করোনাভাইরাস: ‘নীরব শূন্যতায়’ পার হল এক রমজান

মার্চে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রায় তিন সপ্তাহ পর রমজানের কয়েকদিন আগে মারা যান ব্রুকলিনের প্রবাসী বাঙালি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আলি মামুন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 May 2020, 07:42 AM
Updated : 27 May 2020, 08:38 AM

আশপাশে তখন মহামারীতে মৃতের সংখ্যা অনেক। প্রথা অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদের নিউ ইয়র্কের বাড়ি থেকে ঘণ্টাখানেক দূরত্বে নিউ জার্সিতে তাকে কবর দেয় তার মুসলিম পরিবার।

দুই সপ্তাহ পর তার স্বজনরা যখন মামুনের কবর জিয়ারত করতে মার্লবোরো মুসলিম মেমোরিয়াল সেমেট্রিতে গিয়ে সারি সারি নতুন অনেক বাঙালির কবর দেখে হতবাক হয়ে পড়েন। তাদের বয়স ৫০ ও ৬০ বছরের মধ্যে, যাদের অনেকেই প্রবাসী সমাজে বেশ সুপরিচিত।

মামুনের ৩১ বছর বয়সী জামাতা সাঈদ চৌধুরী বলেন, “এমন রমজান আসবে তা কখনও কল্পনা করতে পারিনি। রোজার দিন মানেই একসঙ্গে ইফতার শেষে তারাবি পড়তে যাওয়া। কিন্তু এবার রমজান পুরোটাই ছিল নিরবতা ও শূন্যতায় ভরা।”

নতুন করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে নিউ ইয়র্কে। সেখানে আক্রান্ত ৩ লাখ ৬০ হাজার জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ২৯ হাজার। সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বজুড়েই অনুসৃত সামাজিক দূরত্বের বিধির কারণে রমজান মাসে মুসলমানদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদে জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি বা সীমিত আকারে হয়েছে, নিউ ইয়র্কও তার ব্যতিক্রম।

লং আইল্যান্ডের হিলসাইড ইসলামিক সেন্টারের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ ভুইয়া বলেন, “অনেকের জন্য এই সময়টা মানসিক ও আবেগের দিক থেকে অনেক কষ্টের ছিল। কিছু কিছু ইসলাম চর্চা কেন্দ্র থেকে অনলাইনে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ উপদ্রুত অঞ্চলে সেই সুযোগ নেই।”

মহামারীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দরিদ্র অভিবাসীরা, যেখানে নিউ ইয়র্কের বাঙালি প্রবাসীরা বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন বলে সেখানকার মুসলিম নেতারা জানান।

৯০টির বেশি মুসলিম সংগঠনের প্লাটফর্ম ইসলামিক লিডারশিপ কাউন্সিল অব নিউ ইয়র্কের নির্বাহী পরিচালক রাজা আব্দুলহক বলেন, “আমরা জানি, ভাইরাসে মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানরা।”

সরকারি উপাত্তে দেখা যায়, নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকাগুলোতে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বসবাস বেশি। জ্যামাইকা, এমহার্স্ট ও জ্যাকসন হাইটসের মতো কুইন্সের এলাকাগুলো বাঙালি প্রধান।

আব্দুলহক বলেন, এপ্রিলের শেষ নাগাদ শেষকৃত্য আয়োজক সংগঠনগুলো প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের দাফন করতো, যাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই বাঙালি, হয় বাংলাদেশি না হয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।

২৭ বছর বয়সী রিভু ইসলাম বলেন, তার তিন চাচা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলেও তারা সবাই সেরে উঠেছেন। কিন্তু পরিচিত ৫০ জনের বেশি বাংলাদেশি আমেরিকান গত কয়েক সপ্তাহে মহামারীতে মারা গেছেন।

ভাইরাস ঠেকাতে অবরুদ্ধ অবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকার কারণেও মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলোর মসজিদ ও ইসলাম চর্চা কেন্দ্রগুলোর বছরের ৮০ শতাংশ বাজেটের যোগান আসে রমজানের চাঁদা থেকে। কিন্তু এবার মহামারী সেই যোগানের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

আব্দুল আজিজ ভুইয়া বলেন, মসজিদগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খুব স্বল্প সংখ্যক মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার অনলাইনে চাঁদা তুলতে পেরেছিল।

দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসী নারীদের সহায়তায় কর্মরত অলাভজনক সংস্থা স্বপ্না এনওয়াইসির নির্বাহী পরিচালক দিয়া বসু সেন বলেন, তারা অন্তত ২০০ নারীকে সহায়তা করেছেন, যাদের বেশিরভাগই বাঙালি। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরই পরিবারে কেউ না কেউ চাকরি হারিয়েছেন।

তার সংস্থা গত সপ্তাহে ত্রাণ হিসেবে হালাল মুরগি বিতরণ করেছিলেন, যেখানে ২৪ ঘণ্টায় ১৫০টি পরিবার সেই খাবার নিয়েছেন।

রিভু ইসলাম বলেন, রমজানে তিনি যেটার সবচেয়ে বড় অভাব বোধ করেছেন তা হলো-গোষ্ঠীবদ্ধ থাকতে না পারা। এটা রমজান মনেই হয়নি।

কুইন্সের সানিসাইডের অ্যাপার্টমেন্টে আইসোলেশনে থাকায় রমজানে তার পরিবারের সঙ্গে দেখাই হয়নি বলে রিভু জানান।

তিনি বলেন, রমজানে একসঙ্গে বাঙালি নানা পদের খাবার দিয়ে ইফতার করা বা জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে নামাজ পড়তে যাওয়ার দিনগুলির কথা তার খুব মনে পড়েছে।

“আহা, এই রমজানটাও যদি তেমন হতো! তবে আমি আশাবাদী, আগামী বছর তা করতে পারব।”