বৈরুতে বিস্ফোরণ: থমকে যাওয়া লেবাননের ভবিষ্যত কী?

ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর গণদাবির মুখে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ক্ষমতা ছেড়েছে লেবানন সরকার। কিন্তু শুধু সরকার পরিবর্তন করে কী মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে সৃষ্টি হওয়া অচলাবস্থার ‍অবসান সম্ভব?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2020, 05:20 PM
Updated : 12 August 2020, 08:53 PM

ঠিক ১০ মাস আগে সরকারের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করেছিলেন লেবাননের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। তারপর এবছর জানুয়ারিতে ইরানঘনিষ্ঠ শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও তাদের মিত্রদের সমর্থন হাসান দিয়াবের নেতৃত্বে লেবাননের নতুন সরকার গঠিত হয়। একই অভিযোগে জনরোষের চাপে দুইদিন আগে পদত্যাগ ঘোষণা করায় ‍তিনি নিজেও এখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।

মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে দিয়াব সোমবার পদত্যাগ করার সময়ই জানিয়েছিলেন, নতুন মন্ত্রিসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত তার সরকার তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় থাকবে। দিয়াব সরকারের পদত্যাগ ঘোষণার পর দুইদিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু নতুন সরকারের বিষয়ে প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের কোনও বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি। এই দুই দিনে তিনি শুধু দিয়াব সরকারের মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন।

অথচ বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে যাওয়া বৈরুতের উদ্ধার কাজ এবং পুনঃনির্মাণে যোগ্য নেতৃত্ব এখন সবচেয়ে জরুরি। গত ৪ অগাস্টের বিস্ফোরণের ধাক্কায় পুরো বন্দর এলাকাসহ রাজধানীর অর্ধেকই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ১৭১ থেকে ২০০ জন মানুষ মারা গেছেন। অনেকে এখনও নিখোঁজ। আহত প্রায় ছয় হাজার এবং গৃহহীন হয়ে পড়েছেন তিন লাখের বেশি মানুষ।

এ অবস্থায় লেবাননের জন্য কোন ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে?

কীভাবে এবং কবে আসবে নতুন সরকার

নতুন মন্ত্রিসভা গঠন না হওয়া পর্যন্ত দিয়াব সরকারই তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় থাকছে। অনেকের আশঙ্কা, নতুন সরকার গঠন দীর্ঘায়িত হবে এবং সেই সময়টিতে দেশ অচল হয়ে থাকবে।

দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে অভিজাতদের দুর্নীতি ও ঋণের বোঝার চাপে লেবাননের অর্থনীতি আগে থেকেই ভঙ্গুর। দেশটিতে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির কারণে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মান তলানিতে ঠেকেছে, নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন এবং ব্যাংক ব্যবস্থাও প্রায় অচল।

সরকারের উঁচু আসনে থাকা গুটি কয়েক মুখের দুর্নীতির কারণেই দেশের এ অবস্থা বলে মনে করে লেবাননের সাধারণ জনগণ। তারা দেশের শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চায়।

হাসান দিয়াবও পদত্যাগের ভাষণে বলেছেন, ‘দেশের সর্বত্র দুর্নীতি শেকড় গেড়েছে, যার ফল এই বিস্ফোরণ’। নতুন সরকার দুর্নীতির এই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে পারবে কিনা সেটি বড় প্রশ্ন।

এ মুহূর্তে লেবাননের পুরোনো মন্ত্রিসভা বৈঠক চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু তাদের হাতে কোনও আইন প্রস্তাব করা বা কোনও ডিক্রি জারির ক্ষমতা নেই। তাছাড়া, নতুন সরকার গঠন হতে যে নির্বাচন হতে হবে তেমনটিও নয়।

কারণ লেবাননের বর্তমান আইন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন পার্লামেন্টের পরামর্শ নিয়ে নতুন মন্ত্রিসভার নিয়োগ দিতে পারবেন। এজন্য নতুন করে নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তিনি এখনও নিশ্চুপ। তাছাড়া, পার্লামেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রিসভা গঠনের যে পদ্ধতি তাতেও অনেক সময় লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

যুক্তরাজ্যের চাথাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিনা খতিব বলছেন, গণবিক্ষোভের চাপে হয়ত নতুন সরকার গঠনের কাজ দ্রুত হতে পরে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আসবে।

তিনি বলেন, “নতুন সরকার পুরানো সরকারের মতই হবে কিনা সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। ভাবী সরকারে ক্ষমতাসীন শ্রেনির বাইরে থেকে মন্ত্রিসভায় আসন থাকার সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু তাদের হাতে সত্যিকারের পরিবর্তন নিয়ে আসার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা থাকার সুযোগ কম।”

আর  বর্তমান ক্ষমতাসীনরাও পুরো ক্ষমতা ছাড়তে ইচ্ছুক নন বলেই মনে করেন লিনা।

উদ্ধার ‍অভিযান, পুনর্গঠন ও বৈদেশিক সহায়তা

বিস্ফোরণে আর্থিক অংকে বৈরুতের ক্ষয়ক্ষতি এক হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলার। নগরীর পুনর্গঠনেও কয়েক বছর লেগে যাবে। এসবের জন্য দেশটির এখন প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক সহায়তা প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী সহায়তার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। বিস্ফোরণের একদিন পর গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বৈরুত সফর করেছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বুধবার জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বৈরুতে গেছেন।

লেবাননের সহায়তায় তহবিল জোগাড়ের জন্য ম্যাক্রোঁ আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে গত রোববার অনলাইনে সম্মেলন করেন। সেখানে তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তার জন্য প্রায় ২৫ দশমিক ৩ কোটি ইউরো তহবিলের প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে।

কিন্তু সম্ভাব্য দাতারা লেবাননের ‘দুর্নীতিবাজ’ নেতাদের হাতে সহায়তার অর্থ তুলে দিতে চাইছেন না। তাদের আশঙ্কা, ওই অর্থ শেষ পর্যন্ত জনগণের হাতে পৌঁছাবে না। যদিও ম্যাক্রোঁ নিজ দায়িত্বে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ নেতাদের হাতে ওই অর্থ পড়বে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বৈরুতের ক্ষতিগ্রস্ত ‍সাধারণ মানুষ সাহায্যের আশায় মরিয়া হয়ে অপেক্ষা করছে। এক দোকানদার জানান, বিস্ফোরণে তার দোকান দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আহত হয়েছেন পাঁচ কর্মী।

হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘আমরা লেবাননের বাসিন্দারা জানি, আমাদের সরকার কিছুই করবে না।”

বৈরুতের আরেক বাসিন্দার ফটো স্টুডিও পুরো গুঁড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘‘সব শেষ। আমি শুধু চাই কেউ আমার দোকান পুনঃনির্মাণ করে দিক। ব্যাংক আমাকে আর ঋণ দেবে কিনা জানি না। আগেই আমার গাড়ির জন্য ঋণ নেওয়া আছে।”

এদিকে, লেবাননের ব্যাংক ব্যবস্থাও প্রায় অচল। ডলারের সঙ্কটের কারণে গত বছর ‍অক্টোবর থেকেই মানুষ ‘সেভিংস একাউন্ট’ থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ তুলতে পারছেন না। যদিও বিস্ফোরণের পর জনগণের আর্থিক পুনর্বাসনের জন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিনাসুদে ঋণের আওতা বাড়াতে বলেছে।

কিন্তু লেবাননে অর্থনৈতিক সঙ্কট চলে আসছে বিস্ফোরণের আগে থেকেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই অনাহারের মুখে আছে। এখন দেশটিকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধারের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং বৈরুত পুনর্গঠনের দায়িত্ব কে নেবে তা অনিশ্চিত। 

সরকারের পদত্যাগেও শান্ত হয়নি বিক্ষোভকারীরা

সোমবার সন্ধ্যায় দিয়াব সরকারের পতন ঘোষণা হওয়ার সময়ও বিক্ষোভ চলেছে। কারণ শীর্ষ ও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ছাড়ার জনগণের দাবি পূরণ হয়নি।

অনেকেই মনে করেন সরকারের পদত্যাগ দেশকে আবার সেই সাদ হারিরির পদত্যাগের সময়কার অচলাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। অক্টোবরে হারিরর পতনের পর ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় লেগে গিয়েছিল নতুন প্রধানমন্ত্রী দিয়াব আসতে।

কিন্তু তখন থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরাও বহাল তবিয়তেই থেকে যান।

১৯৯০ সালে লেবাননে দীর্ঘ ১৫ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান হয়। তারপর থেকে ঘুরেফিরে দেশটির ক্ষমতায় গুটি কয়েক মুখই দেখা যাচ্ছে।

জনগণের আস্থা ফেরাতে গেলে লেবাননের সরকারকে ওই সব মানুষদেরকে বেছে নিতে হবে যারা একইসঙ্গে লেবাননের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থাকে উজ্জীবীত করতে পারবেন।

কী হতে চলেছে আগামীতে?

লেবাননের পার্লামেন্ট সদস্যরা বৃহস্পতিবার বৈঠেকে বসতে চলেছেন। যদিও এই বৈঠক থেকে রাতারাতি নতুন সরকারের ব্যাপারে কোনও অগ্রগতির আশা নেই, বরং তা হতে পারে আরও দূরের পথ।

লেবাননে অনেকেই এখন ভবিষ্যতের জন্য একটি কার্যকর সরকারের আশায় থাকলেও এ মুহূর্তে সাহায্যটাই তাদের জরুরি প্রয়োজন।

কিন্তু বিপর্যয়ে দ্রুত মানুষের সহায়তায় সাড়া দেওয়াটাই কেবল নয় বরং লেবাননে দীর্ঘমেয়াদে শাসনব্যবস্থার ভবিষ্যতই এখন ঝুঁকিতে।

বিস্ফোরণের পর পদত্যাগ করা পার্লামেন্টের স্বতন্ত্র সদস্য পলা ইয়াকুবিয়ান বলেন, সরকার যখন শাসনব্যবস্থার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল তখনও তারা নাগরিকদের দেখভাল করেনি। এতে বেশিরভাগ দায়দায়িত্বই বর্তেছে নাগরিক-সমাজের বিভিন্ন দল এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের ওপর।

বৈরুতের বিপর্যয়কর বিস্ফোরণের পর তারাই গৃহহীন এবং আহত মানুষদের আসল ‘তত্বাবধায়ক’, বলেন পলা।

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আসলেই যা প্রয়োজন সেটি খুবই সাধারণ: একটি সৎ, স্বাধীন এবং দক্ষ সরকার। বিপর্যয়ের পর আমরা দেখতে পেয়েছি কারা আসলে এই দেশের সেবা করতে পারে এবং নেতৃত্ব দিতে পারে। তাদের মধ্য থেকেই আমাদের নেতা বাছাই করে নেওয়া উচিত।”