প্রায় দেড় বছর আগের ওই হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার নিউ জিল্যান্ডের আদালত বলেছে, ব্রেন্টন ট্যারেন্ট যা করেছেন, তা ‘মানুষের কাজ নয়’।
২৯ বছর বয়সী এই অস্ট্রেলিয়ান নাগরিককে প্যারোলে মুক্তির সুযোগ না রেখে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক, যা নিউ জিল্যান্ডের আইনে সর্বোচ্চ সাজা।
দেশটির ইতিহাসে এই প্রথম কাউকে এ শাস্তি দেওয়া হল বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে রয়টার্স।
এ মামলায় দুটি মসজিদে গুলি চালিয়ে ৫১ জনকে হত্যা, ৪০ জনকে হত্যাচেষ্টা এবং সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়েছিল ব্রেন্টন ট্যারেন্টের বিরুদ্ধে। আদালতে সব দায় তিনি স্বীকার করে নেন।
ক্রাইস্টচার্চের আল নূর ও লিনউড মসজিদের পর তৃতীয় আরেকটি মসজিদে হামলা চালানোর পরিকল্পনাও তার ছিল। মসজিদগুলো পুড়িয়ে দিয়ে ‘যত বেশি সম্ভব’মানুষকে তিনি হত্যা করতে চেয়েছিলেন বলে উঠে আসে এ মামলার বিচারে।
নিহতদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন বাংলাদেশি। হামলায় আহত আরও তিন বাংলাদেশিকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে দীর্ঘদিন।
নিউ জিল্যান্ড সফররত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কয়েকজন খেলোয়াড়ও সেদিন আল নূর মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। সফরের বাকি ম্যাচ বাতিল করে ফিরে আসেন তারা।
ক্রাইস্টচার্চের উচ্চ আদালতের বিচারক ক্যামেরন মান্ডার বলেছেন, আসামি ব্রেন্টন ট্যারেন্ট যে অপরাধ করেছেন, তার শাস্তি হিসেবে নির্দিষ্ট মেয়াদের সাজা যথেষ্ট নয়।
“আপনার অপরাধ এতই জঘন্য যে মৃত্যু পর্যন্ত আপনাকে জেলে আটকে রাখা হলেও শাস্তি শেষ হবে না,” রায় ঘোষণা করে বলেন বিচারক।
কয়েদির ধুসর রংয়ের পোশাক পরা, রক্ষীদের ঘেরাওয়ের মধ্যে থাকা ট্যারেন্ট রায় ঘোষণার পর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।
বিচারক বলেন, “এ পর্যন্ত আমি যতটুকু দেখেছি, কৃতকর্মের জন্য আপনার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই।”
নিউ জিল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথমবার প্যারোলের সুযোগবিহীন আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করে তিনি বলেন, “এই মামলায় যদি এই সাজা না দেওয়া হয়, তাহলে কখন দেওয়া হবে?”
আল নূর মসজিদে হামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ তিনি সরাসরি সম্প্রচার করেন ফেইসবুকে। ১৭ মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে মসজিদের ভেতরে নারী, পুরুষ, শিশুদের ওপর খুব কাছ থেকে নির্বিচারে গুলি চালানো হচ্ছে। সেই ভিডিও পরে সরিয়ে ফেলে ফেইসবুক।
হামলার আগে ট্যারেন্ট তার টুইটার অ্যাকাউন্টে ৭৩ পৃষ্ঠার একটি কথিত ‘ম্যানিফেস্টো’ প্রকাশ করেন। হামলার উদ্দেশ্য ও নিজের পরিকল্পনার বিষয়ে সেখানে তিনি বিস্তারিত বিবরণ দেন।
শুনানি চলাকালে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে জানান, অভিবাসীদের ‘দখলকারী’ হিসেবে বর্ণনা করে ট্যারেন্ট তাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সতর্কভাবে সাজিয়েছিলেন হামলার পরিকল্পনা, যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা যায়।
শুনানির শুরুতে কোনো আইনজীবী নিয়োগ না করে আদালতে ট্যারেন্ট নিজেই নিজের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তবে সে সময় কিছু বলেননি।
বৃহস্পতিবার একজন আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতকে তিনি জানান, কোনো প্যারোল ছাড়াই আমৃত্যু কারাদণ্ডের যে আর্জি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা করেছেন, তার বিরোধিতা তিনি করবেন না।
রায় ঘোষণার আগে বিচারক ট্যারেন্টকে জিজ্ঞেস করেন তার কিছু বলার আছে কি না। তার যে কিছু বলার অধিকার আছে, সে বিষয়ে তিনি জানেন কিনা। আদালতের এ প্রশ্নে ট্যারেন্ট শুধু মাথা ঝাঁকান, কিন্তু কিছু বলেননি।
বিচারক মান্ডার তার রায়ে বলেন, “আপনার বিদ্বেষের কেন্দ্রে সমাজের বিশেষ সদস্যদের প্রতি যে ঘৃণা বিরাজমান, তা সঙ্গে নিয়ে তাদের হত্যা করতে আপনি এই দেশে এসেছিলেন। কিন্তু এখানে সেই ঘৃণার কোনো স্থান নেই- কোথাও এর স্থান নেই।”
ট্যারেন্টের আগে নিউ জিল্যান্ডে উইলিয়াম বেল নামে তিন খুনের এক আসামিকে প্যারোল ছাড়া ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেটাই ছিল এতদিন সে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম মেয়াদের কারাদণ্ড।
আরও পড়ুন