স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে শুক্রবার তিনি জাপানের প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী আসার আগ পর্যন্ত তিনি দপ্তরে থাকবেন। আগামী মঙ্গলবার পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়া হবে। যিনি আবের মেয়াদ, অর্থাৎ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন।
শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় এক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আবে বলেন, ‘‘আমরা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশে মৃত্যুহার ০.১ শতাংশ, তাদেরও অর্ধেকের বয়স ৮০ উপর। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সরকার সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে।”
“এরপরও আমি মনে করি, কোভিড মোকাবেলায় আরো বেশি শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, যা আমার পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার ২০ বছরের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। অনেক কিছু করার থাকলেও না করতে পারার এই দুঃখ নিয়েই আমাকে পদত্যাগ করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ আমার পদত্যাগের পথ সহজ করেছে। আমি দুঃখিত উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে সফল হতে পারিনি। আমি মনে করি, এই পরিস্থিতে আমাদের নতুন শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন।”
দুই হাজার ৭৯৮ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শিনজো আবে বলেন, ‘‘১৩ বছর আগে আলসারাটিভ কোলাইটিস ধরা পড়েছিল। ওই সময় নতুন উদ্ভাবিত এক ঔষধ সেবন করে আমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। এরপর গত আট বছর ধরে আমি অসুস্থতা ভালভাবে মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাম।”
“কিন্তু গত জুনে আমার আমার শারীরিক অবস্থা বেশ অবনতি হয়। আমি মনোবল হারিয়ে ফেলি। যদিও নতুন ঔষধ আমি সেবন করছি। এ সপ্তাহের শুরুতে আমি ফের চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছিলাম। এই নতুন ঔষধের কার্যকারিতা চিকিৎসকরা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।”
৬৫ বছর বয়সী জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মত এত বড় দায়িত্ব পালন করা যায় না বলে মনে করেন তিনি।
আবে বলেন, ‘‘বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের আত্মবিশ্বাসও আমি হারিয়ে ফেলছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী থাকা সমিচীন হবে না। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি।
“সামনে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যদিও আমার আরও এক বছর প্রধানমন্ত্রীত্ব ছিল। তবে করোনাভাইরাসের মত কঠিন সমস্যা সমাধান করতে নতুন করে আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।”
জঙ্গিবাদ ও বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ২০১৫ সালে সংবিধান সংশোধন করে নিরাপত্তা বিল পাশ করে শিনজো আবের প্রশাসন। এই প্রসঙ্গে আবে বলেন, ‘‘আমি মনে করি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এ বিল অতি জরুরি ছিল। আমার বিশ্বাস জাপানিরা এই বিলের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। আশা করি, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এই বিলটির কার্যকরভাবে অনুসরণ করে যাবে।”
আগামী মাসে আবের দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির নতুন নেতা (সভাপতি) নির্বাচন করার কথা। নতুন নেতা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দলের হাল ধরে থাকবেন বলেও জানিয়েছেন আবে।
তিনি বলেন, ‘‘ আমি ওষুধ খাচ্ছি। আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ছাড়ছি। এই পরিস্থিতে এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য করা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। তবে রাজনীতি থেকে আমি সম্পূর্ণ সরে যাচ্ছি না। একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে এলডিপি-তে থাকব।”
টোকিও অলিম্পিক গেইমসের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আগামী বছর যথা সময়ে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করছি। আগামী নেতৃত্ব এই বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে দেশের জনগণ যেভাবে আমাকে সমর্থন করেছে তাতে আমি তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।”
রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠা আবের দাদা নবুসুকে কিশি ছিলেন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তার প্রোপিতামহ ইসাকু সাতো ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো এলডিপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কোবে স্টিল কোম্পানির এক সময়ের কর্মকর্তা আবে ২০০৬ সালে দলীয় সভাপতির দায়িত্ব পান এবং সে বছর কয়েক মাসের জন্য জাপানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ওই সময় ৫২ বছরের আবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে তরুণ প্রধানমন্ত্রী হন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। কিন্তু এক বছর পর স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন।
২০১২ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আবের দল জয়ী হয়ার পর আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ‘আবেনোমিক্স’ বা ‘আবেতত্ত্ব’ দেশটির অর্থনীতিকে আরো বেশি চাঙ্গা করবে বলে ফের দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসেন।
তারপর উত্তর কোরিয়ার ক্রমাগত আগ্রাসী ভাব, দেশের অর্থনৈতিতে ধস, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট নিয়ে জনগণের অসন্তোষে আবের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী হয়ে পড়লে ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী আবে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং আবারও বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফেরেন।
প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের শাসনামলে ২০১৬ সালের ২৬ মে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হিরোশিমায় সফরে যান। তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিরোশিমায় যাওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট।
গত বছর আবে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জাপান সম্রাট আকিহিতো সিংহাসন ছাড়েন। যার জন্য দেশের সংবিধানের বড় সংশোধনী প্রয়োজন হয়। চলতি বছর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সংবিধানে সংশোধনী এনে দেশটিতে প্রথমবারের মত জরুরি অবস্থাও জারি করেন শিনজো আবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অংশীদার জাপান। শিনজো আবের আমলে দুই দেশের মধ্যে বড় বড় বেশ কয়েকটি প্রকল্প চুক্তি হয়েছে।