আইসল্যান্ড: এখন মনে হবে, করোনাভাইরাস কখনও আসেইনি

পানশালা আর রেস্তোরাঁয় একরত্তি জায়গা ফাঁকা নেই। মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাধাহীন। নয়নাভিরাম প্রকৃতি আর দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণপিপাসুদের জন্য উন্মুক্ত।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 July 2020, 04:12 AM
Updated : 5 July 2020, 08:04 AM

ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র আইসল্যান্ডে বেড়াতে গিয়ে যে কেউ এখন ভাবতে পারেন- তিনি হাজির হয়েছেন অন্য কোনো দুনিয়ায়, যেখানে করোনাভাইরাস বলতে কোনো কিছু ছিল না!

লকডাউনের কড়াকড়ির কোনো দেশ থেকে আসা পর্যটকদের জন্য এই পরিবেশ অভাবনীয়। রাজধানী রেইকাভিকে গমগম করতে থাকা কোনো রেস্তোরাঁয় বসে দুপুরের খাবার খাওয়া যেন কানফাটানো গর্জনের মধ্যে গুটফস জলপ্রপাত দেখার মতই রোমাঞ্চকর। 

আইসল্যান্ড কী করে এমন ভরপুর জীবন যাপন চালিয়ে যেতে পারছে, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে।

এমন নয় যে সুমেরুর কাছাকাছি এই দ্বীপ দেশের মানুষ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। বরং শুরুর দিকে, স্বল্প জনসংখ্যার এই দেশটিতে নতুন এই ভাইরাস বেশ ভালোভাবেই ছড়িয়েছিল। তবে তারা দ্রুত সে সঙ্কট সামলে উঠতে পেরেছে বিস্তৃত পরিসরে ট্র্যাকিং ও ট্রেসিং ব্যবস্থাপনার কারণে।

বলা যায়, দেশ থেকে করোনাভাইরাস দূর করতে এখন পর্যন্ত সফল হয়েছে আইসল্যান্ড। আর তার ফলেই গত ১৫ জুন থেকে পর্যটকদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

এর ঠিক দুই দিন পর, ১৭ জুন ছিল আইসল্যান্ডের জাতীয় দিবস। বরাবরের মতই রাজধানীর সড়কগুলো মুখর ছিল মানুষের উদযাপনের সুরে।

কারো মুখে ছিল না মাস্ক; সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মানতে কাউকে তটস্থ থাকতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী কাতরিন ইয়াকপস্তোতির নিজেও বেরিয়ে এসে ভাষণ দিয়েছেন জনতার সামনে।

আইসল্যান্ডের রেস্তোরাঁগুলোতে থাকে এমনই ভিড়। ছবি: সিএনএন

তবে সেজন্য সীমান্তে সাবধানতায় ছাড় দেয়নি আইসল্যান্ড। আকাশপথে যারা আইসল্যান্ডে আসছেন, তাদের অবশ্যই মাস্ক পরতে হচ্ছে। বিমানবন্দরে নামার পর তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে নমুনা দিতে হচ্ছে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য।

এই প্রক্রিয়ায় কিছু ঝক্কি তো রয়েছেই। তবে পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যাত্রীদের মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ফলাফল পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কারো কোভিড-১৯ পজিটিভ হলে বেড়ানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে। আর ফলাফল যদি নেগেটিভ হয়, তাহলে আইসল্যান্ডের সৌন্দর্য উপভোগ করতে তার আর বাধা থাকছে না।

১ জুলাই থেকে ইউরোপের শেঙ্গেন জোনের বাইরের দেশগুলো থেকেও পর্যটকদের আসার সুযোগ দিচ্ছে আইসল্যান্ড। বিমানবন্দরে কোভিড-১৯ পরীক্ষার এই প্রক্রিয়ার জন্য তাদের ৭৯ ডলার করে দিতে হচ্ছে। অবশ্য কেউ আগাম দিলে ছাড়ে তার খরচ পড়ছে ৬৫ ডলার।  

আইসল্যান্ড এতটাই দক্ষতার সাথে তাদের স্ক্রিনিং এবং কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কার্যকর করতে পেরেছে যে মৃত্যুর সংখ্যা এখনও সীমিত রয়েছে ১০ এর মধ্যে। 

অথচ শুরুর দিকে সংক্রমণের হারে আইসল্যান্ড ছিল ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে উপরের দিকে। সে সময় এ দেশে প্রতি লাখে ৫১৩ জনের সংক্রমণ ধরা পড়ছিল, যেখানে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল তখন প্রতি লাখে ৪৫০ জন।

আইসল্যান্ডের সব কোভিড-১৯ পরীক্ষা হচ্ছে রেইকাভিকের বেসরকারি ল্যাব ‘ডিকোড’ এর মাধ্যমে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কারি স্তেফানসন সিএনএনকে বলেছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ভাইরাসের বিবর্তনের ধারাটি তারা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন, যা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে সাফল্য পাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে।

তিনি বলেন, একটি ভাইরাস যখন এক অঞ্চল থেকে নতুন আরেক অঞ্চলে যায়, তখন এটি দ্রুত নিজেকে বদলে নিতে থাকে।

যেহেতু আইসল্যান্ডে আক্রান্ত প্রত্যেকের নমুনা থেকে ভাইরাসের সিকোয়েন্স করা হয়েছে, সেহেতু প্রথমেই তারা বোঝার চেষ্টা করেছেন, ওই নির্দিষ্ট ভাইরাসটি কোন অঞ্চল থেকে এসেছে। ফলে সমাজের কোন অংশে কীভাবে ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে, তা অনুসরণ করা সহজ হয়েছে বলে মনে করেন কারি স্তেফানসন। 

তিনি জানান, ল্যাবে যে তথ্য তারা জানতে পারছেন, তা দেওয়া হত দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে। ফলে সম্ভাব্য আর যারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের ওপর নজর রাখতে পেরেছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।

আইসল্যান্ডে বিমানবন্দরে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও এখন দেশের ভেতরে তা নয়। ছবি: সিএনএন

আইসল্যান্ড সরকারের এই ট্রেসিং টিমের ডাক পেয়েছিল ক্রিসটিন গুননারসদোত্তির। তাকে ডেকে বলা হয়েছিল, ঠিক ছয়দিন আগে এক রেস্তোরাঁয় দুপুরে তাকে যে খাবার পরিবেশন করেছিল, তিনি কোভিড-১৯ আক্রান্ত।

এরপর ক্রিসটিনকে যেতে হল আইসোলেশনে, ধীরে ধীরে তার উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করল, করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল এল পজিটিভ।

“যখন জানতে পারলাম আমাকে অন্তত দুই সপ্তাহ ঘরে থাকতে হবে, একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত আমাকে ঘরে থাকতে হয়েছিল ২৩ দিন। কারণ সেরে ওঠার পর কোনো রকম উপসর্গ ছাড়া আরও সাত দিন আইসোলেশনে কাটালে তবেই ওরা কাউকে ছাড়পত্র দেয়।”

অন্য অনেক দেশ কেন একই পদ্ধতিতে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করছে না, তা ভেবে অবাক হন স্তেফানসন। 

“অন্ধকারে ঢিল না ছুড়ে আমরা বরং এ পদ্ধতিতে সবকিছু জেনেবুঝে কাজ করতে পারছি। আমার মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে যা যুক্তরাজ্যে যা ঘটেছে, তা আসলে স্ক্রিনিংয়ের অভাবে অথবা বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা না করার কারণে ঘটছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিই খুব কঠিন।” 

মহামারী বাগে আনার পর আইসল্যান্ডের সরকার এখন অর্থনীতির চাকা চালু করা চেষ্টায় আছে, বিশেষ করে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন খাতের দিকে নজর দিচ্ছে তারা। আর এ কারণে ঝুঁকি জেনেও খুলে দেওয়া হয়েছে সীমান্ত।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কাতরিন ইয়াকপস্তোতির ভাষ্য, “মহামারীর দ্বিতীয় পর্যায়ের ধাক্কা নিয়ে আমি অবশ্যই চিন্তিত। কিন্তু আইসল্যান্ডে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এত বেশি বেকারত্ব আমাদের থাকে না। সে কারণে এই হার কীভাবে কমানো যায়, এবং কীভাবে বেশি মানুষকে কাজে ফেরানো যায়, সেই নীতি নিয়েই আমাদের অগ্রসর হতে হচ্ছে।”

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে দ্বিগুণ বেড়ে এপ্রিলে আইসল্যান্ডে বেকারত্বের হার হয় ৭ শতাংশ। পরে তা আরও বেড়েছে।

রেইকাভিকের কাছে ঝরনার ধারে পর্যটকদের উদযাপন। ছবি: সিএনএন

ব্ল লেগুন জিওথার্মাল স্পার মত আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রগুলো মার্চ মাস থেকে বন্ধ ছিল। আগে সেখানে প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে তিন হাজার দর্শনার্থীর যাতায়াত ছিল। লকডাউনের সময়টায় সেই আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে আইসল্যান্ড।   

এখন তা খুলে দেওয়া হলেও আগের মত উপচে পড়া ভিড় থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে পর্যটকের সংখ্যাও সেখানে বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

মহামারীর সঙ্কটের মধ্যে ট্যুর অপারেটর কোম্পানি হিডেন আইসল্যান্ড তাদের কর্মীসংখ্যা ১৫ থেকে কমিয়ে ৬ জনে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল। সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর এখন আশার আলো দেখছেন এ কোম্পানির অন্যতম মালিক স্কট ড্রুমন্ড। সিএনএনকে তিনি বলেন, পর্যটকরা এখন আগাম বুকিং দিচ্ছেন।

২০১৯ সালে আইসল্যান্ডের মোট জিডিপির ৮ শতাংশ এসেছে পর্যটন থেকে। আর সীমান্ত খুলে দিলে যে অর্থনীতির অন্যান্য খাতে তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

ইউনিভার্সিটি অফ আইসল্যান্ডের অধ্যাপক টিনা আউশগেসডফটিস বলেন, “এটা ঠিক যে পর্যটন খাত একেবারে বসে গিয়েছিল। তবে সার্বিকভাবে আইসল্যান্ডের বাণিজ্যিক ভারসাম্য ততটা ধাক্কা খায়নি। এখন সীমান্ত খুলে দেওয়ায় আইসল্যান্ডের মানুষও অন্য দেশে যাবে, তাতে দেশ থেকেও কিছু অর্থ বাইরে চলে যাবে।

“কোভিড-১৯ সঙ্কটের সময় আইসল্যান্ডের মানুষ তাদের খরচের বেশির ভাগই ব্যয় করেছে দেশের মধ্যে। সুতরাং আমাদের এখন অনেক কিছু ভেবে দেখার বিষয় আছে।”

প্রধানমন্ত্রী কাতরিন ইয়াকপস্তোতি বলছেন, এটা শুধু অর্থনীতির বিষয় নয়। আইসল্যান্ড একটি দ্বীপ, আর এই আধুনিক সময়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাতায়াতের পরিবহন ব্যবস্থা চালু থাকবে- সেটাই স্বাভাবিক।

আইসল্যান্ড আশা করছে, ছোঁয়াচে এ ভাইরাস সামলে কী করে মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায়, সে বিষয়ে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে তারা। ছোট এই দেশটির সামনে এটাই এখন বড় পরীক্ষা।