করোনাভাইরাস ঠিক কতটা প্রাণঘাতী?

চীনের উহানে আবির্ভাবের সাত মাসের মধ্যেই নতুন করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে সোয়া ৫ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে; শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পেরিয়ে গেছে এক কোটি ১০ লাখ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2020, 12:49 PM
Updated : 5 July 2020, 12:49 PM

আক্রান্ত-মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনই লম্বা হচ্ছে। অথচ সাত মাসেও বিজ্ঞানীরা নতুন এ ভাইরাস ঠিক কতটা প্রাণঘাতী, তার কোনো কূলকিনারাই করতে পারেননি।

নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত প্রতি ১০০ জনে সর্বোচ্চ কতজনের মৃত্যু হতে পারে, মহামারীর অন্যতম বড় এ জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব মিলছে না।

সংক্রমণ অনুপাতে মৃত্যুর একটি সুনির্দিষ্ট মূল্যায়ন থাকলে- ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণছাড়া হলে, কত প্রাণহানি হতে পারে বিশ্বের দেশগুলো সে সম্বন্ধে একটি ধারণা পেত।

ব্রাজিল, নাইজেরিয়া ও ভারতের মতো জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি এমন দেশগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়ালে কী হতে পারে সে সম্বন্ধে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারাও খানিকটা প্রস্তুত থাকতে পারতেন।

হাম ও ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াইরত দরিদ্র দেশগুলোর বাজেট বরাদ্দের অগ্রাধিকার ঠিক করতে সুবিধা হত। হামের টিকা, মশারি নাকি ভেন্টিলেটর- কোনটার পেছনে বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়া দরকার কর্মকর্তারা তা ঠিক করতে পারতেন।

গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) প্রকাশিত এক তথ্য করোনাভাইরাস আদতে কতটা প্রাণঘাতী এ জিজ্ঞাসাকে আরও জটিল করে তুলেছে।

সিডিসির তথ্যে ইঙ্গিত দেয়া হয়, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি হিসাবে যুক্ত হওয়া প্রতি একজন কোভিড-১৯ রোগীর বিপরীতে নথিভুক্ত হননি এমন উপসর্গবিহীন কিংবা মৃদু উপসর্গধারী আরও ১০ রোগী বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিশ্বের এক হাজার ৩০০ বিজ্ঞানীর সঙ্গে অনলাইনে দুইদিনের বৈঠক সেরে বৃহস্পতিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী ড. সৌম্য স্বামীনাথন জানান, এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রতি ১০০ জনে মৃত্যুর হার ০.৬ বলেই একমত হয়েছেন তারা। এর অর্থ হচ্ছে- করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার ১ শতাংশেরও কম।

এটা শুনতে ভালো শোনা গেলেও সৌম্য যে হিসাবের দিকে দৃষ্টি দেননি, তা হলো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ০.৬ শতাংশ হচ্ছে ৪ কোটি ৭০ লাখ। এত পরিমাণ মৃত্যু হতে হলে অবশ্য সবাইকে নতুন এ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে হবে।

এখন পর্যন্ত ভাইরাসে আক্রান্ত জ্ঞাত রোগীর তুলনায় মৃত্যুর হার একেক দেশে একেক রকম দেখা যাচ্ছে। যেসব দেশে ভাইরাসটি তুলনামূলক বেশিদিন অবস্থান করছে, সেসব দেশে সংক্রমণ অনুপাতে মৃত্যুর হারও বেশিই হচ্ছে।

শুক্রবার পর্যন্ত চীনে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ৯০ হাজার ২৯৪ এবং মৃত্যু ৪ হাজার ৫৩৪ বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যে দেখা যাচ্ছে; যার অর্থ হচ্ছে- দেশটিতে রোগী অনুপাতে মৃত্যুর হার ৫ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের হারও এর কাছাকাছি, ৪.৬%। ২৮ লাখ ১১ হাজার ৪৪৭ শনাক্ত রোগীর বিপরীতে মৃত্যু এক লাখ ২৯ হাজার ৪০৩ জনের।

এই হার ১৯১৮ সালে দেখা দেয়া ফ্লু মহামারীর মৃত্যু হার ২.৫%-র দ্বিগুণ।

এটা ঠিক, মহামারীর মধ্যে সংক্রমণ অনুপাতে মৃত্যুর হার ঠিকঠাক বের করা বেশ কঠিন, বিশেষ করে শুরুর দিকে। হুট করে যে আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা শুরু হয় তাতে কতজন ভাইরাসে মরল, আর কতজন হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা অন্য কারণে মরল তা বের করা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে পড়ে।

প্রথম যখন কোনো শহরে নতুন কোনো ভাইরাস আঘাত হানে তখন হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হয়; এবং স্বাভাবিকভাবেই তখন পরীক্ষা বা ময়নাতদন্ত ছাড়াই সেই হাজার হাজার মানুষকে কবর দিয়ে দেয়া হয়।

তাই ওই সময়ে কতজন ভাইরাসে মরেছে, আর কতজনের মৃত্যু অন্য কারণে হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। চীনের উহান আর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে প্রাদুর্ভাবের শুরুতে এমনটাই ঘটেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

হিসাব অনুযায়ী, বিশৃঙ্খলা যখন থিতিয়ে আসে, অনেক বেশি শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয় এবং অনেক বেশি মৃদু উপসর্গধারী রোগে মেলে, তখন মৃত্যু হারও কমে আসে। যদিও ফলাফল সব সময় এমনটাই হবে- তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, স্পেন, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও নিউ জিল্যান্ডে জনসংখ্যা অনুপাতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি শনাক্তকরণ পরীক্ষা হয়েছে।

অথচ একেক দেশে রোগী অনুপাতে মৃত্যু হার একেক রকম দেখা যাচ্ছে। আইসল্যান্ডে এ হার ১ শতাংশের নিচে, নিউ জিল্যান্ড আর ইসরায়েলে ২ শতাংশের নিচে; অন্যদিকে বেলজিয়ামে ১৬%, ইতালি আর যুক্তরাজ্যে ১৪ শতাংশের কাছাকাছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচির ক্লিনিকাল সেবার প্রধান ড. জেনেট ডিয়াজ জানান, এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ দেশেই শনাক্ত রোগীর মোটামুটি ২০ শতাংশর জন্য অক্সিজেন বা হাসপাতালের নিবিড় সেবার প্রয়োজনীয়তা দেখা গেছে।

এসব রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বয়স, অসুস্থতার ধরন এবং কী ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে- এ ধরনের অনেক কিছুই ভূমিকা রাখে।

মনে করা হচ্ছিল, যেসব দেশে তরুণ জনগোষ্ঠী তুলনামূলক বড় এবং স্থূলতা কম, এমন দেশগুলোতে মৃত্যুর হার কম হবে। এ ধরনের বেশিরভাগ দেশই মূলত দরিদ্র। আবার এসব দেশে অক্সিজেন ট্যাংক, ভেন্টিলেটর বা ডায়ালাইসিস মেশিনের ঘাটতি আছে; বাসিন্দাদের বেশিরভাগের বাসস্থানও হাসপাতাল থেকে অনেক অনেক দূরে। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার অভাবে এসব দেশে মৃত্যু হারও অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশিই হওয়ার কথা।

এ ধরনের বিপরীতমুখী অনুষঙ্গও করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সত্যিকার হার নির্ধারণ কঠিন করে তুলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দাতা সংস্থা অবশ্য করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে এমন দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য অক্সিজেন সরবরাহের উপকরণ সংগ্রহে রীতিমত ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি করোনাভাইরাসের মৃত্যুহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন নতুন কিছু ‘ফ্যাক্টরও’ যুক্ত হচ্ছে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ‘এ’ গ্রুপের রক্ত আছে যাদের তাদের করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পরিমাণ অন্যদের তুলনায় বেশি। পশ্চিম আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ‘এ’ গ্রুপের রক্ত তুলনামূলক কম’ দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে তো একেবারেই বিরল। অথচ ব্রাজিলে আদিবাসী এলাকাগুলোতে মৃত্যুর হার রীতিমত আশঙ্কাজনক।

গত সপ্তাহের বৈঠকের আগে নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অনুপাতে মৃত্যু কত হতে পারে সে সম্বন্ধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যর কোনো আনুষ্ঠানিক মূল্যায়নই ছিল না বলে জুনের শুরুতে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন সংস্থাটির হেলথ ইমার্জেন্সি ইনফরমেশন অ্যান্ড রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট পরিচালক অলিভার মরগান।

এ বিষয়ে তাদের নির্ভরতা ছিল সদস্য দেশ ও বিভিন্ন গবেষক দলের পাঠানো তথ্য এবং মে মাসে করা অস্ট্রেলিয়ার ওলংগং বিশ্ববিদ্যালয় ও জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের করা বিস্তারিত বিশ্লেষণ।

অস্ট্রেলিয়ার এ গবেষকরা ডজনেরও বেশি দেশের ২৬৭টি আলাদা আলাদা গবেষণা থেকে তুলনামূলক নির্ভুল এমন ২৫টি গবেষণার তথ্য বেছে নেন; এবং সেগুলো গড় করে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে মৃত্যু আক্রান্ত অনুপাতে মৃত্যু হার ০.৬৪% বলে জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ হার ০.৪% বলে অনুমান সিডিসির। তবে কোন কোন তথ্যের ভিত্তিতে এ মূল্যায়ন করা হয়েছে এবং কেন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়নে থাকা হারের চেয়ে কম, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলেও সিডিসির কাছ থেকে সাড়া মেলেনি।

সিডিসির এ হিসাবও কিন্তু আতঙ্কজনক। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার ০.৪% হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ। অবশ্য এ পরিমাণ মৃত্যু হতে হলে দেশটির সবাইকে নতুন এ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে হবে।

অস্ট্রেলিয়ার গবেষকরা যে ২৫টি গবেষণাকে তুলনামূলক নির্ভুল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, সেগুলো আবার করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে। তাদের বেছে নেয়া গবেষণাগুলোর মধ্যে যেমন জাপানে নোঙর করা প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেসের সব যাত্রী ও ক্রুর পিসিআর টেস্টের ফল আছে, তেমনি আছে স্পেনের ৩৮ হাজার মানুষের উপর চালানো অ্যান্টিবডি টেস্ট এবং মাত্র ১১০৪ জন সুইডিশের উপর চালানো অন্য একটি পরীক্ষার ফলও।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন অবশ্য কী পরিমাণ মানুষের দেহে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি আছে, তার উপর ভিত্তি করে তাদের মূল্যায়ন ঠিক করলেও এই বিষয়ে আরও গবেষণা দরকার বলে মনে করছেন স্বামীনাথন।

তবে এতকিছুর পরও পরীক্ষার বাইরে থাকা ভাইরাসটির নীরব বাহকদের কারণে মৃত্যুহারের সঠিকতা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে, বলেছেন মরগান।

নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসে মৃত্যুহার এখনও বদলে যেতে পারে। কেননা, ভাইরাসটির অনেক কিছুই এখনও অজানা।

ইরান ও একুয়ডেরের মতো ব্যতিক্রম বাদ দিলে নতুন এ করোনাভাইরাসকে প্রথমে এশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার তুলনামূলক ধনী দেশগুলোতেই মারাত্মক আঘাত হানতে দেখা গেছে। এসব দেশে স্বাস্থ্যসেবাকেও তুলনামূলক বেশ আধুনিকই মনে করা হয়।

আর এখন ভাইরাসটি বিস্তৃত আকারে ছড়াচ্ছে ভারত, ব্রাজিল, মেক্সিকো, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে যেখানে বিভিন্ন বস্তিতে লাখ লাখ মানুষের বাস, লকডাউন কার্যকর করা তুলনামূলক কঠিন এবং হাসপাতালগুলোর সম্পদও সীমিত।

উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বেশিরভাগ ধনী দেশেই ভাইরাস প্রথম দফা আঘাত হেনেছিল মূলত সেসব দেশের বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে, ওইসব দেশে তখন তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়াই ছিল। শীত এলে দেশগুলোর বাসিন্দারা যখন ফের ঘরের ভেতর ঢুকে যেতে বাধ্য হবেন, একে অপরকে আক্রান্ত করবেন, তখন মৃত্যুহার আবার বেড়ে যাবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞই আশঙ্কা করছেন। সেসময় হয়ত মাস্ক পরা কিংবা শারিরীক দূরত্বের নির্দেশনা মানার গুরুত্ব আরও প্রকটভাবেই অনুভূত হবে।