করোনাভাইরাস ধাক্কায় নকল ওষুধের ব্যবসা রমরমা

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় কার্যকর দাবি করে নকল ওষুধের রমরমা ব্যবসা হচ্ছে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 April 2020, 04:20 PM
Updated : 9 April 2020, 04:24 PM

বিবিসির অনুসন্ধানে আফ্রিকায় এ ধরনের অনেক ভুয়া ওষুধ বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে বৃহস্পতিবার তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এসব ওষুধ সেবনে ‘গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া’ দেখা দিতে পারে বলেও সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

মানহীন ও ভেজাল এসব ওষুধ সেবনে ‘আরেক মহামারী’ দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন একজন বিশ্বেষজ্ঞ।

নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে বিশ্বজুড়েই মানুষ কিছু মৌলিক ওষুধ মজুদ করছে। এদিকে বিশ্বে ওষুধের সবচেয়ে বড় দুই যোগানদাতা চীন ও ভারত লকডাউনে থাকায় চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে বিপজ্জনক ভেজাল ওষুধের রমরমা বাড়ছে।

গত মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণার সপ্তাহেই মাত্র সাত দিনে ৯০টি দেশ থেকে এক কোটি ৪০ লাখ ডলার মূল্যের ভেজাল ওষুধ ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য জব্দ এবং ১২১ জনকে গ্রেপ্তার করে ইন্টারপোলের বৈশ্বিক ফার্মাসিউটিক্যাল অপরাধ দমন ইউনিট।

মালয়েশিয়া থেকে মোজাম্বিক পর্যন্ত পুলিশ কর্মকর্তারা লাখ লাখ নকল মাস্ক, ভুয়া ওষুধ জব্দ করেন, যেগুলোর অনেকগুলোকে দাবি করা হয় করোনাভাইরাস উপশমকারী হিসেবে।

ইন্টারপোলের মহাসচিব ইয়োরগেন স্টক বলেন, “জনস্বাস্থ্য সংকটের সময়ে এ ধরনের ভেজাল ওষুধের অবৈধ ব্যবসা মানুষের জীবনের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞার প্রমাণ দেয়।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধের ৩০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে ভেজাল মেডিকেল পণ্য নিয়ে কাজ করা দলের সদস্য পেরনেট বোরদিলিয়ন স্টেভ বলেন, “এসবের ক্ষেত্রে (ভোজল ওষুধ) সবচেয়ে ভালো যে ঘটনা ঘটে তা হল যে রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধটি সেবন করা হচ্ছে সেজন্য তা কোনো কাজে দিচ্ছে না।

“তবে খারাপ ঘটনার ক্ষেত্রে সেগুলো দেহের ক্ষতি করবে। কারণ সেগুলোতে বিষাক্ত কিছু দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।”

ওষুধের সরবরাহ চেইন

বিশ্বে বছরে ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে ব্যবসা হয় এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। মূলত চীন ও ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি ওষুধ তৈরি হয়ে তা ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার গুদামগুলোতে যায় এবং সেখান থেকে বিশ্বের প্রতিটি দেশে পৌঁছায়।

‘ওষুধের চেয়ে আর কিছুর মনে হয় এতটা বিশ্বায়ন হয়নি’ বলে মন্তব্য করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা স্টেভ। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে এই দেশগুলো লকডাউনে চলে যাওয়ায় এই সাপ্লাই চেইন এরইমধ্যে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে।

ভারতের বেশ কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বিবিসিকে বলেছে, তারা এখন  সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদন করছে। ভারতের কোম্পানিগুলোই আফ্রিকায় মৌলিক ওষুধগুলোর ২০ শতাংশ যোগান দিয়ে থাকে, সে কারণে তাদের ওখানে ইতোমধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকার ফার্মাসিস্ট ইফরাইম ফিরি বলেছেন, ওষুধের সরবরাহে টান পড়ার বিষয়টি তিনি এরইমধ্যে অনুভব করতে পারছেন।

“ওষুধ শেষ হয়ে যাচ্ছে এবং আমরা সেখানে নতুন ওষুধ দিতে পারছি না। আমাদের করার কিছু নেই। সাপ্লাই পাওয়াটা আসলেই খুব কঠিন হয়ে গেছে, বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক ও ম্যালেরিয়ারোধীর মতো প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো।”

ওষুধের কাঁচামালের দামও অনেক বেড়েছে জানিয়ে বিবিসি বলছে, কোনো কোনো কোম্পানির জন্য টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

পাকিস্তানের একজন উৎপাদক বলেছেন, ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্লোরোকুইনের কাঁচামাল আগে এক কেজি ১০০ ডলার দিয়ে কিনতে পারতেন, সেখানে এর দাম বেড়ে হয়েছে এক হাজার ১৫০ ডলার।

অনেক দেশ লকডাউনে গিয়ে উৎপাদন কমাটাই শুধু সমস্যা তৈরি করেনি, বিশ্বজুড়ে মানুষের ওষুধ মজুদ করার প্রবণতাও সংকট বাড়িয়ে দিয়েছে।

সরবরাহে ঘাটতি ও চাহিদা বৃদ্ধির এই অস্থিরতার মধ্যে ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধির বিষয়ে সতর্ক করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

“যখন চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হয় তা এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে যেখানে মানহীন ও ভেজাল ওষুধ বাজারের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে,” বলেন স্টেভ।

ভুয়া ওষুধ

সারা বিশ্বের ফার্মাসিস্ট ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর ভাষ্য মতে, ম্যালেরিয়ারোধী ওষুধের সরবরাহ এখন সংকটের মুখে।

নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে এক ব্রিফিংয়ে এই রোগের চিকিৎসায় ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কার্যকারিতায় বিষয়ে ইঙ্গিত দেওয়ার পর বিশ্বজুড়ে এর চাহিদা বেড়ে যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার বলে আসছে, কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন ও হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারের পক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ নেই।

এরপরেও সাম্প্রতিক এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ম্যালেরিয়ারোধী এই ওষুধগুলো নিয়ে বলেন, “তোমার হারানোর কী আছে? এটা সেবন কর।”

এরপর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো ও ক্যামেরুনে ভুয়া ক্লোরোকুইন বিপুল সংখ্যায় বাজারে ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পেয়েছে বিবিসি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও নাইজারে নকল ওষুধ পেয়েছে।

ক্লোরোকুইন সাধারণত এক হাজার ট্যাবলেটের একটি পট ৪০ ডলারে বিক্রি হয়। সেখানে কঙ্গোয় সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে ২৫০ ডলার পর্যন্ত।

ব্রাউন অ্যান্ড বার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের নামে বাজারে আসা ওই ওষুধ বেলজিয়ামে তৈরি বলে বলা হচ্ছে। তবে যুক্তরাজ্যে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত ব্রাউন অ্যান্ড বার্ক বলছে, এই ওষুধের বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই।

“আমরা এই ওষুধ তৈরি করি না। এটা নকল।”

করোনাভাইরাস মহামারী অব্যাহত থাকায় নকল ওষুধ আরেক ভয়ানক পরিণতি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নকল ওষুধ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পল নিউটন।

পুরো বিশ্ব সম্মিলিতভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষার সরঞ্জাম, টিকা উদ্ভাবন ও ওষুধ সব কিছুর উৎপাদন, বিতরণ ও তদারকির ব্যবস্থা না করলে মানহীন ও ভেজাল ওষুধে ‘আরেকটি মহামারীর’ ঝুঁকি দেখা দেবে বলে মনে করেন তিনি।