নভেল করোনাভাইরাসের উৎস কি চীনের গবেষণাগার, খুঁজবে যুক্তরাষ্ট্র

এই পর্যন্ত জানা তথ্য বলে যে প্রাকৃতিভাবে সৃষ্ট নভেল করোনাভাইরাস চীনের উহানে কোনো প্রাণী থেকে প্রথম মানবদেহে এসেছে। কিন্তু তা নিয়ে ঘোর সংশয়ী এক-তৃতীয়াংশ আমেরিকান; তাদের বিশ্বাস, প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি মানবসৃষ্ট এবং তৈরি হয়েছে চীনের কোনো গবেষণাগারে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2020, 10:55 AM
Updated : 17 April 2020, 05:12 PM

যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের এই বিশ্বাসের সঙ্গে যে কর্মকর্তারাও যাচ্ছেন, তা বেরিয়ে এসেছে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে; যাতে বলা হয়েছে নতুন এই ভাইরাসটির উৎস চীনের কোনো গবেষণাগার কি না, তার অনুসন্ধানে নামছেন তারা।

নভেল করোনাভাইরাসের উৎস নিয়ে বিশ্বজুড়ে যত ধরনের গুঞ্জন রয়েছে, তার মধ্যে চীনের পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া সংক্রান্ত তত্ত্বই সবচেয়ে বেশি আলোচিত; যদিও পশ্চিমা গবেষকদের অনেকেই বলছেন, এটি মানবসৃষট নয়।

গত ডিসেম্বরের শেষে চীন এই ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি স্বীকার করার পর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পে একে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলতেন। এতে তখন চীনের ক্ষেপে ওঠায় মজা নিলেও এখন যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বে সবচেয়ে বিপর্যস্ত।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা চাপা দিতে তার সমর্থক ও রিপাবলিকান প্রতিনিধিদের কয়েকজন চীনের ‘গবেষণাগার তত্ত্বে’ হাওয়া দিচ্ছেন বলেও খবর প্রকাশ পাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এই খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিএনএন।

ওই কর্মকর্তারা বলছেন, ভাইরাসটির উৎস অনুসন্ধানে সব ধরনের গুঞ্জনেরই সম্ভাব্যতাই খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হবে। পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাসের উৎপত্তির পাশাপাশি অন্য সব সম্ভাবনাও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।

এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, ভাইরাসটি চীনের পরীক্ষাগারে বানানো হয়েছে কি না এবং দুর্ঘটনাবশত সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছে কি না, তা এখন খতিয়ে দেখছেন তারা।

তবে এখনও চীনের গবেষণাগার তত্ত্বের সমর্থনে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায়নি বলে অন্য কয়েকজন কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছেন।

মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান মাইক মিলে করোনাভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের জোর তৎপরতার কথা জানিয়েছিলেন।

“এখনই সিদ্ধান্ত টানা ঠিক হবে না, তবে এই মুহুর্তে আমি বলতে পারি, তথ্য প্রমাণ এটিকে (ভাইরাসের উৎস) প্রাকৃতিক বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদিও আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই,” বলেছিলেন মিলে।

মার্কিন গোয়েন্দারা যে ভাইরাসের উৎস অনুসন্ধানে কাজ করছে বুধবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও তা স্বীকার করেন। যদিও এখন পর্যন্ত অনুসন্ধানে কী পাওয়া গেছে, তা বলতে রাজি হননি তিনি।

উহান শহরের সেই সি ফুড মার্কেট

যে ভাইরাসটি এখন বিশ্বে মহামারী বাঁধিয়ে লক্ষাধিক প্রাণ এরই মধ্যে বিনাশ করেছে, সেই নভেল করোনাভাইরাসটি বাদুড় থেকে এসেছে বলে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মনে করছেন।

এর আগে সার্স ও মার্সের জন্য দায়ী করোনাভাইরাসের উৎসও ছিল বাদুড়। সেই করোনাভাইরাস গোত্রেরই একটি নতুন এই ভাইরাস, যার সাধারণ নাম দেওয়া হয়েছে নভেল করোনাভাইরাস, বিজ্ঞানীরা বলেন সার্স-সিওভি-২।

বাদুড়ের দেহ উৎস হলেও নভেল করোনাভাইরাস অন্য একটি প্রাণী হয়ে মানবদেহে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, আর মাঝের এই প্রাণীটি বনরুই বলেই বেশিরভাগ গবেষকের অনুমান।

সন্দেহ কেন উহানের গবেষণাগারে?

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে একটি গবেষণাগার রয়েছে, যার নাম উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি (ডব্লিউআইভি)। সেখানে অনিরাপদ পরিবেশে সার্স করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা দেখে দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা উদ্বেগ জানিয়েছিল।

ওই গবেষণাগারের নিরাপত্তার ফোঁকর গলেই কোনোভাবে নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিকের ধারণা।

সম্প্রতি চালানো এক জরিপের তথ্য দেখিয়ে যুক্তরাজ্যের পত্রিকা গার্ডিয়ান বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ শতাংশ নাগরিকের বিশ্বাস, নভেল করোনাভাইরাসের উৎপত্তি কোনো গবেষণাগার। ২৩ শতাংশ আরেকটু বাড়িয়ে মনে করেন, দুর্ঘটনাবশত নয়, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই এই ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে।

এই বিশ্বাসের পেছনে ভিত্তি হিসেবে কাজহ করবে যুক্তরাষ্ট্রের দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে সম্প্রতি প্রকাশিত এক কলাম; যেখানে বলা হয়েছে, উহানের ওই ভাইরাস গবেষণাগারে অনিরাপদ পরিবেশের ফলে সার্সের মতো আরেকটি মহামারীর আশঙ্কা দুই বছর আগেই প্রকাশ করা হয়েছিল।

এখন পর্যন্ত গবেষণা বলছে, বাদুড়ই করোনাভাইরাসের উৎস

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে উহানের ওই গবেষণাগার পরিদর্শন করে আসা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে পাঠানো ‘স্পর্শকাতর’ তারবার্তায় ওই আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন।

ওই বছরের মার্চে আবারও উহানের ওই গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছিল বেইজিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পরিবেশ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য বিষয়ক কাউন্সেলরকে। তারপর ওয়াশিংটনে পাঠানো হয় আরেকটি ‘স্পর্শকাতর’ তারবার্তা।

ওই তারবার্তার একটিতে উহানের পরীক্ষাগারটির অনিরাপদ পরিবেশের সঙ্গে যথেষ্ট দক্ষ কর্মী না থাকার কথা তুলে ধরে বলা হয়েছিল, বাদুড়ের করোনাভাইরাস এবং মানুষে তার সম্ভাব্য সংক্রমণ নিয়ে এখানে যে গবেষণা চলছে, তা সার্সের মতো আরেকটি মহামারীর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

উহানের এই গবেষণাগার যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ট্রেক্সাসসহ নানা সংস্থার সহায়তা পেয়ে থাকে। ওই গবেষণাগারটিকে সুরক্ষিত করতে সেই সহায়তা জোরদারের সুপারিশ করা হয়েছিল ওই তারবার্তায়।

ওই তারবার্তাগুলো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও উহানের বায়োল্যাবের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি খারিজ করে দেননি। অবশ্য এর সঙ্গে কোভিড-১৯ এর কোনো সংযোগ আছে কি না, তাও বলেননি।

“এখনও অনেক কিছুই জানি না আমরা। প্রেসিডেন্টও আজ সে কথাই বলেছেন। আমাদের অনেক কিছুই জানতে হবে,” বলেছেন করোনাভাইরাসকে প্রায়শই ‘উহান ভাইরাস’ নামে অভিহিত করা পম্পেও।

উহানের ওই গবেষণাগারের প্রধান শি জেংলি দীর্ঘদিন করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের দুই মাস আগে তিনি গবেষণায় দেখান যে চীনের ইউনান প্রদেশে এক ধরনের বাদুড় তারা পেয়েছেন, সেই ধরনের বাদুড়ই ছিল সার্স মহামারীর জন্য দায়ী করোনাভাইরাসের পোষক।

সার্সের মতো মহামারী ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়ে শি জেংলির দল গবেষণা চালালেও তা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের মত।

স্তন্যপায়ী প্রাণী বইরুইয়ের মাধ্যমে বাদুড় থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে

“ভাইরাসটি গবেষণাগারে তৈরি বলে কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি, বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটা এসেছে কোনো প্রাণী থেকে। কিন্তু এটা এটাও নাকচ করে না যে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ওই ভাইরাসই কোনো গবেষণাগার থেকে বাইরে ছড়ায়নি, যেখানে করোনাভাইরাসের প্রাণীদেহে সংক্রমণ নিয়ে গবেষণা হচ্ছে,” বলছেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক জিয়াও ওইয়াং।

উহানের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’র আরেক গবেষণাগার নিয়েও রয়েছে একই সন্দেহ।

উহানের সামুদ্রিক প্রাণীর যে বাজার থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কথা বলা হচ্ছে, আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তির ওই বাজারের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা তা থাকার ইতিহাস ধন্দ তৈরি করেছে অনেকের মনে।

তার সঙ্গে যোগ হয়েছে চীনের ঢাকঢাক গুড়গুড়। শুরুতে সংক্রমণের বিষয়টি চাপা দিয়েছিল তারা। এক মাস পর তারা স্বীকার করে যে নতুন ধরনের এক করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে।

উল্টো অভিযোগ চীনের

চীন শুরু থেকেই তাদের পরীক্ষাগারে ভাইরাসটির উৎপত্তি সংক্রান্ত ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ নাকচ করে আসছে।

অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে উহানের সেই গবেষণাগারের প্রধান শি গত ৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, নতুন এই করোনাভাইরাসের উৎস বাদুড়।

ট্রাম্পের টিপ্পনীর পাল্টায় চীনের গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে বক্তব্য দিতে থাকে।

এই সময়েই চীনের গ্লোবাল টাইমসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংক্রামক রোগ গবেষণাগারের কার্যক্রম স্থগিত রাখার খবর আসে।

এখবরটি বিভিন্ন দেশের ইংরেজি দৈনিকে আসার পর এখন আরেইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে দাবি করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনাটি যে রহস্যজনক, এর সঙ্গে নভেল করোনাভাইরাসের যোগসূত্র থাকতে পারে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান এর টুইট করেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীই উহানে করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ে এসেছে।