জাপান: ইয়োশিহিদে সুগার ‘অপ্রত্যাশিত উত্থান’

শিনজো আবে এতদিন ধরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যে, বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলের মানুষের কাছেই তার মুখটি পরিচিত হয়ে উঠেছিল এবং সম্ভবত সবাই তার নামের উচ্চারণও জানতেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2020, 10:38 AM
Updated : 16 Sept 2020, 01:20 PM

এখন জাপানের প্রধানমন্ত্রী বদলে গেছে। আবের স্থলাভিষিক্ত ইয়োশিহিদে সুগাও কী তার পূর্বসূরির মতো এতটা পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন? তার নামের উচ্চারণও কি একইভাবে সবাই জানবে?

বিবিসি জানিয়েছে, একমাস আগেও সম্ভবত খুব কম লোকই জাপানে কী ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে ধারণা করতে পেরেছিল।

প্রথমত, আবের পদত্যাগ। বিশেষ করে টোকিও অলিম্পিকের আগে তিনি পদত্যাগ করবেন এটি কারও প্রত্যাশাতেই ছিল না। এই টোকিও অলিম্পিকের আয়োজন ছিল আবের অতি আকাঙ্ক্ষিত।

আবের প্রস্থানের চেয়েও সুগা যে তার স্থলাভিষিক্ত হবেন, এ ধারণা করা লোকের সংখ্যা ছিল আরও কম।

৭১ বছর বয়সী সুগা পরিচিত ছিলেন আবে’র ‘ফিক্সার’ হিসেবে; যার কাজ পর্দার আড়ালের থেকে দায়িত্ব সমাধা করা। 

সম্প্রতি তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, নিজেকে কী আপনি চমৎকার লোক মনে করেন?

সুগা’র উত্তর, “আমি তাদের কাছে খুবই চমৎকার, যারা তাদের কাজ ঠিকঠাক করতে পারে।”

 

জনসমক্ষে তাকে খুব একটা হাসতে দেখা যায় না। সরকারি মুখপাত্র হিসেবেও তিনি তেমন আকর্ষনীয় নন। প্রশ্ন পছন্দ না হলে সেসব বিষয়ে উত্তর দিকে অস্বীকৃতি জানানোয় জাপানি সাংবাদিকদের কাছে সুগা’র ডাকনাম ‘লৌহ প্রাচীর’।

দীর্ঘদিন ধরে টোকিওর বাসিন্দা অর্থনীতিবিদ জেসপার কোলের মতে, পর্দার আড়ালে থেকে যারা লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের হাতে অন্য কোনো বিকল্প না থাকাতেই তারা সুগাকে দলীয় নেতৃত্বে এনেছেন।

“এলডিপির ভেতরে ধোঁয়াশাপূর্ণ কক্ষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে এটি ঠিক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়ার এ প্রক্রিয়ায় জাপানের জনগণের বলার কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত, আপনি আপনার দলের জন্য তখনই ভালো কিছু নিয়ে আসবেন, যখন আপনি নির্বাচনে জিতবেন।

“যে কারণে সুগা ব্যাপক চাপে থাকবেন। তাকে দলের কাছে, জাপানের জনগণের কাছে, তিনি যে প্রধানমন্ত্রীত্বের যোগ্য, তা প্রমাণ করতে হবে,” বলেছেন কোল।

সুগার যে রাজনৈতিক দক্ষতা নেই, তা নয়। জাপানের মুখ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে তিনি তার পূর্বসূরীদের চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছেন। দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলার জন্য তার খ্যাতি আছে; জাপানের ‘বাইজেন্টাইন’ আমলাতন্ত্র কীভাবে কাজ করে, সে সম্বন্ধেও তিনি ব্যাপক ধারণ রাখেন।

কিন্তু এসব গুণ কি তাকে নির্বাচনে জেতাতে পারবে?

টোকিওর সোফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কোইচি নাকানোর মতে, সুগা’র এসব গুণ নির্বাচনে জেতার জন্য যথেষ্ট নয়।

“তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন, কেননা তার রয়েছে গণমাধ্যমসহ বিরোধীদের ভয় দেখানো, পর্দার আড়ালে হওয়া চুক্তিগুলোতে প্রভাব বিস্তার করা এবং আমলাতন্ত্রকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক দক্ষতা। কিন্তু যখন দলের মুখ হয়ে ওঠার বিষয় থাকবে, যখন এক বছরের মধ্যে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়বে, তখন তিনি আর অতটা যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন না, কেননা তিনি খুব একটা বাকপটু নন,” ভাষ্য নাকানোর।  

সুগার বাগ্মিতার ঘাটতি দেখা গেছে সোমবার দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের ভোটে জয়ী হওয়ার পর দেওয়া ভাষণেও। অনভ্যস্ত টানে, দীর্ঘ বিরতি নিয়ে তিনি সমর্থকদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আমলাতন্ত্রের স্বার্থান্বেষী ভূমিকা ও অন্ধ আনুগত্যের নজির গুড়িয়ে দেওয়ার। 

তবে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে এখনই বাতিলের খাতায় ফেলতে রাজি নন জেসপার কোল। সুগাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন বলেই জানেন, ৭১ বছর বয়সী এ ব্যক্তি নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে কতটা সচেতন।

“তিনি এমন মানুষ, যিনি ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠেন এবং ১০০বার উঠ-বস করেন; তারপর সব খবরের কাগজ পড়ে ফেলেন। ভোর সাড়ে ৬টার মধ্যেই তিনি ব্যবসায়ী, উপদেষ্টা এবং বাইরের সব অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে দেন। তিনি স্পঞ্জের মতো শুষে নেন এবং দেশের জন্য সবকিছুই করতে চান।

“তিনি ক্ষমতার সঙ্গে আসা চাকচিক্য কিংবা জৌলুসের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নন,” বলেছেন কোল। 

‘চাকচিক্য আর জৌলুসকে’ সন্তর্পণে এড়িয়ে চলার এ অভ্যাস সুগা সম্ভবত তার অতীত থেকে রপ্ত করেছেন।

স্ট্রবেরী চাষীর এ সন্তান জন্ম নিয়েছিলেন উত্তর জাপানের ছোট্ট একটি গ্রামে। ১৮ বছর বয়সে তিনি টোকিও চলে আসেন। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগাতে তাকে একটি কার্ডবোর্ড ফ্যাক্টরিতেও কাজ করতে হয়েছিল।

নিজের পায়ে দাঁড়ানোর এই অতীতই জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে তার বেশিরভাগ পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা করেছে। যেমন শিনজো আবে; ৮ বছর ধরে জাপানের ক্ষমতায় থাকা আবের বাবা ছিলেন জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দাদা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

নাকানো বলছেন, সুগার উত্থানের কাহিনী চমৎকার হলেও তার অতীতই তাকে ক্ষমতাসীন এলডিপির ভেতরকার দ্বন্দ্বে দুর্বল করে রাখবে।

“যেহেতু সুগা সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসেছেন, সে কারণেই তার নিজস্ব কোনো শক্তিশালী ঘাঁটি বা অবস্থান নেই। তিনি দলের ভেতরকার কোনো অংশেরও প্রতিনিধিত্ব করেন না। আবের পছন্দের কারণেই তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন।

“পার্টির নেতারাও জরুরি এ অবস্থায় সুগার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু যখন এ জরুরি দৃশ্যপটের সমাপ্তি ঘটবে এবং যখন দলের নেতারা বুঝতে শুরু করবেন, যে তারা যা চাইছেন তার সব সুগার কাছ থেকে আদায় করা যাচ্ছে না; আমি নিশ্চিত যে তখন ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হবে,” বলেছেন নাকানো।  

সুগার ভুলের অপেক্ষায় অনেকেই বসে আছেন, তাদের মধ্যে এলডিপির অনেক তরুণও আছেন, যাদের যোগাযোগ তুলনামূলক বেশ ভালো; আর জাপানের ক্ষমতাকাঠমোও এমন টালমাটাল, যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটে যেতে পারে।

যেমনটা আবের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। এতদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাও পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার আগে আগে আবের অ্যাপ্রুভাল রেটিংও ৩০ শতাংশে এ নেমে এসেছিল। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় তার সরকারের পদক্ষেপে অসন্তুষ্টি থেকেই এমনটা হয়েছিল।

এরপরও আবের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল জাপানে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। ২০১২ সালে তিনি নির্বাচিত হওয়ার আগে জাপান তার আগের তিন দশকে ১৯ জনকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখেছিল।

সেসময় সরকারপ্রধানের এ পদকে বলা হত ‘রিভলভিং ডোর’। অনেকের ধারণা, আবের পদত্যাগের পর জাপানের রাজনীতিতে আবারও পুরনো অস্থিরতার দেখা মিলতে পারে।

“হতে পারে, দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্বে থাকা একজন প্রধানমন্ত্রীর পর আমরা এবার স্বল্প সময়ের জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী পেতে যাচ্ছি। আমার মনে হয়, আমরা এমন এক সময়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি যখন স্বল্প সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা অনেককে পাওয়া যাবে। বোঝা যাচ্ছে না, এই পরিবর্তন কি ১০ মাস পরপর হবে, নাকি দুই বছর পরপর।

“জাপানের জন্য ভালো হবে, যদি এ পদে প্রতিবছরই নতুন নতুন কেউ না আসে,” বলেছেন হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপান বিষয়ক পর্যবেক্ষক ক্রিস্টি গোভেলা।

বিশ্লেষকদের এসব অনুমান কোনোভাবেই সুগার জন্য স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। ৭১ বছর বয়সী এ নতুন প্রধানমন্ত্রীকে তাই অনেক কিছুই প্রমাণ করে দেখাতে হবে, আর এর জন্য তিনি হয়তো খুব বেশি সময়ও পাবেন না।

আরও পড়ুন