চীন-ভারত দ্বৈরথ: শুরু হচ্ছে ‘অবিশ্বাস আর বৈরিতার সময়’

তিন হাজার ৪৪০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের মধ্যে বিবাদের ইতিহাস এবং পাল্টাপাল্টি সীমানা লংঘনের অভিযোগ নতুন নয়।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2020, 09:41 AM
Updated : 17 June 2020, 11:32 AM

দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে প্রায়ই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে; কখনো কখনো ধস্তাধস্তিও হয়। তবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে কোনো পক্ষকেই গুলি চালাতে দেখা যায়নি।

সোমবারও এর অন্যথা হয়নি, অথচ সেদিনের সংঘর্ষে কেবল ভারতের দিক থেকেই ২০ সৈন্য নিহতের ঘটনা ঘটল।

বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অমীমাংসিত স্থল সীমান্তকে ঘিরে অর্ধশতাব্দির মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এ সংঘর্ষকে ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনেকেই ‘নজিরবিহীন’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

“খারাপ লাগছে, খুব খারাপ,” লাদাখে ভারত ও চীনা সৈন্যদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ নিয়ে এমনটাই বলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ভিপিন নারাং।

“যখন প্রাণহানি হয়, তখন উভয় পক্ষের জন্যই সবকিছু শান্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এখন জনমতের চাপও একটি সূচকে পরিণত হবে,” বলেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সিকিউরিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ড. নারাং।

ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে সোমবার অন্তত ২০ ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। নয়া দিল্লির দাবি, সংঘর্ষে দুই পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনাবৃদ্ধি, তারপর সংঘর্ষ-প্রাণহানির কারণেই এবারের সংঘর্ষকে ‘নজিরবিহীন’ বলছেন ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শশাঙ্ক জোশী।

“৪৫ বছরে একটিও গুলি চলল না, আর এক সন্ধ্যাতেই পাথর ছোড়াছুড়ি আর গদায় ২০ সেনা নিহত হয়ে গেল,” বলেছেন তিনি।

ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্তবিরোধ নিয়ে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কয়েকবার ধস্তাধস্তি ও মারামারির ঘটনা ঘটলেও দুই পক্ষের মধ্যে একবারও গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেনি।

নয়া দিল্লির অভিযোগ, মে-র শুরু থেকেই লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ডের কয়েক কিলোমিটার ভেতর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঢুকে পড়ে চীনা সৈন্যরা। সেখানে তারা পরিখা খনন করে ও তাঁবু টাঙায় বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনেও জানানো হয়েছিল।

চীন এখন পর্যন্ত ভারতের ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের মতো এলাকা দখল করে রেখেছে বলে নয়া দিল্লি দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে।

চীনা সেনারা কেবল গত এক মাসেই ৬০ বর্গকিলোমিটারের মতো জায়গা দখল করে নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা।

চলতি দফায় ভারত-চীন উত্তেজনা শুরু হয় ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত একটি বিমান ঘাঁটির জন্য তৈরি করা কয়েকশ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সড়ককে কেন্দ্র করে। ভারত ২০০৮ সালে তাদের ওই বিমান ঘাঁটিটি ফের সচল করেছিল।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ভারত ও চীন একে অপরের বিরুদ্ধে গালওয়ান উপত্যকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে হওয়া সমঝোতা লংঘনের অভিযোগ করছিল। উত্তেজনা প্রশমনে কূটনৈতিক ও সামরিক চ্যানেলে আলাপ-আলোচনাও চলছিল।

দুই দেশের সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের মধ্যে ৬ জুনের বৈঠকে ‘উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে বলে নয়া দিল্লির পক্ষ থেকে জানানো হয়।

“তারা উত্তেজনা প্রশমনে রাজি হয়েছিল। যে সমঝোতা হয়েছে, তা কার্যকরে সেখানে থাকা কমান্ডারদের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠকও হয়েছে,” জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

কিন্তু ‘বজায় থাকা স্থিতাবস্থা পরিবর্তনে চীনের একতরফা চেষ্টার’ পর সোমবার দুই পক্ষেই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি নয়া দিল্লির।

অন্যদিকে বেইজিং দুই পক্ষের মধ্যে হওয়া সমঝোতা ‘লংঘনের’ দায় দিচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে। তাদের অভিযোগ, ভারতের সেনারা দুই দফা সীমানা টপকে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল এবং চীনা কর্মকর্তাদের উপর উসকানিমূলক হামলা চালিয়েছিল।

ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক অঙ্কিত পান্ডা দুই দেশের মধ্যে এবারের সংকটকে ২০১৭ সালে ডোকলামকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সংকটের চেয়েও ‘গুরুতর’ বলছেন।

ভারত, চীন ও ভুটানের কাছে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ডোকলামে চীনের সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে বেইজিং ও নয়া দিল্লির সেনারা ৭৩ দিন মুখোমুখি অবস্থানে ছিল।

“কিন্তু চীনের এবারকার আচরণ অতীতে আমরা যেরকমটা দেখেছি, তার তুলনায় একেবারেই ভিন্ন,” বলেছেন ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন।

“আমরা বেশ কয়েকটা ঘটনা দেখলাম, বেশ কয়েকবার তাদের অগ্রসর হতে এবং ভূমি দখল করতে দেখলাম; এলএসির আশপাশে এসব ভূমি আগে কখনোই দখল করেনি তারা। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়, কারণ চীনের অতীত আচরণের তুলনায় এটি একেবারেই আলাদা,” অনলাইন নিউজ পোর্টাল অয়্যারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমনটিই বলেছেন তিনি।

লাদাখ সীমান্তে চীনের এমন আচরণের পেছনে কী কী কারণ থাকতে পারে তা নিয়ে নানান তত্ত্বও বাতাসে ভাসছে।

কৌশলগত দিক থেকে দেখলে, সীমান্তে নয়া দিল্লির স্থাপনা নির্মাণ ও সরব উপস্থিতিই চীনের সেনাদেরকে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। বিশ্বজুড়ে মহামারীর সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বেইজিংও তাদের দখল বাড়াতে সচেষ্ট হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

ড. নারাং বলেন, “এটা কি ওই সড়কের জন্য? আর্টিকেল ৩৭০ এর জন্য (গত বছরের অগাস্টে ভারত একতরফাভাবে তাদের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মর্যাদা পরিবর্তন করেছিল)? এটা কি বিস্তৃত আগ্রাসন? আমরা জানিনা। তবে এটি উত্তেজনাপূর্ণ এবং এখনো শেষ হয়নি।”

চীনে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা শিবশঙ্কর মেনন বলছেন, দেশের ভেতরকার ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের’ কারণে চীনকে এখন প্রবল জাতীয়তাবাদী চরিত্র ধারণ করতে হচ্ছে।

“আপনারা পূর্ব চীন সাগরে তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে তার আচরণ দেখেন, হংকংয়ের সঙ্গে কথা না বলেই আইন পাশ করছে, ভারত সীমান্তে আগ্রাসী আচরণ করছে, অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধ বাধাচ্ছে,” বলেছেন মেনন।

লাদাখের যে এলাকায় সংঘর্ষ বেধেছিল, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভারতের সেনাবাহিনী সেখান থেকে সরে আসার কথা জানিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যে সামরিক পর্যায়ে যোগাযোগ হচ্ছে এবং উভয় পক্ষই উত্তেজনা না বাড়ানোর পক্ষে সম্মত হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ধারণাও পাওয়া গেছে। 

“ভারতের জন্য এটা ভালো খবর। কেননা এই মুহুর্তে কার্যকর পাল্টা পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে তার হাতে বিকল্প খুব একটা নেই,” বলেছেন ডিপ্লোম্যাটের অজিত পান্ডা।

সোমবারের সংঘর্ষের বড় প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক পর্যায়ে দেখা যাবে বলে অনুমান শশাঙ্ক জোশীর।

গত ১০ বছর ধরে চীন-ভারতের মধ্যে বিবাদ একটু একটু করে ঘনীভূত হলেও বৃহদার্থে স্থিতিশীলই ছিল, বলেছেন তিনি।

১৯৯৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে দেশদুটির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৬৭ গুণ বেড়েছে; পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও চীন এখন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার।

চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অসংখ্য ভারতীয় শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। দুই দেশ যৌথ সামরিক মহড়াও চালিয়েছে।

“২০১৮ সালের শীর্ষ সম্মেলনে হৃদ্যতার যে বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল, তার রেশ অনেকটাই ধুয়ে মুছে গেছে; এখন সম্ভবত আমরা তীব্র অবিশ্বাস ও বৈরিতার এক নতুন সময়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি,” বলেছেন জোশী।