যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক সময়কার শত্রু, এখন মিত্র’ ওপেকের ৬০ বছর

সাতচল্লিশ বছর আগে পেট্রলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের আরব সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে প্রায় ধসিয়ে দিয়েছিল; আর এখন ছয় দশক পুরনো এই জোট তাই করছে, ওয়াশিংটন যা চাইছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2020, 01:07 PM
Updated : 13 Sept 2020, 01:41 PM

১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে (আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ নামে বেশি পরিচিত) ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ায় সৌদি আরব এবং অরগানাইজেশন অব পেট্রলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজের (ওপেক) আরব সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে তেল সরবরাহে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।

বিশ্ব রাজনীতির ওলট-পালট আর আমেরিকায় তেল উৎপাদন বাড়ায় রপ্তানিকারক দেশগুলোর এ জোটটির আওয়াজ এখন অনেকটাই কমে এসেছে।  

ওপেকের সাবেক-বর্তমান বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে তেল উৎপাদক ও সরবরাহকারী জোটটির এখনকার মার্কিন তোষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন।

তাদের মতে, ওপেক সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ইরান ও ভেনেজুয়েলা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সুবিধা করে উঠতে পারছে না; অন্যদিকে জোটের মূল খেলোয়াড় সৌদি আরব এখন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারানোর চেয়ে তাদের খুশি করার তালেই বেশি ব্যস্ত।

দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের তেলের দাম কমানোর চাপ উপেক্ষা করে এলেও গত তিন বছরে ওপেক ওয়াশিংটনের কাছে অনেকটা আত্মসমর্পণই করেছে, বলছেন তারা।

মার্কিন ও ব্রিটিশ ৭টি তেল কোম্পানির ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত এই জোট ২০১৭ সালে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হওয়ার পর থেকে ওয়াশিংটনের কাছে নতি স্বীকার করেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে জ্বালানির দাম কমাতে ট্রাম্প তার চলতি মেয়াদে বারবারই ওপেকের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গেছেন।

এরপর তেলের দাম অত্যধিক কমে যাওয়ায় চলতি বছর মার্কিন কোম্পানিগুলো যখন আর লাভ করতে পারছিল না, তখন তাদেরকে খানিকটা টেনে তুলতে তড়িঘড়ি চুক্তিতেও সম্মত হতে হয়েছে ওপেককে।

সামরিক সহযোগিতা কমানোর হুমকি দিয়ে ওয়াশিংটন রিয়াদকে ওই চুক্তিতে রীতিমত বাধ্য করেছে বলে সেসময় বেশ কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল রয়টার্স। 

“তেলের দাম নিয়ে ট্রাম্প যে যে আদেশ দিয়েছে, সৌদি আরব তার সবগুলোই পালন করেছে,” বলেছেন ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ওপেকের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা চাকিব খেলিল। চাকিব এক দশকেরও বেশি সময় আলজেরিয়ার তেলমন্ত্রী ছিলেন।

ওপেক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের প্রসঙ্গে সৌদি আরবের জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউস কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

ওপেকের ভিয়েনা সদরদপ্তরে কর্মরত এক কর্মকর্তাও এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান; রয়টার্সকে এসব বিষয়ে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলারও পরামর্শ দেন তিনি।

ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল ও অন্য বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

ওপেকের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তা, বিশ্লেষক, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা বলছেন, ইরান ও ভেনেজুয়েলার উপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা নিজেদের পছন্দমাফিক তেল উৎপাদন করতে পারছে না। অন্যদিকে সৌদি আরব কয়েক দশক ধরে ওপেকের শীর্ষ তেল উৎপাদক দেশ হওয়ায় জোটে রিয়াদের প্রভাব অনেকখানি বেড়ে গেছে।

২০১০ সালের পর থেকে ইরান উৎপাদন কমাতে কমাতে ওপেকে তাদের শেয়ার এখন সাড়ে ৭ শতাংশ হয়েছে; অন্যদিকে ভেনেজুয়েলার শেয়ারও ১০ শতাংশ থেকে কমে ২ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে বলে ওপেকের দেওয়া তথ্য থেকে হিসাব করে বলছে রয়টার্স।

ওই একই সময়ের মধ্যে সৌদি আরবের শেয়ার ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। 

ইরাক, কুয়েত আর সৌদি আরবের সঙ্গে মিলে ওপেক প্রতিষ্ঠা করা ইরান ও ভেনেজুয়েলা দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তেলের দাম কমানোর বিরোধিতা করে আসছে। যদিও দিন দিন তাদের প্রভাব কমতে থাকায় ওই বিরোধিতা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজেই আসেনি।

রয়টার্স বলছে, ওপেকে সৌদি আরবের প্রভাব এমন এক সময়ে বেড়েছে, যখন তেল ও গ্যাসের উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রও বিদেশি জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে ধীরে ধীরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পেট্রলিয়াম উৎপাদকে পরিণত হয়েছে।

পেট্রলিয়াম রপ্তানিকারক দেশের জোটের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে তেলের বিশ্ব বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বেড়েছে, কমেছে ওপেকের।

এই অবস্থায় ২০১৬ সালে ওপেক রাশিয়া ও আরও ৯টি তেল উৎপাদক দেশের সঙ্গে মিলে ওপেক প্লাস নামে আরেকটি জোট গঠন করলেও বিশ্ব বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাতে পারেনি।

ট্রাম্প তার পূর্বসূরীদের তুলনায় ওপেককে নিয়ে অনেক বেশি সক্রিয়ও। মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট এমনকী টুইটারেই তেলের উৎপাদন ও দামের ওঠানামা ঠিক করে দিচ্ছেন।

২০১৮ সালে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের উপরে উঠে গেলে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

“তেলের দাম অনেক বেশি, ওপেক ফের আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। মোটেও ভালো নয়,” ওই বছরের ১৩ জুন টুইটারে বলেছিলেন তিনি। এর ৯ দিন পর অস্ট্রিয়ায় ওপেক সদস্যদের বৈঠকে তেলের উৎপাদন দিনে আরও ১০ লাখ ব্যারেল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।

মার্কিন কোম্পানিগুলো যখন অত্যধিক তেল উৎপাদন আর তেলের দাম কমে যাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল, তখন এ বছর নতুন প্রস্তাব নিয়ে হাজির হন ট্রাম্প।

তিনি ওপেককে তেলের উৎপাদন কমাতে বলেন। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন এবং তেলের দর নিয়ে রাশিয়া ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্বের কারণে সেসময় তেলের দাম উল্টোপাল্টা আচরণ করছিল।

“মাত্রই সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে কথা হল, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন; আমার আশা তারা আনুমানিক এক কোটি ব্যারেল উৎপাদন কমাবে, এই সংখ্যা পরে আরও বাড়তে পারে। এমনটা হলে, তেল ও গ্যাস শিল্পের জন্য ভালো হবে,” ২ এপ্রিল টুইটারে বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

১০ দিন পরই ওপেক প্লাস বিশ্বের মোট তেল উৎপাদনের দশভাগের একভাগ সমপরিমাণ উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দেয়।

সৌদি আরবের বেশ কয়েকটি সূত্র জানায়, ট্রাম্প সেসময় সৌদি ক্রাউন প্রিন্সকে আল্টিমেটাম দিয়ে বলেছিলেন, হয় তেল উৎপাদন  কমাও, নয়তো মার্কিন বাহিনী সৌদি আরব থেকে চলে আসবে।

ট্রাম্প যদিও পরে এই ধরনের কোনো আল্টিমেটাম দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছিলেন। সৌদি আরব সরকারের মিডিয়া কার্যালয়ও এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হয়নি।

“সব মিলিয়ে ওপেক এখন আর তার সদস্যদের ভালোর কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না, যা তার নেওয়ার কথা,” বলেছেন আলজেরিয়ার সাবেক মন্ত্রী খেলিল।

এমন অবস্থায় ছোট ছোট কয়েকটি দেশ ওপেক থেকে নিজেদের সদস্যপদ প্রত্যাহারও করে নিয়েছে।

সৌদি আরবের সঙ্গে রাজনৈতিক ঝামেলার কারণে ২০১৯ সালে কাতার জোটটি থেকে বেরিয়ে গেছে। চলতি বছর একুয়েডরও নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে; এর আগে ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়াও প্রভাবশালী এ জোট থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।

রয়টার্স বলছে, জোটে থাকা অনেক দেশ ওপেকের কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হলেও এখনি বের হয়ে যাওয়াকে ‘বুদ্ধিমানের কাজ’ বলে মনে করছে না।

“ওপেক কিংবা ওপেক প্লাসের সদস্য হওয়া এখনও গুরুত্বপূর্ণ; কেননা এর মাধ্যমে আপনি আপনার স্বার্থের সর্বাধিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেন,” বলেছেন ইরানের তেলনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।