বৈরুত: অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছিল

বৈরুত বন্দরের গুদামে থাকা ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে গত মাসেই নিরাপত্তা কর্মকর্তারা লেবাননের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করেছিলেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 August 2020, 08:25 AM
Updated : 11 August 2020, 09:23 AM

মজুদ এ বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ কোনো কারণে বিস্ফোরিত হলে পুরো রাজধানী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলেও হুঁশিয়ার করেছিলেন তারা।

দুই সপ্তাহ পর তাদের আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণিত করে প্রবল বিস্ফোরণ বৈরুত বন্দরের বেশিরভাগ অংশকেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অন্তত ২২০ জনের, আহত ছাড়িয়েছে ৬ হাজার। শহরটির প্রায় ৬ হাজার ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে মিউনিসিপাল কর্তৃপক্ষ।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বন্দরে পড়ে থাকা বিস্ফোরক পদার্থ নিয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা যে জুলাইয়েই লেবাননের নেতাদের সতর্ক করেছিলেন, সে সংক্রান্ত বেশকিছু নথি দেখেছে তারা।

দেশটির ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও দুই সপ্তাহ আগেই মজুদ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

লেবাননের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তর গত ২০ জুলাই প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন ও প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবকে বন্দরে মজুদ রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনের মধ্যে একটি চিঠিও ছিল।

প্রতিবেদনটি দেখলেও বিশেষ ওই চিঠিতে কী লেখা ছিল রয়টার্স তা জানতে পারেনি। তবে লেবাননের একজন উর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে জানুয়ারিতে শুরু হওয়া একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের সংক্ষিপ্তসার ছিল, যাতে বন্দরে পড়ে থাকা বিপজ্জনক রাসায়নিকগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল।

“চুরি হলে, এই রাসায়নিক সন্ত্রাসী হামলা চালানোর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন বিপদ ছিল। তদন্ত শেষে প্রসিকিউটর জেনারেল ঘাসান ওয়েইদাত একটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছিলেন, যা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়,” বৈরুত বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তর থেকে প্রেসিডেন্ট আউন ও প্রধানমন্ত্রী দিয়াবকে পাঠানো চিঠির কথা উল্লেখ করে বলেন ওই কর্মকর্তা।    

পরিচয় প্রকাশে অস্বীকৃতি জানানো এ কর্মকর্তা আউন ও দিয়াবকে আগাম সতর্ক করে পাঠানো চিঠিটি লেখার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেছেন।

“এগুলো (অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট) বিস্ফোরিত হয়ে বৈরুতকে ধ্বংস করে দিতে পারে বলে আমি তাদের সতর্ক করেছিলাম,” রয়টার্সকে বলেছেন তিনি।

তবে লেবাননের এ ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তার বক্তব্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেনি রয়টার্স। ২০ জুলাইয়ের চিঠি নিয়ে প্রেসিডেন্ট আউন ও প্রধানমন্ত্রী দিয়াবের দপ্তরের মন্তব্য চাওয়া হলেও তাতেও সাড়া মেলেনি। এ প্রসঙ্গে লেবাননের প্রসিকিউটর জেনারেলেরও মন্তব্য পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে এভাবে সতর্ক করার বিষয়টি সত্য হলে তা লেবাননের বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও অগ্নিগর্ভ করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা পর্যবেক্ষকদের।

বিশ্লেষকদের ধারণা, সরকারের অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে এমনিতেই বেহাল লেবাননের অর্থনীতি বিস্ফোরণের পর আরও সংকটে পড়বে।

কেবল বৈরুত পুনর্গঠনেই প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলারের তহবিল প্রয়োজন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

জনঅসন্তোষের মুখে সোমবার দিয়াব সরকার পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা সহসাই মিটছে না বলেও ধারণা বিশ্লেষকদের।

পদত্যাগ করলেও নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দিয়াব মন্ত্রিসভার সদস্যরাই ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

বৈরুত বন্দরে ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট পড়ে থাকার বিষয়টি অবগত ছিলেন বলে গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট আউনও স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে’ সুপ্রিম প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের মহাপরিচালককে নির্দেশনা দিয়েছিলেন বলেও সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন তিনি।

“(মজুদ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট) এটা যে বিপজ্জনক, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থা তা বলেছিল। আমি দায়ী নই। এগুলো কোথায় রাখা হয়েছে এবং কতখানি বিপজ্জনক তা জানতাম না আমি। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের এখতিয়ারও আমার নেই। এর একটা কাঠামো আছে। যারা বিষয়টি জানতেন, তাদের উচিত ছিল কী করা দরকার সে বিষয়ক দায়িত্ব সস্পর্কে জানা,” বলেছিলেন তিনি।

কেবল প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীকে জুলাইতে পাঠানো চিঠিই নয়, গত ছয় বছর ধরে বন্দর কর্তৃপক্ষ, শুল্ক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও দেশটির আদালতের কাছে একের পর এক আবেদনে করে গুদামে পড়ে থাকা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটগুলো অপসারণের আদেশ চেয়েছিল।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনেও এসব আবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

বন্দরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ২০১৬ সাল পর্যন্ত শুল্ক অধিদপ্তরকে লেখা একাধিক নথিতে একজন বিচারকের আদেশ এনে রাসায়নিকগুলো সরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছে বলে ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

“কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের একজন রাসায়নিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই রাসায়নিকগুলো যে বিপজ্জনক এবং ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম ওই বিশেষজ্ঞ তা আমাদের নিশ্চিত করেছেন,” এমনটাই বলা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তরের জুলাইয়ের প্রতিবেদনটিতে।