজের কল্যাণে নেওয়া অনেক উদ্যোগই তহবিল সঙ্কটে বন্ধ হয়ে যাবে।