মহামারী ঠেকাতে সবই তো করেছিল পেরু, তবুও পারল না

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে কঠোর যে সব পদক্ষেপ, তার সবই নিয়েছিল পেরু; সবাইকে ঘরে থাকার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, জারি করা হয়েছিল সান্ধ্য আইন, সীমান্তও করেছিল বন্ধ।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2020, 06:19 PM
Updated : 26 May 2020, 06:57 PM

অথচ কী হল? সেই পেরুতে এখন কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার; এর মধ্যে মারা গেছে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি।

আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় এখন লাতিন আমেরিকার মধ্যে ব্রাজিলের পরই পেরু; অথচ করোনাভাইরাস মোকাবেলার লড়াইয়ে দুই দেশের পথ সম্পূর্ণ বিপরীত।

লাতিন আমেরিকায় পেরুই প্রথম দেশ, যারা এই ভাইরাস মোকাবেলায় কঠোর পথে হেঁটেছে শুরু থেকে; আর ব্রাজিল একে পাত্তা না দিয়ে কোনো সতর্কতামূলক পদক্ষেপই নেয়নি শুরুতে।

ব্রাজিলের ডানপন্থি প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো যখন লকডাউনবিরোধী অবস্থান নিয়ে সক্রিয়, তখন গত ১৫ মার্চই জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন পেরুর মধ্যপন্থি প্রেসিডেন্ট মার্তিন ভিসকারা।

এই জরুরি অবস্থার আওতায় কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, সীমান্ত বন্ধ করা হয়েছিল।

দুই যাত্রায় তবুও কেন পেরু ও ব্রাজিলের একই ফল?

তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোনো দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার কারণেও কীভাবে একটি সংক্রামক ব্যাধি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।

উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ পেরুর হাসপাতালগুলোর ৮৫ শতাংশ আইসিইউ এখন রোগীতে ভর্তি। রোগী সামলাতে হিমশিম অবস্থা হাসপাতালগুলোর। দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির দেশটির সরকারি তথ্যই এই খবর দিচ্ছে।

“এই পরিস্থিতিকে জরুরি অবস্থা বললে কম বলা হবে, বলতে হবে বিপর্যয়কর অবস্থা, এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের স্বাস্থ্য দপ্তরের নেই,” সিএনএনকে বলেন মেডিকেল কলেজ অব পেরুর চিকিৎসক আলফ্রেদো সেলিস।

করোনাভাইরাস মহামারী সঙ্কটে ফেলেছে পেরুর এমন অনেককে। ছবি: রয়টার্স

যে দেশটি মহামারী ঠেকাতে শুরু থেকে এত তৎপর ছিল, তাদের এই হাল কেন?

‘অর্থনৈতিক বৈষম্য’- এক কথায় উত্তর দেন পেরুর আরেক চিকিৎসক এলমার হুয়ার্তা।

তিনি সিএনএনকে বলেন, “এই মহামারী দেখে আমি শিখেছি, একটি ভাইরাস কী করে একটি স্থানের আর্থ সামাজিক অবস্থা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে।”

পেরুর অনেকের ঘর থেকে বের না হয়ে কোনো উপায়ই নেই। অন্তত কাজের জন্য, খাবার সংগ্রহের জন্য কিংবা ব্যাংকে যাওয়ার জন্য তাদের বেরুতেই হয়।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ২০১৭ সালের সরকারি তথ্য বলছে, পেরুর ৪৯ শতাংশ মানুষের বাড়িতে রেফ্রিজেরেটর বা ফ্রিজার রয়েছে।

যার অর্থ হচ্ছে, ৫১ শতাংশের বাড়িতে তা নেই। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি মানুষের ঘরে খাবার সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তাদের দৈনিক বাজারে যেতে হয়।

“যার মানে হচ্ছে, এই গরিব মানুষগুলোর প্রতিদিনই বের হতে হচ্ছে। আর বেশিরভাগ যখন ঘরে থাকছে না, তখন সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা আপনি নিশ্চিত করবেন কী করে?” বলেন ডা. হুয়ার্তা।

খাবার কিনতেই ভিড় বেশি পেরুর দোকানে। ছবি: রয়টার্স

ঘরে থাকার কঠোর নির্দেশনা দিয়ে জরুরি অবস্থা জারির এক মাস পর গত ১৪ এপ্রিল পেরু টিভিতে দেখানো হচ্ছিল রাজধানী লিমার উপকণ্ঠের একটি শহরে কেনাকাটার জন্য মানুষের দীর্ঘ সারি। ওই সারির মানুষদের অধিকাংশের মুখে মাস্ক থাকলেও সামাজিক দূরত্বের বালাই ছিল না।

ওই সারিতে দাঁড়ানো এক নারী বলছিলেন, “আমাদের কোনো উপায় নেই, তাই এখানে। যদি না আসতাম, তাহলে খাবার পেতাম কোথায়? আমার বাড়িতে তো কোনো খাবার নেই।”

ঠিক ওই দিন পেরুতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৩০৩ জন। তার এক মাস ১০ দিন পর রোগীর সংখ্যা এখন ১০ গুণ বেশি।

আরেকটি সমস্যা হল ব্যাংকে মানুষের ভিড়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সঙ্কটে পড়া মানুষের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ সরকার ঘোষণা করে, সেই অর্থ তুলতে অনেককে ব্যাংকমুখী হতে হয়।

পেরুর অর্থনীতিবিদ ক্রিস্তিয়ান লোপেজ ভার্গাস সিএনএনকে বলেন, সঙ্কটাপন্ন পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়ার সরকারের সিদ্ধান্তটি ভালো, কিন্তু তা বিলির প্রক্রিয়াটি বাজে।

গত মাসে প্রকাশিত পেরুর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশটির মাত্র ৩৮ শতাংশের ব্যাংক একাউন্ট বা ব্যাংক হিসাব রয়েছে।

ফলে প্রণোদনার অর্থ পেতে ব্যাংক হিসাব না থাকা এই গরিব মানুষদের সরাসরি ব্যাংকে যেতে হয়েছে।

পেরুতে নিত্য পণ্য কেনাকাটার জন্য কিংবা ব্যাংকে মানুষের ভিড় কমছে না। ছবি: রয়টার্স

এটা ব্যাংকগুলোতে অযাচিত ভিড় তৈরি করেছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সহযোগী অধ্যাপক ভার্সাস, তার মতে একটু পরিকল্পিত হলে তা এড়ানো যেত।

তিনি আরও বলেন, পেরুর অনেক মানুষ এখনও এমনভাবে বসবাস করে, যেখাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বাস্তবে অসম্ভব।

পেরুর এই অর্থনীতিবিদের ভাষ্যে, তার দেশের ৩০ শতাংশ বাড়িতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষ থাকে, যেখানে একটি কক্ষে চার কিংবা তার চেয়েও বেশি জন ঘুমায়।

পেরুর পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, দেশটির ৭২ শতাংশ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত। ফলে এদের জীবিকার প্রয়োজনে নিয়মিতই বের হতে হয়।

পেরুতে মানুষের ভিড় জমার এই কারণগুলোকে ‘বিস্ফোরক সংমিশ্রণ’ বলছেন অর্থনীতিবিদ ভার্গাস।

এই পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার জন্য মানুষের অনিয়ন্ত্রিত আচরণকেই দায়ী করছেন পেরুর ক্ষমতাসীনরা।

পেরুর প্রেসিডেন্ট মার্তিন ভিসকারা। ছবি: রয়টার্স

দেশটির প্রেসিডেন্ট ভিসকারা ইতোমধ্যে জরুরি অবস্থার মেয়াদ ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

এনিয়ে পঞ্চম দফায় জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানো হল। এবার বিধিনিষেধের বেড়াজাল কিছুটা শিথিল করা হলেও স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণে সরকার কঠোর হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

জনসাধারণের কাজকর্মে বিরক্তি প্রকাশ করে প্রেসিডেন্ট ভিসকারা বলেছেন, মানুষকে অবশ্যই আচরণ বদলাতে হবে, কেননা এর জন্য কঠিন মূল্য দিতে হচ্ছে।

মানুষের ভিড় জমানোর প্রবণতাকে ‘আত্মকেন্দ্রিক’, ‘স্বার্থপরতা’ বলতেও ছাড়েননি তিনি।

তবে ডা. হুয়ার্তা ও অর্থনীতিবিদ ভার্গাস বলছেন, শুধু মানুষকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সমস্যার মূল কিন্তু অন্যখানে। আর সেটা যে কী, তা এই মহামারী নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে।