ভারতে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে হয়রানির শিকার হতে হয়: অমর্ত্য সেন

নরেন্দ্র মোদী সরকারের নীতি ভারতকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে বলে মনে করেন দেশটির নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।

>>ডয়চে ভেলেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2020, 06:52 PM
Updated : 18 August 2020, 06:52 PM

অনলাইনে জার্মানির সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে-র এশিয়া বিভাগের প্রধান দেবারতি গুহকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মোদী সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, মোদী সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন হচ্ছে। এছাড়া, এখন সরকারের সমালোচনা করলে হয়রানি ও জেলে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। মৌলিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে প্রতিবেশী দেশের তুলনায় দিন দিন পিছিয়ে পড়েছে ভারত।

ভারতে এখন গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘‘না, একদমই না। স্বাধীনতার পর শুরুতে আমাদের এখানে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি দিন দিন অনেক বেশি খারাপ হচ্ছে।

‘‘এখন যদি আপনি সরকারে বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা বলেন তবে আপনাকে হায়রানির শিকার হতে হবে, হয়তো বা জেলে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।”

গত কয়েক বছরে ভারত ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ সমীহ করার মত। কিন্তু দারিদ্র দূরীকরণে এই প্রবৃদ্ধি খুব একটা ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

অমর্ত্য সেন, ‘‘বৃহৎ অর্থে বলতে গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ ও ভারতে আগে জীবনযাত্রার মান যেমন ছিল এখন সেটা বদলেছে। সেটা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। এটা ঠিক, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে সমাজে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু দারিদ্র দূরীকরণে সেই সম্পদের ব্যবহার সঠিকভাবে হয়নি।”

মৌলিক শিক্ষা ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা খাতে ভারত এখন বাংলাদেশের ‍চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবীদ। বলেন, ‘‘এক সময় নানা খাতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। এখন তারা ভারতের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে ভালো করছে। আ‍মার মনে হয় ভারত সরকারের এই বিষয়গুলোতে আরো বেশি মনযোগ দেওয়া প্রয়োজন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পদের পরিমাণ বাড়ায়। আমাদেরকে অবশ্যই সেই সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা, সবার জন্য মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার মত কাজ যেটা কেবল একটি দেশের সরকারই নিশ্চিত করতে পারে।

‘‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই ভালো। কারণ এর ফলে সম্পদের পরিমাণ বাড়ে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই সেই সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে।”

 

অনেকেই মনে করেন দেশে গণতন্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকলে ধীরে ধীরে দারিদ্র দূর হয়ে যায়। এটা কী সব সময় সত্যি?

‘‘এটা নির্ভর করে গণতন্ত্রের প্রয়োগের উপর। যদি স্কুলে শিক্ষার মান যথেষ্ট ভালো না হয়, স্কুলের মানই খারাপ হয়, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অস্তিত্বই না থাকে, বেশিরভাগ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা শুধু ধনীদের জন্য হয় তখন একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক অভিযোগ করতেই পারেন, তার অভিযোগ যৌক্তিক।

‘‘যদি রাষ্ট্র সেই অভিযোগ করার সুযোগ দেয়, যদি অভিযোগ শোনা হয় এবং রাষ্ট্র সেই অনুযায়ী নিজের নীতির পরিবর্তন ও সংস্কার করে তবে গণতন্ত্র ‍অবশ্যই ঘাটতি পূরণে বড় অবদান রাখতে সক্ষম। কিন্তু সেটা ঘটছে না। এখন আমরা খুবই দুর্ভাগা রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছি। ভারতে বুদ্ধিজীবিদের একটি বড় ‍অংশ রাষ্ট্রের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের সেটা করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের বিরোধিতা করলে বিভিন্ন ‍অজুহাতে জেলে ঢোকানো হচ্ছে।”

অমর্ত্য সেন তার লেখা বই ‘দ্য আইডিয়া অব জাস্টিস’ এ নীতি ও ন্যায় ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসন ব্যবস্থায় এই নীতি ও ন্যায়ের কতটা প্রয়োগ হচ্ছে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর?

এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যবশত একদমই হচ্ছে না। আপনি যদি ভারতের সংখ্যালঘুদের দিকে তাকান তবে দেখবেন গত কয়েক বছরে তারা খুবই কঠিন সময় পার করছেন। দেশ এখন সংখ্যাগরিষ্ঠদের সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তাতে তো কোনো পার্থক্য হওয়ার কথা না। দেশে অন্য ধর্মের মানুষদের তুলনায় হিন্দু বেশি। এটা যদি সংখ্যালঘুদের দমনে ব্যবহার করা হয়, তাদের মত প্রকাশ করতে না দেওয়া হয়, সব জায়গায় তাদের বঞ্চিত করা হয়, সেটা ঠিক হবে না।

‘‘কিন্তু সেটাই হচ্ছে, যেমনটা সম্প্রতি বাবরি মসজিদের ক্ষেত্রে হয়েছে বা কাশ্মিরসহ আরো অন্যান্য বিষয়ে হয়েছে। কাশ্মির আগে একটি রাজ্য ছিল। হঠাৎ করেই সেটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে।”

ভারতের প্রতিটি ‍নাগরিকের সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “হিন্দুরা যেমন ভারতের নাগরিক। ঠিক একইভাবে মুসলমানরাও ভারতের নাগরিক। মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অন্যান্যরা বার বার এ বিষয়টিতে জোর দিয়েছেন। কিন্তু এখন যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে সেটা খুবই দুঃখজনক নীতি। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে খারাপ নীতি।”

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাংলাদেশের পোশাক খাত সংকটে পড়েছে। এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে শ্রমিকদের রক্ষায় সরকারের কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল?

“এক্ষেত্রে ইউরোপ বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সবার জন্য সমাধানের পথ একটাই। প্রচুর পরীক্ষা, ব্যাপক ভাবে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা এবং ‍সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। বাংলাদেশের পোশাক খাতেও এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ছিল। তারা হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠার মত ব্যবস্থার দিকে গেছে। বাস্তবে যেটা কাজে আসেনি।

“আমার মনে হয় বাংলাদেশ ও ভারতের অন্য কিছু করা উচিত ছিল। তাদের ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড বা দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশের দিকে তাকানো উচিত ছিল। মহামারী তাদের অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পরেনি।”